শ্বেতকণিকা

দেহের প্রতিরক্ষা তন্ত্রের এক ধরনের কোষ

শ্বেত কণিকা (ইংরেজি: white blood cells) হলো অনাক্রম্যতন্ত্রের কোষ যেগুলো সংক্রামক রোগ ও বাহ্যিক আক্রমণকারী বস্তু থেকে দেহকে রক্ষার কাজে জড়িত। চিকিৎসা পরিভাষায় এগুলো লিউকোসাইট নামেও পরিচিত। শ্বেতকণিকাকে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভ্রাম্যমান একক বলা হয়। তারা আংশিক অস্থিমজ্জা (দানাদার কোষগুলো ও মনোসাইটসমূহ ও কিছু লিম্ফোসাইট) ও আংশিক লসিকাগ্রন্থির টিসুতে (লিম্ফোসাইট ও প্লাজমা কোষ) গঠিত হয়। গঠনের পর, দেহের যে-সকল স্থানে প্রয়োজন হয় সেখানে রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়, বিশেষ করে গুরুতর প্রদাহ ও সংক্রমণের স্থানে সংক্রমণকারী বস্তুর বিরুদ্ধে খুব দ্রুত ও শক্তিশালী সাড়া প্রদানে এদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্বেতকণিকার তিনটি প্রধান উপধরন রয়েছে; দানাদার কোষসমূহ, লিম্ফোসাইট (লসিকা কোষ) ও মনোসাইট (এককেন্দ্রক কোষ)।[১] সকল শ্বেতকণিকা অস্থিমজ্জায় হিমাটোপোয়েটিক স্টেম সেল বা রক্তোৎপাদী মাতৃকোষ নামক মাল্টিপটেন্ট বা বহুজনিকোষসমূহ থেকে উদ্ভূত হয়।[২] রক্তোৎপাদী মাতৃকোষ থেকে দুটি বংশানুক্রমিক ধারায় শ্বেতকণিকা উৎপাদিত হয় তা হলো মায়েলোসাইটিক বা মজ্জাকোষগত বংশ ও লিম্ফোসাইটিক বা লসিকাকোষগত বংশ। দানাদার কোষ ও মনোসাইট বা এককেন্দ্রক কোষসমূহ মায়েলোসাইটিক বংশ থেকে উদ্ভূত, অন্যদিকে লিম্ফোসাইটসমূহ লিম্ফোসাইটিক বংশ থেকে উদ্ভূত।[৩]

শ্বেত রক্তকণিকা বা শ্বেতকণিকা
স্বাভাবিক প্রবহমান মানব রক্তের একটি ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রে তোলা চিত্র। অনিয়তাকার শ্বেত রক্তকণিকা ছাড়াও লোহিত রক্তকণিকা ও অনেক ক্ষুদ্র চাকতি-আকৃতির অণুচক্রিকা দৃশ্যমান।
বিস্তারিত
পূর্বভ্রূণরক্তোৎপাদী মাতৃকোষ
তন্ত্রঅনাক্রম্যতন্ত্র
শনাক্তকারী
লাতিনলিউকোসাইট
আদ্যক্ষরাWBC
মে-এসএইচD007962
টিএইচH2.00.04.1.02001
এফএমএFMA:62852
মাইক্রো শারীরস্থান পরিভাষা


শ্বেতকণিকাসমূহ রক্তলসিকাতন্ত্রসহ সারা দেহেই উপস্থিত থাকে।[৪] সকল শ্বেতকণিকার নিউক্লিয়াস থাকে,যা তাদের অন্যান্য রক্তকণিকা যেমন, নিউক্লিয়াস বিহীন লোহিত রক্তকণিকাঅণুচক্রিকা থেকে পৃথক করে। শ্বেতকণিকার ধরনগুলো হলো দানাদার কোষ (নিউট্রোফিল, ইওসিনোফিল, বেসোফিল) ও অদানাদার কোষ (মনোসাইটলিম্ফোসাইট)।[৫] মায়েলয়েড কোষসমূহ (মায়েলোসাইট) হলো নিউট্রোফিল, ইওসিনোফিল, বেসোফিল, মাস্ট কোষ বা পৃথুল কোষ ও মনোসাইট[৬] মনোসাইটসমূহকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায় ডেনড্রিটিক কোষ ও ম্যাক্রোফেজ। নিউট্রোফিল ও মনোসাইট ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। লিম্ফোয়েড কোষসমূহ (লিম্ফোসাইট) হলো টি কোষ ( এটি আবার সাহায্যকারী টি কোষ, স্মৃতি টি কোষ, কোষ-বিষাক্তকারক টি কোষ উপভাগে বিভক্ত), বি কোষ (এটি প্লাজমা কোষ ও স্মৃতি বি কোষ নামক দুটি উপভাগে বিভক্ত) এবং প্রাকৃতিক মারণ কোষ। ঐতিহাসিকভাবে, শ্বেতকণিকাকে তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিভক্ত (দানাদার কোষ ও অদানাদার কোষ) করা হতো, কিন্তু বর্তমানে এই শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি খুব কম ব্যবহৃত হয়। অস্থিমজ্জাতে উৎপাদিত হয়ে, শ্বেতকণিকা দেহকে সংক্রমণরোগ থেকে রক্ষা করে। সংক্রমণ বা প্রদাহ ঘটলে রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। অল্পকিছু ক্ষেত্রে, শ্বেতকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি কিছু রক্তের ক্যান্সার বা অস্থিমজ্জার রোগ কে নির্দেশ করে।

রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যার ওঠানামা প্রায়শই কিছু রোগকে নির্দেশ করে, তাই শ্বেতকণিকা গণনা পূর্ণাঙ্গ রক্ত গণনার একটি অংশ। শ্বেতকণিকার স্বাভাবিক সংখ্যা হলো ৪ × ১০/L থেকে ১.১ × ১০১০/L। যুক্তরাষ্ট্রে এটি প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে ৪,০০০-১১,০০০ হিসেবে লেখা হয়।[৭] একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মোট রক্ত আয়তনের প্রায় ১% হলো শ্বেতকণিকা,[৮] যা লোহিত রক্তকণিকার (৪০-৪৫%) তুলনায় অনেক কম। তবে, রক্তের এই ১% স্বাস্থ্য রক্ষায় বড়ো পার্থক্য তৈরি করে দেয়, এর উপরে দেহের অনাক্রম্যতা বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্ভরশীল। শ্বেতকণিকার সংখ্যা স্বাভাবিক ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করলে তাকে লিউকোসাইটোসিস (শ্বেতিকাধিক্য) বলে। যখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্বাভাবিক সাড়াদান হিসেবে ঘটে, তখন এটিকে স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয় যা প্রায়শই ঘটে থাকে। তবে, যদি ক্যান্সার বা অটোইমিউনিটির জন্য ঘটে থাকে, তাহলে এটি অস্বাভাবিক বলা হয়। কোষ সংখ্যা নিম্নসীমার নিচে চলে গেলে তাকে লিউকোপিনিয়া (শ্বেতিকাস্বল্পতা) বলে। অনাক্রম্যতন্ত্র দুর্বল হলে এমন হয়।

ব্যুৎপত্তি

রক্তের নমুনা সেন্ট্রিফিউগেশন বা অবক্ষেপন করার পর প্রাপ্ত শারীরিক চেহারা থেকে শ্বেতকণিকা নামের উৎপত্তি। শ্বেতকণিকা বাফি কোট বা বাদামি-হলুদ আস্তর নামক একটি পাতলা স্তরে থাকে যা তলানিতে পড়া লোহিত রক্তকণিকাপ্লাজমার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। বৈজ্ঞানিক পরিভাষা লিউকোসাইট এসেছে গ্রিক মূল leuk- (লিউক-), যার অর্থ সাদাcyt- (সাইট-) থেকে, যার অর্থ কোষ। রক্তের নমুনায় নিউট্রোফিলের সংখ্যা বেশি থাকলে 'বাফি কোট' সবুজ রঙের হয়, কারণ নিউট্রোফিল মায়েলোপার‌অক্সিডেজ নামক উৎসেচক তৈরি করে যার মধ্যে হিম উপাদান বিদ্যমান।

শ্বেতকণিকার বৈশিষ্ট্যাবলি

শ্বেতকণিকা ও লোহিত রক্তকণিকার বৈশিষ্ট্যমূলক পার্থক্য
বৈশিষ্ট্যশ্বেত রক্তকণিকালোহিত রক্তকণিকা
বর্ণবর্ণহীনলাল
সংখ্যাকম: ৪,০০০-১১,০০০/μLবেশি: ৪.৮×১০ /μL (মহিলা)
৫.৪×১০ /μL (পুরুষ)
আকারবৃহত্তর, সর্বোচ্চ ব্যাস = ২০ μmক্ষুদ্রতর, সর্বোচ্চ ব্যাস = ৭.৮ μm
আকৃতিঅনিয়তাকারদ্বি-অবতল চাকতি আকৃতির
নিউক্লিয়াসআছেনেই
দানাকিছু কোষ দানাদার,

কিছু অদানাদার

নেই
ধরনপাঁচটি ধরন রয়েছেএকটি মাত্র ধরন
জীবৎকালকম

কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক মাস

বেশি

১২০ দিন

প্রধান কাজদেহকে আক্রমণকারী জীবাণুর

হাত থেকে রক্ষা করা

ফুসফুস থেকে কোষে অক্সিজেন

এবং কোষ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড

ফুসফুসে পরিবহণ

শ্বেত রক্তকণিকাসমূহ মানবদেহের সংবহনতন্ত্রে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যাবলি প্রদর্শন করে:

  • ডায়াপিডিসিস: ডায়াপিডিসিস বা নিষ্ক্রমণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শ্বেতকণিকা সরু রক্তবাহ বা কৈশিকার এন্ডোথেলিয়ামের রন্ধ্র দিয়ে চলাচল করে।[৯] নিউট্রোফিল ও মনোসাইট কৈশিকা ও কৈশিকা-পরবর্তী ধমনিকার এন্ডোথেলিয়াল কোষসমূহের মধ্যস্থিত ক্ষুদ্র রন্ধ্রের মধ্য দিয়ে ডায়াপিডিসিস (নিষ্ক্রমণ) প্রক্রিয়ায় ঠেস দিয়ে বের হয়ে আহত টিসুর দিকে যেতে পারে। যদিও শ্বেতকণিকার তুলনায় আন্তঃকোষীয় ফাঁক বা রন্ধ্র খুবই ক্ষুদ্রতর, কোষের একটি অংশ প্রথমে রন্ধ্রের মধ্য দিয়ে পিছলিয়ে যায়; কোষের এই অংশটুকু ঐ সময়ের জন্য ক্ষণস্থায়ীভাবে রন্ধ্রের আকারের সমান সংকুচিত হয়ে যায়।[১০]
  • অ্যামিবা-সদৃশ চলন: সাইটোপ্লাজমের বহিঃসরণ ও আকৃতির পরিবর্তনের মাধ্যমে শ্বেতকণিকা অ্যামিবা-সদৃশ চলন প্রদর্শন করে। নিউট্রোফিল, ম্যাক্রোফেজ, লিম্ফোসাইট এই পদ্ধতিতে চলতে পারে।[৯] কিছু কোষ প্রতি মিনিটে তাদের নিজস্ব দৈর্ঘ্যের সমান দূরত্বে বা ৪০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত গতিতে চলতে পারে।[১০]
  • কেমোট্যাক্সিস‌: ক্ষতস্থানে নিঃসৃত কিছু রাসায়নিক বস্তুর কারণে আহত টিসুর দিকে শ্বেতকণিকার যে আকর্ষণ সৃষ্টি হয় তাকে কেমোট্যাক্সিস বা রসানুচলন বলে।[৯] আকর্ষণ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থসমূহের মধ্যে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস থেকে নির্গত টক্সিন বা অধিবিষ, প্রদাহঘটিত টিসুর অপজাত বস্তু, প্রদাহঘটিত টিসুতে সক্রিয় হওয়া কমপ্লিমেন্ট যৌগের বিক্রিয়াঘটিত কিছু বস্তু এবং প্রদাহ অঞ্চলে রক্তরস তঞ্চন বিক্রিয়ায় উৎপাদিত কিছু বস্তু ও কিছু অন্যান্য পদার্থ। কেমোট্যাক্টিক বা রসানুচলনমূলক পদার্থসমূহের ঘনমাত্রার উপরে কেমোট্যাক্সিস (রসানুচলন) নির্ভর করে। উৎসের কাছাকাছি ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি থাকে, যা শ্বেতকণিকাসমূহের একমুখী চলন পরিচালনা করে। প্রদাহঘটিত টিসু থেকে ১০০ মাইক্রোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত কেমোট্যাক্সিস (রসানুচলন) কার্যকর হয়। যেহেতু কোনো টিসু অঞ্চলই কৈশিকা থেকে ৫০ মাইক্রোমিটারের বেশি দূরে অবস্থিত না, সেহেতু কেমোট্যাক্টিক বা রসানুচলনমূলক সংকেত খুব সহজেই এক ঝাঁক শ্বেতকণিকাকে কৈশিকা থেকে প্রদাহ অঞ্চলে চালিত করতে পারে।[১০]
  • ফ্যাগোসাইটোসিস: নিউট্রোফিল ও মনোসাইট বা ম্যাক্রোফেজ ফ্যাগোসাইটোসিস (খাদন) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাহ্যিক বস্তুকে গ্রাস করে।[৯]

শ্বেতকণিকা উৎপাদন ও সঞ্চয়

অস্থিমজ্জাতে রক্তোৎপাদী মাতৃকোষ থেকে মায়েলোসাইটিক ও লিম্ফোসাইটিক নামক দুটি বংশানুক্রম গঠিত হয়, যেখান থেকে সকল শ্বেতকণিকা উৎপাদিত হয়। দানাদার কোষ ও মনোসাইট কেবল অস্থিমজ্জাতে তৈরি হয়। লিম্ফোসাইট ও প্লাজমা কোষ প্রধানত লিম্ফোয়েড অঙ্গসমূহে (যেমন, লসিকাগ্রন্থি, প্লীহা, থাইমাস, টনসিল) তৈরি হয়।[৩] অস্থিমজ্জাতে তৈরি শ্বেতকণিকাসমূহ সংবহনতন্ত্রে প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই সঞ্চিত থাকে। অতঃপর প্রয়োজন দেখা দিলে, বিবিধ বিষয় বা বস্তুর প্রভাবে সেগুলো অবমুক্ত হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় সংবহনতন্ত্রে প্রবহমান শ্বেতকণিকার প্রায় তিনগুণ বেশি অস্থিমজ্জায় সঞ্চিত থাকে।[১০] লিম্ফোসাইটসমূহ বিভিন্ন লসিকাগ্রন্থি বা লিম্ফোয়েড টিসুতে সঞ্চিত থাকে, তবে অল্প পরিমাণ রক্তে পরিবাহিত হয়।[১০]

শ্বেতকণিকার সংখ্যা

মানব রক্তের শ্বেতকণিকাসমূহের স্বাভাবিক মান
কোষ

(প্রাপ্তবয়স্ক)

কোষ/μL


(গড়)

প্রায়িক


স্বাভাবিক সীমা/ΒL

মোট শ্বেতকণিকার


শতকরা হার

শিশুমোট শ্বেতকণিকা/μL
মোট শ্বেতকণিকা৯০০০৪০০০-১১,০০০...
নিউট্রোফিল৫৪০০৩০০০-৬০০০৫০-৭০নবজাতক১০,০০০-২৫,০০০
ইওসিনোফিল২৭৫১৫০-৩০০১-৪১ বছর৬,০০০-১৮,০০০
বেসোফিল৩৫০-১০০০-৪৪-৭ বছর৬,০০০-১৫,০০০
লিম্ফোসাইট২৭৫০১৫০০-৪০০০২০-৪০৮-১২ বছর৪,৫০০-১৩,৫০০
মনোসাইট৫৪০৩০০-৬০০২-৮


প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রতি মাইক্রোলিটারে ৪,০০০-১১,০০০ সংখ্যক, জন্মের ১২ ঘণ্টা পর স্বাস্থ্যবান নবজাতকের প্রতি মাইক্রোলিটারে ১৩,০০০ থেকে ৩৮,০০০ সংখ্যক শ্বেতকণিকা থাকে।[১১] একবছর বয়সিদের ক্ষেত্রে ২০,০০০ ও এর চেয়ে বেশি বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে ১০,০০০-১৫,০০০ সংখ্যক থাকে।[৯] মোট শ্বেতকণিকা ও নিউট্রোফিল সংখ্যা সর্বাধিক থাকে নবজাতকে,[১২] ১-২ সপ্তাহ বয়স থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধির প্রথমদিক পর্যন্ত লিম্ফোসাইটের সংখ্যা বড়োদের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে বেশি থাকলেও বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে নিউট্রোফিল প্রধান শ্বেতকণিকা হিসেবে জায়গা করে নেয়।[১২] নারীদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে সামান্য বেশি থাকে। রজঃস্রাব, গর্ভধারণ, সন্তান প্রসবকালীন শ্বেতকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।[১৩] স্বাভাবিক গর্ভাবস্থায় মোট শ্বেতকণিকা ও নিউট্রোফিলের ঊর্ধ্বসীমা প্রতি মাইক্রোলিটারে যথাক্রমে ১৪,৫০০ ও ১১,০০০।[১৪] এ-ছাড়া শারীরিক ব্যায়াম, আবেগীয় অবস্থা যেমন, উদ্‌বেগজনিত কারণেও শ্বেতকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে।[৯] পর্যাপ্ত ঘুম হলে শ্বেতকণিকার সংখ্যা কম থাকে;[৯] অপরদিকে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শ্বেতকণিকা বৃদ্ধি পায়।[১৫] স্বাভাবিক অবস্থায় শ্বেতকণিকার সংখ্যা সবচেয়ে কম থাকে সকালে এবং সবচেয়ে বেশি থাকে বিকেল বেলা।[৯] জাতিগোষ্ঠী অনুযায়ী মোট শ্বেতকণিকা ও বিভিন্ন উপধরনের সংখ্যায় তারতম্য লক্ষ করা যায়। আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের মোট শ্বেতকণিকা ও নিউট্রোফিল সংখ্যা কম থাকে।[১৬]


শ্বেতকণিকার জীবৎকাল

শ্বেতকণিকার রক্তে উপস্থিত থাকার প্রধান কারণ হলো অস্থিমজ্জা বা লিম্ফোয়েড টিসু থেকে দেহের যে-স্থানে তাদের প্রয়োজন সেখানে পরিবহণ করা। অস্থিমজ্জা থেকে অবমুক্ত হওয়া দানাদার কোষসমূহের জীবৎকাল সংবহনতন্ত্রে সাধারণত ৪-৫ ঘণ্টা এবং টিসুতে আরও অতিরিক্ত ৪-৫ দিন।[৩] গুরুতর টিসু সংক্রমণ হলে মোট জীবৎকাল মাত্র কয়েক ঘণ্টায় নেমে আসতে পারে, কারণ দানাদার কোষসমূহ খুব দ্রুত সংক্রমিত অঞ্চলে যেতে থাকে, কাজ সম্পাদন শেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। টিসুতে প্রবেশের পূর্বে মনোসাইটসমূহের পরিবহণ সময় প্রায় ১০-২০ ঘণ্টা।[১০] টিসুতে প্রবেশের পর তারা স্ফীত হয়ে বৃহত্তর আকৃতি ধারণ করে টিসু ম্যাক্রোফেজে পরিণত হয়, এই অবস্থায় কোষভক্ষণমূলক কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত না হলে তারা কয়েকমাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।[৩]

লিম্ফোসাইটসমূহ লসিকাগ্রন্থি থেকে লসিকার মাধ্যমে অবিরাম সংবহনতন্ত্রে প্রবেশ করে। কয়েক ঘণ্টা পর, তারা ডায়াপিডিসিস (নিষ্ক্রমণ) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টিসুতে ফিরে আসে এবং লসিকায় পুনঃপ্রবেশ করে, এভাবে রক্তে বারংবার ফিরে আসে। দেহে লিম্ফোসাইটের প্রয়োজন অনুসারে এদের জীবৎকাল কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে।[১০]


শ্বেতকণিকার শ্রেণিবিভাগ

সার বর্ণনা

বিভিন্ন ধরনের শ্বেতকণিকার ত্রিমাত্রিক চিত্র[১৭]


সকল শ্বেতকণিকা নিউক্লিয়াসযুক্ত, যা তাদেরকে নিউক্লিয়াসবিহীন লোহিত রক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা থেকে আলাদা করে। শ্বেতকণিকাকে হয় গঠন (দানাদার কোষ অথবা অদানাদার কোষ) বা কোষ বংশানুক্রম (মায়েলয়েড কোষ অথবা লিম্ফোয়েড কোষ) অনুসারে দুটি বৃহৎ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এই বৃহৎ শ্রেণিকে পুনরায় পাঁচটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: নিউট্রোফিল, ইওসিনোফিল, বেসোফিল, লিম্ফোসাইটমনোসাইট[৬] এই ধরনগুলোকে তাদের শারীরিক ও কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পৃথক করা হয়। এদেরকে পুনরায় বিভিন্ন উপধরনে বিভক্ত করা যায়। দানাদার কোষকে অদানাদার কোষ থেকে নিউক্লিয়াসের আকৃতি (খণ্ডযুক্ত বনাম গোলাকার, অর্থাৎ, বহুরূপী নিউক্লিয়াস বনাম একক নিউক্লিয়াস) ও তাদের সাইটোপ্লাজম দানার (উপস্থিত বা অনুপস্থিত, অথবা আরও স্পষ্ট করে বললে, আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রে দৃশ্যমান অথবা দৃশ্যমান নয়) মাধ্যমে পৃথক করা যায়।[১৮]

রক্তরসে ভাসমান থাকা অবস্থায় সকল শ্বেতকণিকা বর্তুলাকার হয়ে থাকে, রক্তবাহ থেকে বের হওয়ার পর তারা অ্যামিবা-সদৃশ ও চলনক্ষম হয়ে যায়। সারণিতে যে আকারের উল্লেখ করা হয়েছে তা রক্তানুলেপ বা ব্লাড স্মিয়ারের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত, যেখানে কোষসমূহ ছড়ানো থাকে এবং সংবহনতন্ত্রের তুলনায় কিছুটা বড়ো মনে হয়।[১৯]


ধরনচেহারাপ্রায়িক %
প্রাপ্তবয়স্ক
ব্যাস (μm)[২০]প্রধান লক্ষ্যবস্তুসমূহ[৮]নিউক্লিয়াস[৮]দানা[৮]জীবৎকাল[২০]
(অণুবীক্ষণ চিত্র)(সচিত্রীকরণ)
নিউট্রোফিল ৬২%১২–১৫



বহুখণ্ডকসূক্ষ্ম, হালকা গোলাপি (H&E রঞ্জক)৬ ঘণ্টা – কয়েক দিন
(প্লীহা ও অন্যান্য টিসুতে কয়েকদিন)
ইওসিনোফিল ২.৩%১২–১৫
(নিউট্রোফিলের চেয়ে কিছুটা বড়ো)



দ্বি-খণ্ডকগোলাপি-কমলা(H&E রঞ্জক)৮–১২ দিন (সংবহনতন্ত্রে ৪-৫ ঘণ্টা)
বেসোফিল ০.৪%১২–১৫ (নিউট্রোফিলের চেয়ে কিছুটা ক্ষুদ্রতর)


দ্বিখণ্ডক অথবা ত্রিখণ্ডকবৃহৎ নীলকয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন
লিম্ফোসাইট ৩০%ক্ষুদ্র লিম্ফোসাইট ৭–৮

বৃহৎ লিম্ফোসাইট ১২–১৫


  • বি কোষ: অ্যান্টিবডি অবমুক্ত করে এবং টি কোষ সক্রিয়করণে সহায়তা করে।


    • CD4+ সাহায্যকারী টি কোষ: টি ও বি কোষ কে সক্রিত ও নিয়ন্ত্রণ করে।
    • নিয়ন্ত্রণমূলক টি কোষ: সংক্রমণের পর অনাক্রম্যতন্ত্রের কাজ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে; স্ব-অনাক্রম্যতা প্রতিরোধ করে।


খুব গাঢ়ভাবে রঞ্জিত, ভিন্নকেন্দ্রীপ্রাকৃতিক মারণ কোষ ও কোষ-বিষাক্তকারক (CD8+) টি কোষস্মৃতি কোষের জন্য অনেক বছর, অন্যান্য ক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ।
মনোসাইট ৫.৩%১৫–৩০[২১]মনোসাইট রক্তপ্রবাহ থেকে অন্য টিসুতে পরিভ্রমণ করে টিসুতে ম্যাক্রোফেজ, যকৃতে কুপফার কোষ প্রভৃতিতে পরিণত হয়।বৃক্ক আকৃতিরনেইকয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন
ম্যাক্রোফেজ প্রায় ২১ ও কখনো কখনো ৬০–৮০মনোসাইট থেকে উদ্ভূত, কোষীয় ধ্বংসাবশেষ ও রোগ সংক্রামক জীবাণুসমূহ ফ্যাগোসাইটোসিস (গ্রাসকরণ ও পরিপাক) প্রক্রিয়ায় ধ্বংসকরণ, ও লিম্ফোসাইট ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা কোষকে জীবাণুর বিরুদ্ধে সাড়া প্রদানে উদ্দীপনা প্রদান।......সক্রিয়কৃত: কয়েকদিন
প্রতিরক্ষা: কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর
ডেনড্রিটিক কোষ মায়েলয়েড বা লিম্ফোয়েড কোষ থেকে উদ্ভূত হয়। অ্যান্টিজেন-উপস্থাপক কোষ হিসেবে কাজ করে যা টি লিম্ফোসাইটকে সক্রিয় করে।......ম্যাক্রোফেজের অনুরূপ


অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যাবলি

নিউট্রোফিল

নিউট্রোফিল ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়াকে গ্রাস করছে

নিউট্রোফিল বা নিরাকর্ষী শ্বেতিকা হলো সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতকণিকা, প্রবহমান মোট শ্বেতকণিকার ৫০-৭০% হলো নিউট্রোফিল।[২২][৮] এদেরকে পলিমরফোনিউক্লিয়ার বা বহুরূপী নিউক্লিয়াসবিশিষ্ট শ্বেতকণিকা বলে, যদিও প্রকৃতপক্ষে পলিমরফোনিউক্লিয়ার বলতে সকল দানাদার কোষকে বুঝায়। এদের নিউক্লিয়াস বহুখণ্ড বিশিষ্ট, তিন থেকে পাঁচটি খণ্ড পাতলা সুতার মতো বস্তু দ্বারা যুক্ত থাকে।[২৩] এর ফলে নিউট্রোফিলকে দেখে মনে হয়, এতে অনেকগুলো নিউক্লিয়াস বিদ্যমান; এজন্য এর নাম পলিমরফোনিউক্লিয়ার বা বহুরূপী শ্বেতকণিকা। নারীদের ক্ষেত্রে, নিউক্লিয়াস খণ্ডগুলোর একটিতে নিষ্ক্রিয় এক্স ক্রোমোসোমকে ঢাকের কাঠিসদৃশ উপাঙ্গ হিসেবে দেখা যেতে পারে।[১৯]

সাইটোপ্লাজমে রঞ্জিত অবস্থায় ঈষৎ বেগুনি রঙের সূক্ষ্ম দানা থাকায় এটি অচ্ছ দেখায়। অসংখ্য সাইটোপ্লাজমীয় দানা আকার, আকৃতি ও উপাদানে অসমসত্ত বা বিষমজাতীয়, কিন্তু সবাই ঝিল্লি-বেষ্টিত এবং আর্দ্রবিশ্লেষী ও অন্যান্য উৎসেচক ধারণ করে। তাদের উৎস ও উপাদানের উপর ভিত্তি করে দুটি প্রধান ধরনে পৃথক করা হয়। প্রাথমিক (অ্যাজুরোফিলিক বা নভোনীলাকর্ষী) দানাসমূহ নিউট্রোফিল পরিপক্কতার প্রথম দিকে গঠিত হয়। এরা অপেক্ষাকৃত বৃহৎ (০.৫ μm) উপগোলকীয় লাইসোসোম যার মধ্যে মায়েলোপার‌অক্সিডেজ, অ্যাসিড ফসফাটেজ, ইলাস্টেজ ও কিছু অন্যান্য উৎসেচক রয়েছে। সুনির্দিষ্ট বা গৌণ দানাগুলো পরে গঠিত হয় এবং বিবিধ আকৃতির হয়ে থাকে, যেমন বর্তুলাকার, উপবৃত্তাকার ও দণ্ডাকার। এগুলোতে শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ানাশক উপাদান যেমন অ্যালকালাইন ফসফাটেজ, ল্যাক্টোফেরিন ও কোলাজিনেজ রয়েছে, যেগুলোর কোনোটিই প্রাথমিক দানাগুলোতে নেই। অপরপক্ষে, গৌণ দানাগুলোতে পার‌অক্সিডেজ ও অ্যাসিড ফসফাটেজ থাকে না। কিছু উৎসেচক, যেমন লাইসোজাইম, উভয় ধরনের দানাতেই থাকে।[২৪]

নিউট্রোফিল ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে এবং ক্ষতস্থানের পুঁজে প্রচুর নিউট্রোফিল থাকে। এ-সব কোষগুলো তাদের লাইসোসোমকে (অণুজীবগুলোকে ধ্বংস করতে ব্যবহৃত) পুনর্গঠিত করতে পারে না, ফলে কিছু জীবাণুকে ধ্বংস করার পর মারা যায়।[২৫] তাৎক্ষণিক প্রদাহের প্রাথমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি থাকে নিউট্রোফিল। তীব্র তাৎক্ষণিক প্রদাহের ফলে রক্তে নিউট্রোফিল সংখ্যা কখনো কখনো চার থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে (প্রতি মাইক্রোলিটারে স্বাভাবিক সংখ্যা ৪,০০০-৫,০০০ থেকে ১৫,০০০-২৫,০০০ পর্যন্ত), যা নিউট্রোফিলিয়া নামে পরিচিত।[১০]সংবহনে নিষ্ক্রিয় মানব নিউট্রোফিলের গড় জীবৎকাল ৫ থেকে ১৩৫ ঘণ্টার মধ্যে।[২৬][২৭] নিউট্রোফিল প্রিকার্সর বা পূর্বগ ও নিউট্রোফিল অস্থিমজ্জাতে ১৪ দিন অতিবাহিত করে, যেখানে রক্তে এদের অর্ধায়ু মাত্র ৬-৯ ঘণ্টা। প্রান্তীয় রক্তে নিউট্রোফিলের সংখ্যা দেহের মোট নিউট্রোফিলের ১০%-এরও কম।[২৮] রক্তে স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখার জন্য প্রত্যহ ১০ ১১ বা ১০০ বিলিয়নেরও বেশি নিউট্রোফিল উৎপাদিত হওয়া প্রয়োজন।[২৯]

ইওসিনোফিল

মোট শ্বেতকণিকার ২-৪% হলো ইওসিনোফিল। এই সংখ্যা সারা দিনব্যাপী, মৌসুমে ও রজঃস্রাবের সময় ওঠানামা করে। অ্যালার্জি, পরজীবী সংক্রমণ, কোলাজেন রোগ, প্লীহা ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের রোগে ইওসিনোফিল সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। রক্তলেপ বা ব্লাড স্মিয়ারে, এই কোষের আকার নিউট্রোফিলের সমান বা সামান্য বড়ো, এদের নিউক্লিয়াস দ্বিখণ্ডক, খণ্ডদ্বয় পাতলা সূত্রক দ্বারা যুক্ত। সাইটোপ্লাজম অম্লাকোর্ষী দানাযুক্ত যা ইওসিন রঞ্জকে বৈশিষ্টপূর্ণ গোলাপি-কমলা রং ধারণ করে। ইওসিনোফিলিক-সুনির্দিষ্ট দানাসমূহ ডিম্বাকৃতির ও চ্যাপটা স্ফটিক-তুল্য কেন্দ্রবিশিষ্ট। দানাতে মেজর বেসিক প্রোটিন থাকে, যেটি একটি আরজিনিন-সমৃদ্ধ বস্তু যা দানার অ্যাসিডোফিলিয়া বা অম্লাকর্ষীতার জন্য দায়ী এবং এটি মোট দানা প্রোটিনের ৫০%। মেজর বেসিক প্রোটিনসমূহ ইওসিনোফিলিক পার‌অক্সিডেজ ও অন্যান্য উৎসেচক এবং টক্সিন বা অধিবিষের সাহায্যে পরজীবী বা কৃমিকে হত্যা করে। ইওসিনোফিলসমূহ বিশেষ করে অন্ত্রের আবরণীর যোজক কলা এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ হয় এমন স্থান যেমন, হাঁপানি রোগীর ফুসফুস টিসুতে প্রচুর পরিমাণে থাকে।[১৯]

ইওসিনোফিল হলো দুর্বল ফ্যাগোসাইট বা ভক্ষককোষ, এদের কেমোট্যাক্সিস (রসানুচলন) বৈশিষ্ট্য রয়েছে তবে, নিউট্রোফিলের তুলনায় সচরাচর সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা দিতে কতখানি সক্ষম তা সন্দেহজনক।[২৩] প্রাথমিকভাবে পরজীবী সংক্রমণে কাজ করলেও, অ্যালার্জিক বিক্রিয়াতে প্রধান প্রদাহমূলক কোষ হিসেবে ভূমিকা রাখে। ইওসিনোফিলের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেলে তাকে ইওসিনোফিলিয়া বলে। ইওসিনোফিলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হলো অ্যালার্জিসমূহ যেমন হাঁপানি, হেই ফিভার, ছুলি ও পরজীবী সংক্রমণ।[২৩]

বেসোফিল

রক্তে শ্বেতকণিকার চলন।

বেসোফিলের ব্যাস ১২-১৫ μm কিন্তু প্রবহমান শ্বেতকণিকার মাত্র ১%-এর চেয়েও কম হওয়ায় স্বাভাবিক ব্লাড স্মিয়ার বা রক্তকাচে দেখতে পাওয়া কঠিন। এদের নিউক্লিয়াস দুটি অনিয়ত খণ্ডে বিভক্ত এবং সাইটোপ্লাজমে অসূক্ষ্ম দানা বিদ্যমান, কিন্তু বৃহৎ সুনির্দিষ্ট দানাসমূহ (ব্যাস ০.৫ μm) নিউক্লিয়াসের উপরে অবস্থান করায় এটিকে স্পষ্টভাবে দেখা যায় না।[১৯] দানাগুলো মেথিলিন ব্লু রঞ্জকে অরুণিম নীল বর্ণ ধারণ করে।[৯] বেসোফিল কিছুটা পৃথুল বা মাস্ট কোষের মতো হলেও দুটি ভিন্ন কোষ।[২৯] বেসোফিল ও মাস্ট কোষ (পৃথুল কোষ) উভয়ই রক্তে হেপারিন নিঃসরণ করে। হেপারিন রক্ত তঞ্চন প্রতিরোধ করে। এ-ছাড়া বেসোফিল থেকে হিস্টামিন ও অল্প পরিমাণ ব্র‍্যাডিকাইনিন এবং সেরোটোনিন নিঃসৃত হয়।[১০] দানাসমূহে হেপারিন ও অন্যান্য সালফেটযুক্ত গ্লাইকোসামিনোগ্লাইক্যান যৌগসমূহের উপস্থিতির কারণে অত্যন্ত ক্ষারাকর্ষী হয়ে থাকে।[১৯] বেসোফিল নিঃসৃত হিস্টামিন রক্তবাহের প্রসারণ ঘটিয়ে আহত টিসুতে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়। এটি রক্তনালিকে অনেক বেশি ভেদ্য বানায়, ফলে নিউট্রোফিল ও তঞ্চনকারী প্রোটিন সহজেই যোজক কলাতে প্রবেশ করতে পারে। হেপারিন তঞ্চনরোধক হিসেবে কাজ করায় প্রদাহ অঞ্চলে শ্বেতকণিকার চলন সহজ হয়। বেসোফিল রসানুচলনমূলক বা কেমোট্যাক্টিক বস্তুও নির্গত করে যা নিউট্রোফিল ও ইওসিনোফিলকে সংক্রমণস্থলে আকর্ষণ করে।[২৩]


লিম্ফোসাইট

অদানাদার কোষগুলোর মধ্যে রক্তে সবচেয়ে বেশি থাকে লিম্ফোসাইট (মোট শ্বেতকণিকার এক-তৃতীয়াংশ), এদের নিউক্লিয়াস প্রধানত বর্তুলাকার, তবে শিম-আকৃতির বা বৃক্ক-আকৃতিরও হতে পারে।[৯] লিম্ফোসাইট হলো সবচেয়ে ক্ষুদ্র শ্বেতকণিকা। যদিও অঙ্গসংস্থানিকভাবে তারা অনুরূপ, তথাপি স্বাতন্ত্র্যসূচক পৃষ্ঠতলীয় অণুসমূহের (ক্লাস্টার অব ডিফারেনসিয়েশন নামে পরিচিত) দ্বারা বিভিন্ন কার্যক্রমমূলক গোষ্ঠীতে ভাগ করা যেতে পারে। যদিও সাধারণত ক্ষুদ্র, তথাপি অধিকাংশ শ্বেতকণিকার তুলনায় প্রবহমান লিম্ফোসাইটের আকারের সীমা প্রশস্ততর। ক্ষুদ্র, নব-মুক্ত লিম্ফোসাইটের ব্যাস লোহিত রক্তকণিকার অনুরূপ; মাঝারি ও বৃহৎ লিম্ফোসাইটসমূহের ব্যাস ৯-১৮ μm, যেখানে শেষেরটা সক্রিয় লিম্ফোসাইট অথবা প্রাকৃতিক মারণ কোষকে প্রতিনিধিত্ব করে। ক্ষুদ্র লিম্ফোসাইটগুলোর নিউক্লিয়াস বর্তুলাকার ও অতিঘন ক্রোমাটিন (রঞ্জীকেন্দ্রক) যুক্ত; নিউক্লিয়াসের চারিপাশে চিকন বৃত্তাকারে অত্যল্প সাইটোপ্লাজম রয়েছে, যার ফলে দানাদার কোষ থেকে সহজেই পৃথক করা যায়। বৃহত্তর লিম্ফোসাইটসমূহের নিউক্লিয়াস কিছুটা বৃহত্তর, সামান্য খাঁজকাটা। সাইটোপ্লাজম অপেক্ষাকৃত বেশি, এতে কিছুটা বেসোফিলিক (ক্ষারাকর্ষী) ও কতকটা অ্যাজুরোফিলিক দানা, মাইটোকন্ড্রিয়া, মুক্ত পলিসোম এবং অন্যান্য অঙ্গাণু থাকে।[১৯] লিম্ফোসাইটসমূহ অস্থিমজ্জার বহুজনি রক্তোৎপাদী মাতৃকোষ থেকে উদ্ভূত হয়। দুটো প্রধান ধরন হলো টি কোষ (যেটি কোষীয় অনাক্রম্যতা প্রদান করে) ও বি কোষ (যেটি হিউমোরাল অনাক্রম্যতা প্রদান করে)। যে-সকল লিম্ফোয়েড কোষসমূহ থাইমাসে পরিভ্রমণ করে, সেগুলো টি কোষে পরিণত হয়, অন্যদিকে বি কোষসমূহ অস্থিমজ্জাতে পরিপক্কতা লাভ করে। সংবহনে অধিকাংশ (প্রায় ৮০%) লিম্ফোসাইট হলো টি কোষ।[৩০]

মনোসাইট

মনোসাইট হলো বৃহত্তম শ্বেতকণিকা (ব্যাস ১২–২০ µm), এতে অনিয়ত নিউক্লিয়াস-যুক্ত মলিন নীল সাইটোপ্লাজম রয়েছে।[৩০] কখনো কখনো সাইটোপ্লাজমে গহ্বর থাকে। নিউক্লিয়াসটি আকারে বৃহৎ এবং খাঁজযুক্ত বা ইংরেজি 'সি' বর্ণের মতো। ক্রোমাটিন তন্তু অপেক্ষাকৃত কম ঘন এবং বৃহৎ লিম্ফোসাইটের তুলনায় হালকাভাবে রঞ্জিত হয়।[১৯] এই কোষগুলো সংবহনে কয়েক ঘণ্টা অবস্থানের পর টিসুতে পরিভ্রমণ করে, যেখানে তারা ম্যাক্রোফেজ, কুপফার কোষ অথবা অ্যান্টিজেন-উপস্থাপনকারী ডেনড্রিটিক কোষে পরিণত হয়।[৩১]

ম্যাক্রোফেজ

ম্যাক্রোফেজগুলো উদ্ভূত হয় মনোসাইট থেকে। কার্যক্রমের অবস্থার উপর ভিত্তি করে এদের আকার ও আকৃতির অনেক পরিবর্তন হয়। একটি আদর্শ ম্যাক্রোফেজের ব্যাস ১০-৩০ মাইক্রোমিটার হয় এবং একটি উৎকেন্দ্রিক ডিম্বাকৃতির বা বৃক্কাকার নিউক্লিয়াস থাকে। অধিকাংশ অঙ্গের যোজক কলাতেই ম্যাক্রোফেজ থাকে। ম্যাক্রোফেজকে দেহের ধাঙড় কোষ বলা হয়।[৩২]

প্রাকৃতিক মারণ কোষ

প্রাকৃতিক মারণ কোষ কর্মগত দিক দিয়ে সাইটোটক্সিক টি কোষের অনুরূপ। তবে, এদের মধ্যে লিম্ফোসাইটের আদর্শ বৈশিষ্ট্যাবলি অনুপস্থিত এবং অ্যান্টিজেনভিত্তিক সুনির্দিষ্ট রিসেপ্টর থাকে না। লিম্ফোসাইট-সদৃশ কোষগুলোর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক (সকল লিম্ফোসাইটের মধ্যে ৫-২০%) হলো প্রাকৃতিক মারণ কোষ এবং এদেরকে বৃহৎ দানাদার লিম্ফোসাইট শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৩৩] পরিপক্ক হওয়ার পর এদের সাইটোপ্লাজম মৃদু ক্ষারাকর্ষী হয়ে থাকে। এদের সাইটোপ্লাজমে রয়েছে রাইবোসোম, অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম এবং ঝিল্লি-বেষ্টিত ভেসিকল বা কোষথলি যার কেন্দ্র স্ফটিক তুল্য ও ব্যাস ২০০–৫০০ ন্যানোমিটার। এগুলোতে পারফোরিন (সাইটোলাইসিন) প্রোটিন থাকে, যা অভীষ্ট কোষসমূহের প্লাজমা ঝিল্লিতে গর্ত তৈরি করতে সক্ষম। এ-ছাড়া এতে গ্র‍্যানজাইম (সেরিন প্রোটিয়েজ) নামক উৎসেচক রয়েছে, যা অ্যাপোপটোসিস প্রক্রিয়ায় অভীষ্ট কোষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। অভীষ্ট কোষসমূহকে হনন করতে বিবিধ বস্তুর দ্বারা প্রাকৃতিক মারণ কোষগুলো সক্রিয় হয়। এরা অ্যান্টিবডি আস্তরযুক্ত অভীষ্ট কোষসমূহকে চিনতে ও হত্যা করতে পারে। এই কৌশলকে অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট সেল মিডিয়েটেড সাইটোটক্সিসিটি (প্রতিরক্ষিকা নির্ভরশীল কোষ মধ্যস্থতাকৃত কোষবিষাক্ততা) বলে।[২৪]

প্লাজমা কোষ

প্লাজমা কোষ হলো লিম্ফোসাইট (বি কোষ) থেকে উদ্ভূত অ্যান্টিবডি উৎপাদনকারী কোষ। প্লাজমা কোষগুলো অপেক্ষাকৃত বৃহৎ, ডিম্বাকৃতির হয় এবং এদের ক্ষারাকর্ষী সাইটোপ্লাজমে প্রচুর অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম ও নিউক্লিয়াসের নিকটে একটি বৃহৎ গলজি বস্তু থাকে। প্লাজমা কোষের নিউক্লিয়াস বর্তুলাকার কিন্তু উৎকেন্দ্রিক। এ-সব নিউক্লিয়াসের অনেকগুলোতেই পরপর প্রান্তীয় ঘন হিটারোক্রোমাটিন অঞ্চল ও হালকা ইউক্রোমাটিন অঞ্চল বিদ্যমান। অধিকাংশ যোজক কলাতে ন্যূনপক্ষে কিছু প্লাজমা কোষ থাকে।এদের গড় জীবৎকাল মাত্র ১০-২০ দিন।[৩২] প্লাজমা কোষকে অ্যান্টিবডির কারখানা বলা হয়। কিছু প্লাজমা কোষ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২,০০০ সংখ্যক অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করতে পারে। এরকম বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টার দরুন প্লাজমা কোষ বেশিদিন বাঁচতে পারে না।[৩৪]

নিবদ্ধ শ্বেতকণিকা

HSC=হিমাটোপয়েটিক স্টেম সেল, Progenitor=প্রোজেনিটর কোষ, L-blast=লিম্ফোব্লাস্ট, লিম্ফোসাইট, Mo-blast=মনোব্লাস্ট, মনোসাইট, মায়েলোব্লাস্ট, Pro-M=প্রোমায়েলোসাইট, মায়েলোসাইট, Meta-M=মেটামায়েলোসাইট, নিউট্রোফিল, ইওসিনোফিল, বেসোফিল, Pro-E=প্রো-ইরিথ্রোব্লাস্ট, Baso-E=বেসোফিলিক ইরিথ্রোব্লাস্ট, poly-E=পলিক্রোমাটিক ইরিথ্রোব্লাস্ট, Ortho-E=অর্থোক্রোমাটিক ইরিথ্রোব্লাস্ট, ইরিথ্রোসাইট, প্রোমেগাক্যারিওসাইট, মেগাক্যারিওসাইট, অণুচক্রিকা

কিছু শ্বেতকণিকা রক্তে না থেকে টিসুতে পরিভ্রমণ করে সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। কোন টিসুতে স্থায়ী হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে তাদের সুনির্দিষ্ট নাম রয়েছে, যেমন যকৃতে নিবদ্ধ ম্যাক্রোফেজ কুপফার কোষ নামে পরিচিত। এই কোষগুলো তখনও অনাক্রম্যতন্ত্রে ভূমিকা রাখে।

  • হিস্টিওসাইট: এটি এককেন্দ্রক খাদক কোষ ব্যবস্থা বা মনোনিউক্লিয়ার ফ্যাগোসাইট সিস্টেমের একটি অংশ। হিস্টিওসাইট বা কলাকোষ প্রকৃতপক্ষে একটি টিসু ম্যাক্রোফেজ[৩৫] বা ডেনড্রিটিক কোষ।[৩৬]
  • ডেনড্রিটিক কোষ: এরা সহজাত প্রতিরক্ষা ও অর্জিত প্রতিরক্ষার মধ্যে বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে, এদের প্রধান কাজ টি-কোষের কাছে অ্যান্টিজেন (প্রতিজন) উপস্থাপন করা। যে-সকল টিসু দেহের বাহ্যিক পরিবেশের সংস্পর্শে থাকে যেমন ত্বক (যেখানে ল্যাঙ্গারহ্যান্স কোষ নামে বিশেষায়িত ডেনড্রিটিক কোষ থাকে), নাকের অভ্যন্তরীণ আবরণী কলা, ফুসফুস, পাকস্থলী, ও অন্ত্রে ডেনড্রিটিক কোষ বিদ্যমান। রক্তে অপরিপক্ক অবস্থায় এদের পাওয়া যেতে পারে। একবার সক্রিয় হলে এরা লসিকাগ্রন্থিতে পরিভ্রমণ করে।[২]
  • মাস্ট কোষ: মাস্ট কোষ (পৃথুল কোষ) হলো যোজক কলার অনিয়তাকার বা ডিম্বাকৃতির কোষ, যার ব্যাস ৭-২০ মাইক্রোমিটার। এদের সাইটোপ্লাজমে ক্ষারাকর্ষী ক্ষরণমূলক দানা বিদ্যমান যা প্রায়শই কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াসকে আড়াল করে দেয়। এই দানাগুলো ইলেকট্রন ডেন্স এবং বিবিধ আকারের (এদের ব্যাস ০.৩-২.০ μm) হয়। মাস্ট কোষের দানাগুলোর সালফারযুক্ত গ্লাইকোস্যামিনোগ্লাইক্যান্সে অধিক পরিমাণে অম্লীয় মূলক থাকায় এগুলো মেটাক্রোমেজিয়া বা খলরঞ্জন প্রদর্শন করে, যার অর্থ হচ্ছে তারা কিছু ক্ষারীয় রঞ্জকের (যেমন, টলুইডিন ব্লু) বর্ণ নীল থেকে অরুণ বা লাল বর্ণে পরিবর্তন করতে পারে। ম্যাক্রোফেজের মতো মাস্ট কোষও অস্থিমজ্জার প্রোজেনিটর বা প্রজনিকা কোষ থেকে উৎপত্তি লাভ করে এবং রক্তে প্রবাহিত হয়ে উপশিরা নামক ক্ষুদ্র বাহিকার প্রাচীর ভেদ করে যোজক কলায় প্রবেশ করে, যেখানে তাদের সংপরিবর্তন বা বিভেদন ঘটে। যদিও মাস্ট কোষ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বেসোফিলের অনুরূপ, তথাপি তাদের উৎপত্তি ভিন্ন।[৩২]
  • মাইক্রোগ্লাইয়া: মাইক্রোগ্লাইয়া হলো ক্ষুদ্র ডেনড্রিটিক কোষ যা অক্ষিপটসহ সমগ্র কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে বিদ্যমান। ভ্রুণীয় মনোসাইট বা এর পূর্বগ কোষ থেকে মাইক্রোগ্লিয়ার উৎপত্তি বলে মনে করা হয়; জন্মের পূর্বে রক্তোৎপাদী কোষগুলো স্নায়ুর রক্তবাহিকার প্রাচীর ভেদ করে অ্যামিবয়েড কোষ হিসেবে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের টিসুতে ঢুকে পড়ে। মাইক্রোগ্লিয়া হলো সবচেয়ে ক্ষুদ্র নিউরোগ্লিয়া কোষ। মাইক্রোগ্লিয়া অনিয়তাকার হয়ে থাকে এবং গাঢ়ভাবে রঞ্জিত ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস প্রায় পুরো কোষকে পূর্ণ করে। মাইক্রোগ্লিয়ার কোষ প্রবর্ধগুলো সংখ্যায় অল্প, খাটো ও চিকন। কোষদেহ ও প্রবর্ধ উভয়ই ক্ষুদ্র কণ্টক দ্বারা আবৃত।

মাইক্রোগ্লিয়ার প্রধান কাজ যোজক কলার ম্যাক্রোফেজের মতো। স্নায়ুকলা আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে মাইক্রোগ্লিয়া উক্ত অঞ্চলে পরিভ্রমণ করে, সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় এবং ভক্ষককোষে পরিণত হয়ে মৃত বা বাহ্যিক টিসুকে অপসারণ করে। এটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের হোয়াইট ম্যাটার (শ্বেত পদার্থ) ও গ্রে ম্যাটার (ধূসর পদার্থ) উভয় ধরনের টিসুতেই থাকে এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান ভক্ষককোষ।[৩৭]


শ্বেতকণিকার কাজ

সাধারণত, শ্বেতকণিকা দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কণিকাসমূহ আক্রমণকারী জীবাণু বা বাহ্যিক বস্তুকে ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয় করে দেহকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে। তবে, প্রতিরক্ষা কাজে প্রতিটি ধরনের শ্বেতকণিকা পৃথক পদ্ধতিতে কাজ করে।[৯]

নিউট্রোফিল

নিউট্রোফিল দেহের প্রতিরক্ষা কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিউট্রোফিল ও মনোসাইট উভয়েই আক্রমণকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে দেহের প্রথম সারির প্রতিরক্ষা কোষ হিসেবে কাজ করে। নিউট্রোফিল হলো দেহের মুক্ত কোষ এবং এরা টিসুর মধ্য দিয়েও মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে, বাস্তবিকপক্ষে দেহের কোনো অংশই এই শ্বেতকণিকা থেকে মুক্ত নয়।[৯] এদের কাজ হলো অণুজীবদের মেরে ফেলা, টিসুর মধ্য দিয়ে কোষসমূহের পরিবহণ সহজতর করা ও প্রতিরক্ষায় সাড়াদান বাড়ানো। এ-সকল কাজগুলো দানার মধ্যে অবস্থিত উৎসেচকের মাধ্যমে হয়ে থাকে, যেগুলো অণুজীবদের হত্যার ও অবক্ষয়ের অন্তঃকোষীয় পরিবেশ প্রদান করে। দুই প্রধান ধরনের দানা রয়েছে: প্রাথমিক বা অ্যাজুরোফিল (নভোনীল) দানা ও গৌণ বা সুনির্দিষ্ট দানা (সংখ্যায় বেশি)। প্রাথমিক দানাতে রয়েছে মায়েলোপার‌অক্সিডেজ ও অন্যান্য উৎসেচক যা গলাধঃকরণকৃত অণুজীবদের অন্তঃকোষীয় হত্যা ও পরিপাকের জন্য জরুরি। গৌণ দানাগুলো ক্ষুদ্রতর এবং লাইসোজাইম, কোলাজিনেজ ও ল্যাক্টোফেরিন ধারণ করে, যেগুলোকে বহিঃকোষীয় ফাঁকা স্থানে অবমুক্ত করা যেতে পারে। সংক্রমণের। সংক্রমণের প্রতি সাড়াপ্রদানের ফলে উৎসেচক উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়, অণুবীক্ষণযন্ত্রে দানাগুলো অনেক বেশি রঞ্জিত দেখায় যা 'টক্সিক গ্র‍্যানুলেশন' বা বিষাক্ত দানাভবন নামে পরিচিত।[৩৮] নিউট্রোফিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ফ্যাগোসাইটোসিস। ফ্যাগোসাইটোসিস খুবই নৈর্বাচনিক প্রক্রিয়া। কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য ফ্যাগোসাইটোসিসের সুযোগ বাড়িয়ে দেয়। টিসুর অধিকাংশ প্রাকৃতিক গঠনে মসৃণ উপরিতল থাকায় ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদান করে; যদি উপরিতল অমসৃণ হয়, ফ্যাগোসাইটোসিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দেহে প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হওয়া অধিকাংশ পদার্থেই প্রতিরক্ষামূলক প্রোটিন আস্তর থাকে যা ভক্ষক কোষগুলোকে বিতাড়িত করে। মৃত কোষসমূহ ও অধিকাংশ বাহ্যিক বস্তুতে প্রায়শই কোনো প্রতিরক্ষামূলক আস্তর নেই, যা তাদেরকে ফ্যাগোসাইটোসিস-প্রবণ করে তুলে।[৩]

ইওসিনোফিল

পরজীবী সংক্রমণে প্রচুর সংখ্যক ইওসিনোফিল উৎপাদিত হয় এবং পরজীবী আক্রান্ত টিসুতে পরিভ্রমণ করে। পরজীবীসমূহ আকারে অনেক বৃহৎ হওয়ায় ইওসিনোফিল বা অন্যান্য কোষের পক্ষে ফ্যাগোসাইটোসিস করা কঠিন হলেও, ইওসিনোফিল বিশেষ পৃষ্ঠতলীয় অণুসমূহের সাহায্য নিয়ে নিজেদেরকে পরজীবীর সাথে সংযুক্ত করে এবং বিশেষ কিছু পদার্থ (যেমন, আর্দ্রবিশ্লেষী উৎসেচক, অক্সিজেনের বিক্রিয়ামূলক ধরণ, মেজর বেসিক প্রোটিন নামক লার্ভানাশক পলিপেপটাইড) অবমুক্ত করে অনেক পরজীবীকে হত্যা করে।[১০] পরজীবী সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়াও ইওসিনোফিলের আরেকটি প্রবণতা হলো যে-সকল টিসুতে অ্যালার্জিজনিত বিক্রিয়া হয়, সেখানে জড়ো হওয়া। বেসোফিল ও মাস্ট কোষ (পৃথুল কোষ) থেকে নির্গত হওয়া কেমোট্যাক্টিক বস্তুর কারণে প্রদাহযুক্ত অ্যালার্জিক টিসুতে ইওসিনোফিল পরিভ্রমণ করে। ইওসিনোফিল মাস্ট কোষ ও বেসোফিল থেকে নির্গত কিছু প্রদাহ-সৃষ্টিকারী বস্তুকে বিনষ্ট করে এবং অ্যালার্জেন-অ্যান্টবডি যৌগকে ধ্বংস করে, এভাবে প্রদাহমূলক প্রক্রিয়ার বিস্তৃতি রোধ করে।[৩৮] ইওসিনোফিল কেমোকাইন, সাইটোকাইন ও লিপিড মিডিয়েটর নির্গত করে অ্যালার্জিজনিত প্রদাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।[৩৯] এ-সকল কারণে কৃমি সংক্রমণ ও অ্যালার্জিতে ইওসিনোফিল সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এরা অন্ত্রীয় রস থেকেও ফ্যাগোসাইটোসিসের মাধ্যমে অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি যৌগ অপসারণ করতে পারে।[১৯]

বেসোফিল ও মাস্ট কোষ

বেসোফিল ও মাস্ট কোষ উভয়ই অস্থিমজ্জা থেকে উদ্ভূত হয় এবং অ্যালার্জিজনিত রোগে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। মাস্ট কোষ মূলত এমন টিসুতে বাস করে যেগুলো বাহ্যিক পরিবেশের সংস্পর্শে আসে, যেমন ত্বক ও অন্ত্র; অন্যদিকে বেসোফিল প্রান্তীয় রক্ত সংবহনে অবস্থান করে এবং প্রদাহ ঘটলে টিসুতে চলে আসে। উভয় কোষেই বৃহৎ সাইটোপ্লাজমীয় দানা রয়েছে। উভয়ই বৃহৎ সাইটোপ্লাজমীয় দানা ধারণ করে, যাতে ভেজো‌অ্যাকটিভ (বাহ-নিয়ন্ত্রক) পদার্থ যেমন হিস্টামিন ও কিছু অল্প পরিমাণ ব্র‍্যাডিকাইনিন ও সেরোটোনিন রয়েছে, যেগুলো প্রদাহমূলক প্রক্রিয়ায় অবদান রাখে। এ-ছাড়া মাস্ট কোষ ও বেসোফিল থেকে হেপারিন নির্গত হয়, যা রক্ত তঞ্চন প্রতিরোধ করে।[৩] বেসোফিল ও মাস্ট কোষের পৃষ্ঠতলে ইমিউনোগ্লোবিউলিন-ই (IgE) রিসেপ্টর রয়েছে যা ইমিউনোগ্লোবিউলিন-ই অ্যান্টিবডির সাথে যুক্ত হয়। এই বন্ধনের ফলে বেসোফিল ও মাস্ট কোষ বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং প্রচুর পরিমাণে দানাতে বিদ্যমান হিস্টামিন, ব্র‍্যাডিকাইনিন, সেরোটোনিন, হেপারিন, লাইসোসোমাল উৎসেচক ও অ্যানাফিল্যাক্সিস বা অতিসংবেদ্যতা সৃষ্টিকারী ধীরগতির বিক্রিয়ক পদার্থসমূহ নির্গত হয়।[৩] এর ফলে একটি প্রদাহমূলক বিক্রিয়া প্রপাত শুরু হয় যার ফলে স্থানিক রক্তপ্রবাহ ও রক্তনালির ভেদ্যতা বৃদ্ধি পায়, মসৃণ পেশির সংকোচন উদ্দীপিত হয় ও শ্লৈষ্মিক পৃষ্ঠতলে ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়।[৩৮]

মনোসাইট ও ম্যাক্রোফেজ

রক্তের মনোসাইটসমূহ হলো অপরিপক্ক কোষ যার সংক্রমণকারী বস্তুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সক্ষমতা খুব বেশি নেই। একবার টিসুতে প্রবেশ করার পর পরিপক্কতা লাভ করে টিসু ম্যাক্রোফেজে পরিণত হয় যেগুলো রোগসৃষ্টিকারী বস্তুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অত্যন্ত সক্ষম।[১০] ম্যাক্রোফেজের আকার খুবই বৈচিত্র্যময় (সাধারণত ১৫–২৫ μm) হয়ে থাকে।[২৪] টিসু ম্যাক্রোফেজ হলো আক্রমণকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রথম সারির প্রতিরক্ষা কোষ। প্রদাহ শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে, টিসুতে উপস্থিত ম্যাক্রোফেজসমূহ তাৎক্ষণিকভাবে কোষভক্ষণ ক্রিয়া শুরু করে দেয়। অনেক স্থাণু ম্যাক্রোফেজ কেমোট্যাক্টিক বস্তুর প্রভাবে তাদের সংযুক্তি থেকে আলগা হয়ে চলিষ্ণু হয়ে যায়। এ-সকল ম্যাক্রোফেজ প্রদাহ অঞ্চলে পরিভ্রমণ করে তাদের অবদান রাখে।[৩]

অনাক্রম্যতন্ত্র দ্বারা সক্রিয় হওয়ার পর তারা নিউট্রোফিলের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী ভক্ষককোষে পরিণত হয়, প্রায়শই ১০০-এর সমান ব্যাকটেরিয়াকে ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় ভক্ষণ করতে পারে। এদের অনেক বৃহত্তর কণাকেও গ্রাস করার সক্ষমতা আছে, এমনকি পুরো লোহিত রক্তকণিকা বা কখনো কখনো ম্যালেরিয়া পরজীবীকেও গ্রাস করতে পারে; অন্যদিকে নিউট্রোফিল ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে বৃহত্তর কণাকে গ্রাস করতে সক্ষম না। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, ম্যাক্রোফেজসমূহ গ্রাসকৃত কণাগুলো পরিপাকের পর অবশিষ্টাংশগুলো নিজের দেহ থেকে বাইরে বের করে আরও অনেক মাস বেঁচে থেকে কাজ সম্পাদন করতে পারে।[১০]

লিম্ফোসাইট

লিম্ফোসাইটসমূহ দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে লিম্ফোসাইট কে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়, যেমন টি লিম্ফোসাইট ও বি লিম্ফোসাইট। টি কোষ কোষীয় অনাক্রম্যতা এবং বি কোষ হিউমোরাল অনাক্রম্যতা প্রদান করে।[৯]

প্রাকৃতিক মারণ কোষ

প্রাকৃতিক মারণ কোষ হলো বৃহৎ দানাদার লিম্ফোসাইট যা অর্বুদ ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। এরা অর্জিতসহজাত উভয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাতেই কাজ করে। এরা অঙ্গসংস্থানিকভাবে লিম্ফোসাইটের মতো এবং একই ধরনের লিগ্যান্ডকে চিনতে পারে, কিন্তু এদের কার্যক্রম নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিজেনের সাথে সম্পর্কযুক্ত না এবং অনাক্রম্যতন্ত্রসংক্রান্ত কোনো স্মৃতি গঠন করতে পারে না।[৩৮]

রোগসমূহ

শ্বেতকণিকার রোগসমূহকে প্রধানত দুটি তালিকায় বিভক্ত করা যায়, কোষের সংখ্যা-বৃদ্ধিজনিত রোগ যা লিউকোসাইটোসিস (শ্বেতিকাধিক্য) নামে পরিচিত এবং কোষের সংখ্যাল্পতাজনিত রোগ যা লিউকোপিনিয়া (শ্বেতিকাস্বল্পতা) নামে পরিচিত।[৪০] লিউকোসাইটোসিস সাধারণত উপকারী (যেমন, সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই), কিন্তু কখনো কখনো সাধারণ অবস্থার ব্যত্যয় ঘটিয়ে শ্বেতকণিকার অস্বাভাবিক সংখ্যবৃদ্ধি ঘটে। শ্বেতকণিকার এই সংখ্যাবৃদ্ধিমূলক রোগ কে মায়েলোপ্রোলিফারেটিভ ও লিম্ফোপ্রোলিফারেটিভ রোগ নামে দুটি শেণিতে ভাগ করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে অটোইমিউনিটির কারণে হয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্যান্সারের কারণে এমন হতে পারে। অধিকন্তু, এমন কিছু রোগ আছে যেখানে শ্বেতকণিকার সংখ্যা স্বাভাবিক কিন্তু কণিকাসমূহ স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না।[৪১] শ্বেতকণিকার ক্যান্সার নিরীহ হতে পারে তবে প্রায়শই সংহারক হয়।

লিউকোপিনিয়া

প্রবহমান শ্বেতকণিকার মোট সংখ্যা হ্রাস পাওয়াকে লিউকোপিনিয়া (শ্বেতিকাস্বল্পতা) বলা হয়। এটি সকল প্রকার শ্বেতকণিকা হ্রাস পেলেও হতে পারে অথবা উপধরনগুলোর যে-কোনোটির (সাধারণত নিউট্রোফিল বা লিম্ফোসাইট) হ্রাস হলেও হতে পারে।[৪০] লিউকোপিনিয়ার ফলে দেহ অনেক ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য টিসু আক্রমণকারী বস্তু থেকে অরক্ষিত হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে, মানব দেহ অনেক ব্যাকটেরিয়ার সাথে সিমবায়োসিস বা মিথোজীবিতা প্রদর্শন করে কারণ দেহের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি অনবরত অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে আসে। মুখবিবরে বিভিন্ন স্পাইরোকিটাল, নিউমোকক্কাল ও স্ট্রেপ্টোকক্কাল ব্যাকটেরিয়া থাকে, আবার একই ব্যাকটেরিয়া কিছুটা অল্প পরিমাণে সমগ্র শ্বসন নালিতে থাকে। দূরবর্তী পরিপাক নালি কোলন ব্যাসিলাই দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। অধিকন্তু, চোখ, মূত্রনালি ও যোনির পৃষ্ঠতলেও ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। শ্বেতকণিকার সংখ্যা হ্রাস পেলে তাৎক্ষণিকভাবে টিসুগুলো সেখানে পূর্ব হতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। অস্থিমজ্জা শ্বেতকণিকার উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ার দুই দিনের মধ্যে মুখে ও কোলনে ঘা হতে পারে অথবা গুরুতর শ্বসনতন্ত্রের প্রদাহ দেখা দিতে পারে। ঘা থেকে ব্যাকটেরিয়া সন্নিহিত টিসুগুলোকে খুব দ্রুত আক্রান্ত করে এবং সংক্রমণ রক্তে ছড়িয়ে যায়। তীব্র লিউকোপিনিয়া শুরু পর চিকিৎসা না করলে এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে।[১০]

নিউট্রোপিনিয়া

নিউট্রোফিলের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় হ্রাস পাওয়াকে (সাধারণত <১.৫ × ১০/L কিন্তু বয়স ও জাতিগোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল) নিউট্রোপিনিয়া বলে। নিউট্রোপিনিয়া যেমন উপসর্গবিহীন হতে পারে, তেমনি ব্যাপক সেপসিস বা জীবাণুদূষণও হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি নিউট্রোপিনিয়ার মাত্রার উপর নির্ভর করে। নিউট্রোফিল সংখ্যা <০.৫ × ১০/L কে মারাত্মক রকমের কম বলে বিবেচনা করা হয়। জ্বর হলো সংক্রমণের প্রথম ও অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র প্রকাশ। গলাব্যথা, পায়ুপথের চারিদিকে ব্যথা অথবা ত্বকে প্রদাহ দেখা দিতে পারে। রক্তে নিউট্রোফিলের ঘাটতি দেখা দিলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা শুরু করতে হয় নতুবা সেপটিসেমিয়া (রক্তদুষ্টি) হতে পারে।[৪১][৩০] নিউট্রোপিনিয়া অর্জিত বা অন্তর্নিহিত উভয় কারণেই হতে পারে।[৪২] ল্যাবোরেটরি পরীক্ষায় নিউট্রোফিল সংখ্যা কম হতে পারে হয় নিউট্রোফিলের উৎপাদন কম হওয়ার জন্য অথবা রক্ত থেকে নিউট্রোফিলের অপসারণ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য।[৪০] নিচে নিউট্রোপিনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো:

  • ওষুধ - কেমোথেরাপি, অ্যন্টিবায়োটিক যেমন সালফোনামাইড, পেনিসিলিন, সেফালোস্পোরিন ইত্যাদি, অ্যান্টি-থাইরয়েড ওষুধ (কার্বিমাজোল, প্রোপিলথায়োইউরাসিল), ব্যথানাশক/প্রদাহরোধী ওষুধ (ন্যাপ্রক্সেন, পেনিসিলামিন, গোল্ড), আক্ষেপ-রোধক ওষুধ (ফেনিটয়েন, সোডিয়াম ভ্যালপ্রোয়েট, কার্বামেজিপিন), অ্যান্টি-অ্যারিদ্মিক (কুইনিডিন, প্রোকেনামাইড), উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ (নাইফেডিপিন, ক্যাপটোপ্রিল, এনালাপ্রিল), ম্যালেরিয়ানাশক (পিরিমেথামিন, ক্লোরোকুইন, সালফাডক্সিন, ড্যাপসোন), বিবিধ (রেনিটিডিন, সাইমেটিডিন)।
  • অস্থিমজ্জা অনুপ্রবেশ- লিউকেমিয়া (শ্বেতিকাকর্কট), মায়েলোডিসপ্লেজিয়া (সুপ্ত দ্বিধামেরু)
  • জন্মগত- কস্টম্যান সিনড্রোম, শেডিয়াক-হিগাশি সিনড্রোম
  • জাতিগোষ্ঠীগত- আফ্রিকান ক্যারিবীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের বংশোদ্ভূত


লিম্ফোসাইটোপিনিয়া

মোট লিম্ফোসাইট সংখ্যা <১.০x১০/L হলে তাকে লিম্ফোসাইটোপিনিয়া বা লিম্ফোপিনিয়া বলে। CD4+ টি কোষ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। নিউট্রোপিনিয়ার মতো লিম্ফোপিনিয়া অর্জিত বা অন্তর্নিহিত উভয় কারণেই হতে পারে।[৪১] যদিও অল্প পরিমাণ কমলে কোনো উপসর্গ নাও প্রকাশ পেতে পারে, তথাপি সেল-মিডিয়েটেড ইমিউনিটিতে ঘাটতি দেখা দিলে সংক্রমণ হতে পারে (ছত্রাক, ভাইরাস, মাইকোব্যাক্টেরিয়া প্রভৃতি জীবাণু দ্বারা), এবং লিম্ফোয়েড ও অন্যান্য ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় (বিশেষ করে কিছু ভাইরাস সংক্রমণ যেমন এপস্টাইন-বার ভাইরাস (EBV), হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (HPV) ও হিউম্যান হার্পিসভাইরাস ৮ (HHV-8))। বয়স বাড়লে দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াও লিম্ফোপিনিয়া হতে পারে। নিচে লিম্ফোপিনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো:

  • প্রদাহ - যোজক কলার রোগ
  • লিম্ফোমা (লসিকার্বুদ)
  • বৃক্কীয় বৈকল্য
  • সারকোইডোসিস (মাংসাভ অর্বুদ)
  • জন্মগত – সিভিয়ার কম্বাইন্ড ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি (গুরুতর সমন্বিত অনাক্রম্য ঘাটতি)।


সংখ্যাবৃদ্ধিমূলক রোগ

সংবহনতন্ত্রে শ্বেতকণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পেলে তাকে লিউকোসাইটোসিস (শ্বেতিকাধিক্য) বলে[৪০] এই বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ঘটে প্রদাহজনিত কারণে।[৪০] চারটি প্রধান কারণ রয়েছে: অস্থিমজ্জাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, অস্থিমজ্জার সঞ্চয় থেকে বেশি পরিমাণে অবমুক্ত হওয়া, ধমনি ও শিরাতে সংযুক্তির পরিমাণ হ্রাস পাওয়া, টিসুতে অনুপ্রবেশ কমে যাওয়া।[৪০] লিউকোসাইটোসিস হলে এক বা একাধিক ধরনের কোষ আক্রান্ত হতে পারে, যেমন নিউট্রোফিলিয়া, ইওসিনোফিলিয়া, বেসোফিলিয়া, মনোসাইটোসিস বা লিম্ফোসাইটোসিস।

নিউট্রোফিলিয়া

সংবহনতন্ত্রে নিউট্রোফিল সংখ্যার বৃদ্ধিকে নিউট্রোফিলিয়া বা নিউট্রোফিল লিউকোসাইটোসিস বলে। অস্থিমজ্জাতে কোষের উৎপাদন বৃদ্ধি বা প্রান্তীয় সঞ্চয় থেকে কোষসমূহের পুনর্বন্টনের ফলে এই সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে পারে। স্বাভাবিক নিউট্রোফিল সংখ্যা বয়স, জাতিগোষ্ঠী ও শারীরিক কিছু বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। গর্ভধারণের সময় কেবল নিউট্রোফিল বাড়ে তা নয়, বরং এর প্রাথমিক রূপ, যেমন মেটামায়েলোসাইটসমূহও রক্তে দেখা যেতে পারে।[৩০] এ-ছাড়াও ব্যায়াম, ধূমপান ও কর্টিকোস্টেরয়েড প্রদানের পর নিউট্রোফিল বাড়তে পারে। টিসু নেক্রোসিস বা কলামৃত্যুর পর বিবিধ দ্রাব্য বস্তু অবমুক্ত হয়, যেগুলো লিউকোসাইট সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। টিসু নেক্রোসিসের ফলে ‘’ইন্টারলিউকিন ১’’ অবমুক্ত হয় এবং জ্বর ঘটায়। হার্ট অ্যাটাকের পর জ্বর ও লিউকোসাইটোসিস হওয়ার একটি ভালো উদাহরণ এটি এবং প্রায়শই সংক্রমণ ভেবে ভুল করা হয়।[৩১] নিম্নে নিউট্রোফিলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কছু কারণ উল্লেখ করা হলো:

প্রাথমিক কারণসমূহ[৪৩]
  • স্বাভাবিক ক্রিয়াশীল নিউট্রোফিল – বংশগতীয় নিউট্রোফিলিয়া, ক্রনিক ইডিওপ্যাথিক নিউট্রোফিলিয়া (দীর্ঘস্থায়ী স্বয়ম্ভুত নিউট্রোফিলিয়া)
  • পেলজার-হিউয়েট অ্যনোম্যালি
  • শ্বেতকণিকা আসঞ্জন ঘাটতি
  • পারিবারিক ঠাণ্ডা ছুলি বা কোল্ড আর্টিকেরিয়া
  • মায়েলোপ্রোলিফারেটিভ (মজ্জাবর্ধক) রোগ – ক্রনিক মায়েলোজিনাস লিউকেমিয়া (দীর্ঘস্থায়ী মজ্জাগত শ্বেতিকাকর্কট), পলিসাইথিমিয়া বা লালিকাধিক্য
  • প্লীহাকর্তন[৪৪]
গৌণ কারণসমূহ[৪৩]
  • দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহগেঁটে বাত, রিউমাটোয়িড আর্থ্রাইটিস (সন্ধিবাত), আলসারেটিভ কোলাইটিস (ঘা-কারক মলান্ত্রপ্রদাহ), ক্রন’স ডিজিজ
  • সিগারেট ধূমপান – ২৫–৫০% দীর্ঘমেয়াদি ধূমপায়ীদের হয় এবং ধূমপান ছাড়ার পরও ৫ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে।
  • পীড়ন – অস্ত্রোপচার, আঘাত, অগ্নিক্ষত
  • ওষুধ – কর্টিকোস্টেরয়েড, বিটা-অ্যাগোনিস্ট, লিথিয়াম
  • ক্যান্সার – হজকিন লিম্ফোমা, অর্বুদ দ্বারা ক্ষরিত বৃদ্ধি ফ্যাক্টর
  • শারীরবৃত্তীয় – কায়িকশ্রম বা ব্যায়াম, গর্ভধারণ
  • প্রান্তীয় সংবহনে রক্তকণিকা বেশি পরিমাণে ধ্বংস্প্রাপ্ত হলে অস্থিমজ্জা উদ্দীপনা পায়। হিমোলাইটিক বা লালিকানাশক রক্তশূন্যতা ও ইডিয়োপ্যাথিক থ্রম্বোসাইটোপিনিক পারপুরাতে (স্বয়ম্ভুত অণুচক্রিকাস্বল্পতাহেতু ধূম্ররোগ) এমন হতে পারে।


ইওসিনোফিলিয়া

স্বাভাবিক ইওসিনোফিল সংখ্যা হলো ০.৬৫×১০/L-এর কম।[৪১] নবজাতকে ইওসিনোফিল সংখ্যা বেশি থাকে এবং বয়স, সময় (সকালে কম ও রাতে বেশি), ব্যায়াম, পরিবেশ ও অ্যালার্জিকারক বস্তুর সংস্পর্শে আসার উপর নির্ভর করে।[৪১] ইওসিনোফিলিয়া স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়, তাই সর্বদা অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধানের উপর গুরুত্ব দিতে হবে, যদিও সবসময় প্রকৃত কারণ খুঁজে নাও পাওয়া যেতে পারে।[৪১] ইওসিনোফিলের অনুপ্রবেশ অনেক অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে (যেমন হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, পরিপাক নালি, ত্বক, পেশিকঙ্কালতন্ত্র), তাই ইওসিনোফিলিয়ার মূল্যায়নে কেবল অন্তর্নিহিত কারণ শনাক্তকরণ ও এর যথোপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানই নয়, বরং কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা উচিত।[৩০] ইওসিনোফিলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • অ্যালার্জি – হেই ফিভার বা অ্যালার্জিজনিত নাসাপ্রদাহ, হাঁপানি, একজিমা বা বিখাউজ
  • সংক্রমণ – পরজীবী
  • ওষুধ অতিপ্রতিক্রিয়া – সালফোনামাইড, গোল্ড
  • রক্তবাহপ্রদাহ – ইওসিনোফিলিক গ্র্যানুলোম্যাটোসিস উইদ পলিঅ্যানজিয়াইটিস (চার্গ-স্ট্রাউস সিনড্রোম), গ্র্যানুলোম্যাটোসিস উইদ পলিঅ্যানজিয়াইটিস (ভেগানার’স গ্র্যানুলোম্যাটোসিস)
  • যোজক কলার রোগ – পলিআর্টারাইটিস নোডোসা (গ্রন্থিল ধমনি প্রদাহ)
  • ক্যান্সার – শক্ত অর্বুদ, লিম্ফোমা (লসিকার্বুদ)
  • প্রাথমিক অস্থিমজ্জা রোগ – মায়েলোপ্রোলিফারেটিভ রোগ, হাইপারইওসিনোফিলিক সিনড্রোম, অ্যাকিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া

লিম্ফোসাইটোসিস

রোগীর বয়স অনুযায়ী প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে বেশি সংখ্যক লিম্ফোসাইট রক্তে বৃদ্ধি পেলে তাকে লিম্ফোসাইটোসিস বলে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি >৩.৫ × ১০/L হতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে লিম্ফোসাইট সংখ্যা বেশি থাকে।[১২] লিম্ফোসাইট সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ভাইরাস সংক্রমণ।[৩০] লিম্ফোসাইটোসিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • লিম্ফোপ্রোলিফারেটিভ রোগ – ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা (লসিকার্বুদ)
  • প্লীহাকর্তনের পর


আরও দেখুন

  • রক্তোৎপাদী মাতৃকোষ



তথ্যসূত্র


বহিঃসংযোগ

  • Leukocytes যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় চিকিৎসা গ্রন্থাগারে চিকিৎসা বিষয়ক শিরোনাম (MeSH)


টেমপ্লেট:Blood

টেমপ্লেট:Lymphocytes

টেমপ্লেট:Immune system


🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী