রেডিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক মৌল। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৮৮। এই মৌলিক পদার্থটি আবিষ্কারের মাধ্যমেই প্রথম পারমাণবিক শক্তি সম্বন্ধে মানুষের ধারণা জন্মায়।
নামকরণ
রেডিয়াম মৌলটির ইংরেজি বানান Radium। লাতিন ভাষায় radius শব্দের অর্থ রশ্মি। এই শব্দ থেকেই রেডিয়াম শব্দটি এসেছে।
আবিষ্কারের ইতিহাস
পিচব্লেন্ডকে বিশ্লেষণ করার সময় মারি ক্যুরি, পিয়ের ক্যুরি এবং জি বেমন্ট দেখতে পান যে তাতে বিসমাথ ছাড়াও অধিক তেজস্ক্রিয় আরেকটি অংশ ছিল। পোলোনিয়াম নিষ্কাশনে সফলতা লাভের পর তারা এই অন্য অংশটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। তারা বুঝতে পারছিলেন যে অজানা অন্য একটি তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কৃত হয়ে যেতে পারে। ১৮৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর তারা এই নতুন মৌলটি আবিষ্কার করেন। রেডিয়ামের ধর্মের উপযুক্ত সংমিশ্রণের কারণে এর গবেষণা তুলনামূলক সহজ ছিল। তথাপি প্রথমবার আবিষ্কার করতে গিয়ে গবেষকদের যথেষ্ট ধকল পোহাতে হয়েছিল। বোহেমীয় খনি থেকে প্রাপ্ত ইউরেনিয়ামের অবশেষ নিয়ে ক্যুরির নেতৃত্বে গবেষকদল তাদের সরঞ্জামহীন গবেষণাগারে দীর্ঘ ৪৫ মাস কঠোর পরীশ্রম করেছিলেন। তারা প্রায় ১০,০০০ বার আংশিক কেলাসন করেন এবং অবশেষে বহু আকাঙ্ক্ষিত ০.১ গ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড প্রস্তুত করতে সমর্থ হন। এই পরিমাণটি তার আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর পরিমাপের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। মারি ক্যুরি ১৯০২ সালের ২৮ মার্চ বিবরণ পেশ করে বলেন রেডিয়ামের পারমাণবিক ভর ২২৫.৯ যা বর্তমান মান ২২৬.০২ থেকে খুব বেশি কম নয়। তারা এই ক্লোরাইড যৌগ থেকে রেডিয়াম পৃথক করেছিলেন। মারি ক্যুরি এবং তার সহগবেষক এ ডেবিয়ের্নে ০.১০৬ গ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড বিশিষ্ট দ্রবণকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করেন। এর ফলে পারদসঙ্কর হিসেবে পারদ ক্যাথোডে রেডিয়াম সঞ্চিত হয়। পারদসঙ্করটিকে লোহার পাত্রে নিয়ে হাইড্রোজেন প্রবাহিত করা হয় এবং একই সাথে উত্তপ্ত করা হয়। এতে সঙ্কর ধাতু থেকে পারদ মুক্ত হয়ে পাত্রের তলায় রূপার ন্যায় সাদা চকচকে ধাতুর মত জমা হয়। আর বিশুদ্ধ রেডিয়াম পৃথক হিসেবে পাওয়া যায়।
ক্যুরির গবেষকদল ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত প্যারিস একাডেমি অফ সাইন্সেস-এর কাছে একটি গবেষণাপত্র পেশ করে যার নাম ছিল "পিচব্লেন্ডে অবস্থিত অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়তা সম্পন্ন নতুন মৌল সম্বন্ধে" (On a new highly radioactive substance contained in pitchblend)। এই গবেষণাপত্র থেকে প্রথম জানা যায়, তারা ইউরেনিয়াম আকরিকের অবশেষ থেকে একটি নতুন পদার্থ নিষ্কাশন করতে সমর্থ হয়েছেন যাতে একটি নতুন মৌল আছে এবং এই নতুন মৌলের ধর্মের সঙ্গে বেরিয়ামের প্রচুর সাদৃশ্য আছে। বেরিয়াম ক্লোরাইডে উপস্থিত রেডিয়ামমের পরিমাণটি তার বর্ণালি লিপিবদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছিল। যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিতির এই প্রমাণটি করেছিলেন প্রখ্যাত ফরাসি বর্ণালি বিশ্লেষক ই ডিমার্কাই যিনি নিষ্কাশিত পদার্থটির বর্ণালিতে নতুন একটি রেখা লক্ষ্য করেছিলেন। এই রেখার বৈশিষ্ট্য থেকেই নতুন মৌলের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। এভাবে তেজস্ক্রিয়ামিতি এবং বর্ণালিবীক্ষণ উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে নতুন মৌলটির উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল।
অন্যান্য তেজস্ক্রিয় মৌলের তুলনায় রেডিয়াম আবিষ্কার ছিল বেশ সহজ কারণ এর বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট এবং অনন্য। তাই ভবিষ্যদ্বাণী করে রাখা আবিষ্কারগুলির মধ্যে এর আবিষ্কারকেই সর্বপ্রথম প্রতিপন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। এর পর আরও অনেক তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কৃত হতে থাকে এবং প্রতি বছর নব নব গবেষণাপত্র পেশ করা হতে থাকে। তেজস্ক্রিয় মৌলের মধ্যে রেডিয়ামকেই প্রথম ধাতব অবস্থায় প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছিল। এর আবিষ্কার বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলোর একটি। পদার্থের ধর্ম এবং গঠন বিষয়ে মানুষের সম্যক ধারণা অর্জনে এর অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়া রেডিয়াম মৌলটি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই প্রথম পারমাণবিক শক্তির ধারণাটি উদ্ভূত হয়। এছাড়া তেজস্ক্রিয় মৌলের প্রথম বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় রেডিয়ামকেই। একে ঔষধ প্রস্তুতি ব্যবহার করা হয়েছিল।
বৈশিষ্ট্যসমূহ
বেশ কিছু কারণে প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় মৌলগুলোর মধ্য রেডিয়ামের অর্ধায়ু বেশ দীর্ঘ দেখা গিয়েছিল। প্রায় ১৬০০ বছর। অবশ্য থোরিয়াম এবং ইউরেনিয়ামের এর থেকেও বেশি। এ দুটি ব্যতিক্রম। ইউরেনিয়ামের আকরিকগুলোতে পোলোনিয়ামের পরিমাণ থেকে রেডিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি, প্রায় ৪৩০০ গুণ বেশি। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই রেডিয়াম সঞ্চিত হতে পারে। রেডিয়ামের আলফা বিকিরণের তীব্রতা যথেষ্ট বেশি হওয়াতে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এর আচরণকেকাজে লাগানো যায়। রেডিয়ামের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এ থেকে তেজস্ক্রিয় গ্যাস নির্গত হয় যাকে প্রসর্গ নামে অভিহিত করা হয়। রেডিয়ামের এ সকল ধর্মের উপযুক্ত সংমিশ্রণের কারণে এ নিয়ে গবেষণা বেশ সুবিধাজনক। ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়ামের পর তাই রেডিয়ামই প্রথম প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় মৌল যা সহজেই পর্যায় সারণিতে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এর বিশেষ দুটি সুবিধা হল:
এর রাসায়নিক এবং বর্ণালি গবেষণায় দেখানো যায় এটি সকল বিষয়ে ক্ষারীয় মৃত্তিকা উপশ্রেণীর সদস্য।
এর আপেক্ষিক পারমাণবিক ভরটি যথেষ্ট নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যায়।
এই দুটি কারণেই এক সময় রেডিয়াম গবেষণা সহজ হয়ে গিয়েছিল এবং গবেষকরা এটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন প্রথম দিকেই।
তথ্যসূত্র
রাসায়নিক মৌল কেমন করে সেগুলি আবিষ্কৃত হয়েছিল - দ ন ত্রিফোনভ, ভ দ ত্রিফোনভ; অনুবাদ - কানাই লাল মুখোপাধ্যায়; মির প্রকাশন মসকো, মনীষা গ্রন্থালয় কলিকাতা।