হাগার
হাগার[১] (হিব্রু ভাষায়: הָגָר, Hāḡār;[২] আরবি: هَاجَر, প্রতিবর্ণীকৃত: Hājar; গ্রিক: Ἁγάρ, Hagár; লাতিন: Agar) হলেন বাইবেলের আদিপুস্তকের একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন সারার মিসরীয়া দাসী[৩] যিনি তাঁকে সন্তানধারণের জন্য আপন স্বামী অব্রাহামের সঙ্গে বিবাহ দেন। পরে হাগার অব্রাহামের নিমিত্তে পুত্রসন্তান প্রসব করেন। অব্রাহাম হাগারের গর্ভজাত আপনার সেই পুত্রের নাম রাখেন ইশ্মায়েল। ইশ্মায়েলকে ইশ্মায়েলীয় ও আরব জাতির পূর্বপুরুষ গণ্য করা হয়। বিভিন্ন ভাষ্যকার তাঁকে হাগারীয় (আগারের পুত্রগণ) জাতির সাথে সংযুক্ত করেছেন, সম্ভবত তারা দাবি করেছেন হাগার হলেন তাদের নামস্রোতীয় পূর্বসূরি।[৪][৫][৬][৭]
হাগার הָגָר | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | |
অন্যান্য নাম | হাজেরা (আরবি: هَاجَر) |
পেশা | গৃহিণী |
দাম্পত্য সঙ্গী | অব্রাহাম |
সন্তান | ইশ্মায়েল (অব্রাহামের পুত্র) |
আত্মীয় |
|
মিসরীয়া দাসী হাগারের নাম আদিপুস্তকে নথিভুক্ত রয়েছে; তিনি সকল অব্রাহামীয় ধর্মে স্বীকৃত। মূলধারার খ্রিস্টধর্মে তাঁকে অব্রাহামের উপপত্নী হিসেবে দেখা হয়।[৩] কুরআনে হাগারের উল্লেখ রয়েছে এবং ইসলাম তাঁকে ইব্রাহিমের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ইসলামি ঐতিহ্য অনুসারে, হাজেরাকে আরব জাতির মাতা এবং তাঁর স্বামী ইব্রাহিমকে আরব জাতির পিতা হিসেবে অবিহিত করা হয়েছে।
আদি পুস্তকে হাজেরা
এটি আদি পুস্তক ১৬ ও ২১ থেকে হাজেরা সম্পর্কে একটি সারসংক্ষেপ।
হাজেরা ও ইব্রাহিম
হাজেরা ছিলেন সারাহ-র মিশরীয় দাসী,ইব্রাহিমের স্ত্রী। সারাহ দীর্ঘকাল বন্ধ্যা ছিলেন এবং ইব্রাহিমের প্রতি ইয়াহওয়েহ-র প্রতিশ্রুতি পূরণের একটি পথ খুঁজে বের করলেন, যাতে করে ইব্রাহিম বহু জাতির পিতা হতে পারে্ন, বিশেষত যেহেতু তারা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, কাজেই তিনি ইব্রাহিমের নিকট হাজেরাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পেশ করে।[৮]
হাজেরা গর্ভবতী হলেন, এবং দুই নারীর মাঝে চিন্তার উদয় হল। সারাহ ইব্রাহিমের কাছে নালিশ করলেন, এবং হাজেরার সাথে কঠোর আচরণ করলেন, যার ফলে হাজেরা পালিয়ে গেলেন।[৯]
হাজেরা শূরের পথে পালিয়ে গেলেন।হাজেরার নিকট একজন দেবদূতের আবির্ভাব হল, যিনি তাকে সারাহ-র কাছে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন,যাতে করে তিনি সন্তান ধারণ করতে পারেন যে কিনা "বন্য গাধার ন্যায় উদ্দম হবে।সে সবার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং সবাই হবে তার শত্রু। সে স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াবে এবং ভাইদের বসতির কাছে তাঁবু গাড়বে।"(আদি পুস্তক ১৬ঃ১২) অতঃপর তাকে বলা হল পুত্রকে ইসমাইল নামে ডাকতে। পরে, হাজেরা ঈশ্বরকে "লহয়-রোয়ী" হিসেবে সম্বোধন করলেন।[১০] তখন তিনি ইব্রাহিম ও সারাহ্র কাছে ফিরে গেলেন, এবং শিঘ্রই একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন, দেবদূতের পরামর্শমতে তার নাম রাখলেন।[১১]
হাজেরার পরিত্যাগ
পরবর্তীতে, সারাহ ইসহাককে প্রসব করেন, এবং দুই নারীর মাঝে আবারো টানাপড়েন শুরু হল। ইসহাকের দুধ ছাড়ানোর পরবর্তী উৎসবে(ভোজ), সারাহ দেখতে পেলেন কিশোর ইসমাইল তার পুত্রকে বিদ্রূপ করছে। এই কারণে সে এতটাই বিচলিত হলেন যে, তিনি দাবি করলেন ইব্রাহিম যেন হাজেরা ও তার সন্তানকে বের করে দেন। তিনি এও জানিয়ে দিলেন যে, ইসমাইল যেন ইসহাকের সাথে উত্তরাধিকারে কোনো ভাগ না পায়। ইব্রাহিম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন কিন্তু ঈশ্বর ইব্রাহিমকে তার স্ত্রীর আজ্ঞানুসারে কাজ করতে বললেন কারণ ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি ইসহাক ও ইসমাইল উভয়ের মধ্য দিয়েই বলবৎ থাকবে। [১২]
পরদিন খুব ভোরে, ইব্রাহিম হাজেরা ও ইসমাইলকে একসাথে খুঁজে বের করলেন। ইব্রাহিম হাজেরাকে রুটি ও পানি দিলেন, অতঃপর তাদের বের-শেবা মরুভূমিতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি ও তার পুত্র সম্পূর্ণ পানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরুদ্দেশ ঘুরতে লাগলেন। হতাশায়, তিনি উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। ঈশ্বর তার ও তার পুত্রের কান্না শুনলেন এবং তাদের উদ্ধারে মনোযোগী হলেন।[১৩]
দেবদূত হাজেরার চোখ খুলে দিলেন এবং তিনি একটি পানির কূপ দেখতে পেলেন। দেবদূত হাজেরাকে এও বললেন যে ঈশ্বর ইসমাইলের থেকে "একটি মহান জাতি সৃষ্টি করবেন"।[১৩]
হাজেরা মিশরীয় এক কন্যার সাথে ইসমাইলের বিয়ে দিলেন এবং তারা ফারান মরুভূমিতে বসতি করল।[১৪]
ধর্মীয় মতসমূহ
বাহা'ঈ ঐতিহ্য
বাহা'ঈ বিশ্বাস অনুযায়ী, বা'ব ছিলেন ইব্রাহিম ও হাজেরার পুত্র,[১৫] এবং ঈশ্বর ইব্রাহিমের বংশ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বাহা'ঈ পাবলিশিং হাউজ ইব্রাহিমের স্ত্রী ও উপপত্নীদের উপর একটি লেখা প্রকাশ করেছে এবং তাদের বংশধরদের পাঁচটি পৃথক ধর্মে শনাক্ত করেছে।[১৬]
খ্রিস্টধর্ম
নতুন নিয়মে, প্রেরিত পৌল গালাতীয়দের কাছে তার চিঠিতে হাজেরার অভিজ্ঞতাকে আইন এবং অনুগ্রহের মধ্যে পার্থক্যের একটি দৃষ্টান্ত বানিয়েছেন (গালাতীয় ৪:২১-৩১)।[১৭] পৌল সিনাই পর্বতে প্রদত্ত,তোরাহর বিধানসমূহকে ইসরাইলীয় জনগণের দাসত্বের সাথে সংযোগ ঘটিয়ে এটিই দেখাতে চেয়েছেন যে, তা ক্রিতদাসী হিসেবে হাজেরার অবস্থাকে সূচিত করে, যেখানে "স্বাধীন" স্বর্গীয় জেরুসালেমকে সারাহ ও তার সন্তানের মাধ্যমে সূচিত করা হয়েছে। সম্ভবত হাজেরার নামানুসারে সিনাই পর্বতকে "আগার" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। [১৮]
ক্যাথলিকদের ধর্মমতে, সেইন্ট অগাস্টিন হাজেরাকে একটি "পার্থিব শহর" বা মানবজাতির পাপাচারী অবস্থার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মানবজাতির পাপাচারী অবস্থাঃ "পার্থিব শহরে (হাজেরাকে প্রতীক হিসেবে) ... আমরা দুইটি জিনিস পায়, এর স্বয়ং নিশ্চিত উপস্থিতি এবং স্বর্গীয় শহরের প্রতীকী উপস্থিতি। পাপের দ্বারা বিকৃত প্রকৃতির মাধ্যমে পার্থিব শহরে নতুন নাগরিকদের উৎপত্তি অন্যদিকে স্বর্গীয় শহরে নতুন নাগরিকদের উৎপত্তি পাপ হতে অনুগ্রহ মুক্ত প্রকৃতির মাধ্যমে। (ঈশ্বরের শহর ১৫:২) এই দর্শনটি থমাস একুইনাস এবং জন উইকলিফের ন্যায় মধ্যযুগীয় ধর্মতাত্ত্বিকদের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। পরবর্তী জন সারাহ্র সন্তানদেরকে মুক্তিপ্রাপ্তদের সাথে এবং হাজেরার সন্তানদেরকে অভিশপ্তদের সাথে তুলনা করেছেন, যারা "প্রকৃতিগতভাবে পশুবৎ এবং মাত্রই নির্বাসিত"।[১৯]
হাজেরার কাহিনী এটাই দেখায় যে, কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে থাকা সম্ভব।[২০]
ইসলাম
Hājar বা Haajar (আরবী: هاجر), আরবী নাম যা ব্যবহৃত হয় ইব্রাহিমের স্ত্রী ও ইসমাইলের মাতাকে চিহ্নিত করতে। যদিও কুরআনে তার নাম বলা হয়নি, তবে তার উল্লেখ ও ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার স্বামীর কাহিনীতে। ইসলামী বিশ্বাসে তিনি অত্যন্ত সম্মানিত এক মহিলা।
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, তিনি ইব্রাহিমের প্রথম স্ত্রী সারা-র (সারাহ্) মিশরীয় দাসী ছিলেন। অবশেষে তিনি ফারান মরুভূমিতে তার পুত্র ইসমাইলকে নিয়ে বসতি করেন। হাজেরাকে একেশ্বরবাদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মাতৃত্ব হিসাবে সম্মান করা হয়, যেহেতু এই প্রক্রিয়াতেই ইসমাইলের মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ এসেছিলেন।
সারা বা হাজেরার কাওকেই কুরআনে নামসহ উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে কাহিনীটি বোঝা যায়, যার উল্লেখ এসেছে সূরা ইব্রাহিমে, ইব্রাহিমের প্রার্থনায় (১৪ঃ৩৭): "আমাদের পালনকর্তা, আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি।"[২১] যেখানে হাজেরার নাম নেই, পাঠক হাজেরার অবস্থাকে পরোক্ষভাবে ইব্রাহিমের চোখে দেখতে পায়।[২২] তদুপরি তার উল্লেখ হাদিসের কিতাবাদিতে বারবার এসেছে।
কাসাস-উল-আম্বিয়া, নবীদের নিয়ে একটি গল্পসমগ্র অনুসারে, হাজেরা ছিলেন মাগরেবের বাদশাহ্,সালেহ এর এক বংশধরের কন্যা। ফারাও যুল-আর্শ তার পিতাকে হত্যা করে এবং তিনি বন্দী হন ও তাকে দাসী হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে, তার রাজকীয় রক্ত বিবেচনায়, তাকে দাসীদের কর্ত্রী বানানো হয় এবং ফারাওয়ের সমস্ত সম্পত্তিতে প্রবেশাধিকার প্রদান করা হয়। ইব্রাহিমের বিশ্বাসে ধর্মান্তরিত হওয়ায়, ফারাও হাজেরাকে সারার কাছে সোপর্দ করলেন, সারা তাকে ইব্রাহিমকে দিলেন। এই কারণে "Hājar"(আরবীতে হাজেরা) নামটি এসেছে হা আজরুকা থেকে, আরবীতে যার অর্থ "এই হলো তোমার ক্ষতিপূরণ"।[২২]
ভিন্ন একটি ঐতিহ্য মতে, হাজেরা ছি্লেন মিশরের বাদশাহ্র বোন, যিনি তাকে এই ভেবে স্ত্রী হিসেবে ইব্রাহিমকে প্রদান করেন যে, সারা ইব্রাহিমের বোন।[২৩] ইবনে আব্বাসের মতে, ইসমাইলের জন্মের ফলে তার ও সারার মধ্যে সংঘাত বাধে। সারা তখনও বন্ধ্যা। ইব্রাহিম হাজেরা ও তাদের ছেলেকে একটি জায়গায় নিয়ে আসেন যার নাম পারান-আরাম বা (আরবীতে ফারান, পরবর্তীতে মক্কার চারিদিকে অবস্থিত ভূমি)। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল হাজেরার "বহিস্কার" নয় বরং "পুনর্বাসন"।[২২] ইব্রাহিম হাজেরা ও ইসমাইলকে একটি গাছের নিচে রেখে চলে যান এবং তাদেরকে কিছু পানি দিয়ে যান।[২৪] হাজেরা জানতে পারেন যে রবের নির্দেশেই ইব্রাহিম তাকে এই ফারান মরুভূমিতে রেখে যাচ্ছেন, এবং তিনি রবের সিদ্ধান্ত মেনে নেন।[২৩] মুসলিম বিশ্বাস মতে, আল্লাহ এই কাজের নির্দেশ দিয়ে ইব্রাহিমকে পরীক্ষা করেছেন।[২৫]
হাজেরা শিঘ্রই পানিশূন্য হয়ে পড়লেন, এবং ইসমাইল,যে সে সময় শিশু, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কেঁদে উঠল। হাজেরা ত্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং পার্শবর্তী দুই পাহাড়,সাফা ও মারওয়া-র মাঝে বারবার পানির খোঁজে দৌড়াতে লাগলেন। সাতবার দৌঁড়ানোর পর, একজন ফেরেশতা জমজম কূপের স্থলে দেখা দিলেন, নিজের গোঁড়ালি(অথবা তার পাখা) দ্বারা ভূমিতে আঘাত করলেন এবং একটি অলৌকিক ঝরনা ভূমি থেকে উৎসরিত হতে লাগল। একেই বলা হয় জমজম কূপ এবং এটি মক্কার কাবা ঘর থেকে কয়েক মিটার দূরে অবস্থিত। [২৪]
তার সাফা ও মারওয়ার মাঝে দৌড়ানোর এই ঘটনাকে[২৬] মুসলিমরা মক্কায় হজ্জের সময় স্মরণ করেন। হজ্জের একটি অংশ হল দুই পাহাড়ের মাঝে সাতবার দৌঁড়ানো, হাজেরার সাহস ও মালিকের উপর বিশ্বাসের স্মৃতি রক্ষার্থে, যেমনি তিনি মরুভূমির মাঝেও পানি খুঁজছিলেন (যেমনটি বিশ্বাস করা হয় যে,অতঃপর জমজম কূপ থেকে পানি অলৌকিকভাবে বেরিয়ে এল), এবং ইসলামে মাতৃত্বকে উদ্যাপন ও একই সাথে নারী নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে। হজ্জ-র কাজ শেষ করতে, কিছু মুসলিম জমজম কূপ থেকে পানিও পান করে এবং হাজেরার স্মরণে কিছু পানি হজ্জ শেষে বাড়িতেও নিয়ে যায়।[২৭]
অনেক মুসলিমই বিশ্বাস করেন হাজেরা ও তার পুত্র,ইসমাইলকে, কাবার পাশে একটা আধা ঘেরা এলাকায় দাফন করা হয়েছে, যার চারিপাশে মুসলিমরা হজ্জের সময় কাবার চারিপাশে যেরকম প্রদক্ষিণ করে অনুরূপ করে থাকেন।[২৮]
রাব্বানিক ব্যাখ্যা
রাব্বানিক ভাষ্যকারগণ দাবি করেন যে হাজেরা ছিলেন ফারাওয়ের কন্যা। "মিদরাস(এক ধরনের রব্বানিক সাহিত্য) আদিপুস্তক রব্বা"-য়(ইহুদি ধর্মের শাস্ত্রীয় যুগের সাহিত্য কর্ম) বর্ণিত আছে, এটা হল সেই ঘটনা যখন সারাহ ফারাওয়ের হারেমে থাকার সময় ফারাও তার কন্যাকে এই বলে সারাহ্র কাছে দাসী হিসেবে প্রদান করেন যে, "এটিই অধিকতর উত্তম,অন্যের ঘরের কর্ত্রী হওয়ার চেয়ে আমার কন্যা এইরূপ নারীর ঘরের দাসী হিসেবেই থাকুক"। সারাহ হাজেরার সাথে ভাল ব্যবহার করতেন, এবং যেসকল মহিলারা তার কাছে বেড়াতে আসত তাদেরকে হাজেরার সাথেও দেখা করতে উৎসাহিত করতেন। যাহোক, হাজেরা যখন ইব্রাহিমের মাধ্যমে গর্ভবতী হলেন, তিনি সারাহ্র প্রতি উপেক্ষাভাব প্রদর্শন শুরু করলেন,যার কারণে পরবর্তীতে তিনি(সারাহ) তার প্রতি কঠোর আচরণ করার, তার উপর ভারী কাজ আরোপ করতে এমনকি তাকে আঘাত করার জন্যও প্ররোচিত হন। (প্রাগুক্ত ১৬:৯)[২৯]
কিছু ইহুদি ভাষ্যকার হাজেরাকে কাতুরাহ্(যে নারীকে ইব্রাহিম সারাহ্র মৃত্যুর পর বিয়ে করেন)-র সাথে অভিন্ন বলে মনে করেন, ইব্রাহিম সারার মৃত্যুর পরে তাকে খুঁজে বের করেছেন। তাদের সুপারিশ মতে, হাজেরার ব্যক্তিগত নাম ছিল কাতুরাহ, এবং "হাজেরা" একটি বর্ণনামূলক পরিচয় যার অর্থ "অপরিচিতা"।[৩০][৩১][৩২] এই ব্যাখ্যা মিদরাসে[৩৩] আলোচিত হয়েছে এবং রাশি, গুর আরিয়াহ, কেলি যাকার, ও বার্টিনোরোর ওবাদিয়ার দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। রাশি যুক্তি দিয়ে দেখান যে "কাতুরাহ" ছিলেন হাজেরাকে প্রদত্ত একটি নাম। কারণ তার কাজ-কর্মগুলো ধূপের ন্যায় সুন্দর ছিল (এই কারণেঃ"ketores"), এবং/অথবা ইব্রাহিম থেকে আলাদা হওয়ার সময় থেকেই তিনি পবিত্রা ছিলেন-keturah [ קְטוּרָה Q'turah ] সংযমীর আরামীয় শব্দ থেকে আহরিত। বিপরীত মত (এই কাতুরাহ হাজেরা থেকে ভিন্ন কেও ছিলেন) রাশবাম,আব্রাহাম ইবন এয্রা,রাদাক এবং রামবান-এর মাধ্যমে প্রবর্তিত হয়েছে। তাদেরকে বংশাবলির ১:২৯–৩৩ বংশতালিকায় দুইটি ভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে নথিভূক্ত করা হয়েছে।
কলা ও সাহিত্য
পিটার লাস্টম্যান,গুস্তাভ দোরে,ফ্রেডেরিখ গুডাল এবং জেমস একফোর্ড লডার সহ অনেক শিল্পী মরুভূমিতে হাজেরা ও ইসমাইলের আখ্যানের দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার দ্য মারচেন্ট অব ভেনিস নাটকের ২য় অঙ্কের ৫ম দৃশ্যের ৪০তম লাইনে হাজেরার নাম উল্লেখ করেছেন যখন শাইলক বলল "হাজেরার বেটাদের বোকাইচণ্ডীটা কি বলল রে?"। এই লাইনে ল্যান্সলট চরিত্রটাকে উল্লেখ করা হয়েছে, যাকে শাইলক নির্বাসিত ইসমাইলের সাথে তুলনা করে অপমান করছে। তদুপরি এটি খ্রিস্টান চরিত্রটিকে নির্বাসিত হিসেবে চিত্রিত কোরে প্রচলিত খৃস্টান ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করে।[১৯]
দানিয়েল ডিফোর রচনায় মল ফ্লানডার্স এর ন্যায় চরিত্রগুলোর মাধ্যমে অপরাধের অজুহাত হিসেবে হাজেরার দূর্ভোগ ও হতাশাকে ব্যবহার করা হয়েছে, এবং স্যামুয়েল টেলর কল্যারিজের নাটক জপোলিয়ায় নির্বাসিতদের মা হিসেবে হাজেরার প্রতি প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্ব্যক্ত হয়েছে, যার নায়িকাকে আশ্বস্ত করা হয় যে সে "হাজেরার কোনো বংশধর নয়;বরং তুমি এক অভিষিক্ত রাজার ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী।"[১৯]
ঊনিশ শতকে বিশেষত আমেরিকায়,একটি অধিক সহানুভূতিশীল চিত্রাঙ্কন লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে। এডমোনিয়া লুইস, একজন প্রাক্তন আফ্রো-আমেরিকান এবং জন্মগত আমেরিকান, যিনি তার সর্বাধিক জনপ্রিয় কাজগুলোর একটি্তে হাজেরাকে বিষয়বস্তু বানিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন "সমস্ত মহিলাদের যারা সংগ্রাম এবং কষ্টভোগ করেছেন,তাদের জন্য দৃঢ় সহানুভূতি" দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।[৩৪] উপন্যাস ও কবিতায় হাজেরা নিজে, অথবা হাজেরা নামের চরিত্রগুলো, ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল অন্যায়ে ক্লীষ্ট নির্বাসিতদের প্রতিচ্ছবিরূপে।
এগুলোর অন্তর্ভুক্ত হল জাতীয় মহিলা প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট,এলিজা জেন পইটেভেন্ট নিকলসনের (সাহিত্যকর্মে ব্যবহৃত ছদ্মনাম পার্ল রিভার্স) দীর্ঘ নাটকীয় কবিতা হাজেরা; জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত সাময়িকী লেখক,নাথানিয়েল পার্কার উইলিসের মরুভূমিতে হাজেরা; অগাস্টা মুরের হাজেরার প্রস্থান।[১৯] ১৯১৩ সালে এর সাথে যুক্ত হয় আমেরিকান দক্ষিণী সমাজতন্ত্রবাদী এবং নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী মেরী জন্সটনের প্রকাশ্য নারীবাদী উপন্যাস হাজেরা[৩৫]।[৩৬] হল কাইন ১৮৮৫ সালে সমসাময়িকে ইংল্যান্ডে রচিত তার বইয়ের নাম দেন "হাজেরার এক পুত্র" এবং তাতে অবৈধতার(জারজ সন্তান) বিষয় তুলে ধরেন।
আরও সাম্প্রতিক সাহিত্যের মধ্যে একইভাবে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল হয়ে উঠেছে। মার্গারেট লরেঞ্জের "পাথুরে দেবদূত" উপন্যাসে ব্রাম নামক লোকের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ একটি প্রধান চরিত্রের নাম হাজেরা, যার জীবন কাহিনীতে বাইবেলের হাজেরার কিছুটা অনুকরণ ঘটেছে। টনি মরিসনের উপন্যাস "সলোমনের গীত"-এ হাজেরা নামক একটি চরিত্র স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা বহু বাইবেলীয় বিষয়বস্তু ও ইঙ্গিত নির্দেশ করে। হাজেরার বিস্তারিত উল্লেখ এসেছে সালমান রুশদির বিতর্কিত "দ্য স্যাটানিক ভার্সেস" উপন্যাসে, যেখানে মক্কা, বালির উপর নির্মিত এবং হাজেরার প্রস্রবণ ধারায়(জমজম কূপ) চালিত একটি মরু পল্লীকে "জাহেলিয়াত" দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মার্গারেট আটউডের পরিচারিকার উপাখ্যানে বিলহাহ ও জিল্পাহর সাথে হাজেরার উল্লেখ রয়েছে, একটি বিতর্কিত বিদ্ঘুটে উপন্যাস যা নারীদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, যাদের কর্তব্য হচ্ছে মনিবদের স্ত্রীদের স্থান গ্রহণ করে, তাদের জন্য সন্তান উৎপাদন করা, । কার্লট গরডনের সাম্প্রতিক প্রামাণ্য বই, "ঈশ্বরকে আখ্যা দানকারী রমণীঃ ইব্রাহিমের উভয়সংকট এবং তিনটি বিশ্বাসের জন্ম" ইসলাম,ইহুদিধর্ম ও খ্রিস্টধর্ম এই তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে হাজেরার জীবনের একটি বিবরণ প্রদান করে।
সমকালীন প্রভাব
ইসরাইল
১৯৭০ সাল থেকে,নবজাতক শিশুদের জন্য "হাজেরা" নামকরণের প্রথাটি বিস্তার লাভ করেছে। এই নামকরণ প্রায়শই একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসাবে গৃহীত হয়, যা পিতা-মাতাদের ফিলিস্তিনী ও আরব বিশ্বের সাথে পুনর্মিলনের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে, এবং জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় অনেকের দ্বারা অসমর্থনের মুখে পড়ে। এই নামের অর্থগুলো উপস্থাপিত হয়েছিল "হাজেরাঃ ২০০০ সালের সংস্কৃতি,নীতিশাস্ত্র এবং একতা" নামক ইসরায়েলী সাময়িকী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।[৩৭]
আফ্রো-আমেরিকানরা
কতিপয় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান নারীবাদীরা হাজেরা সম্বন্ধে লিখেছেন, তার আখ্যানকে আমেরিকান দাসদের ইতিহাসের সাথে তুলনা করেছেন। উইলমা বেইলে, "হাজেরাঃ একজন আনাবাপ্টিস্ট নারীবাদীর জন্য আদর্শ" শিরোনামের একটি নিবন্ধে, তাকে একজন "পরিচারিকা" এবং "দাসী" হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি হাজেরাকে "ক্ষমতা,দক্ষতা,শক্তি ও প্রেরণা"-র আদর্শ হিসেবে দেখেন। "একজন কর্ত্রী,একজন পরিচারিকা এবং ক্ষমাহীনতা" নিবন্ধে, রেনিটা জে. উইমস দাবি করেন যে সারাহ ও হাজেরার মধ্যকার সম্পর্ক হতে প্রকাশ পায় "জাতিগত কুসংস্কার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শোষণ দ্বারাই পরিপুষ্ট"।[৩৮]
সহায়ক প্রজনন
একজন বন্ধ্যা নারীর জন্য হাজেরার সন্তান ধারণ, একটি উদাহরণ যাকে বর্তমানে প্রতিনিধিত্ব বা চুক্তিভিত্তিক গর্ভধারণ বলা হয়। এর সমালোচনাকারীগণ ও অন্যান্য সহায়ক প্রজনন বিষয়ক প্রযুক্তি হাজেরাকে তাদের বিচার-বিশ্লেষণে ব্যবহার করেন। ১৯৮৮ সালের শুরুতে, প্রজনন ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আনা গোল্ডম্যান-আমিরভ হাজেরার কথা লিখেছেন "বাইবেলের 'গর্ভ যুদ্ধ' [যা] মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী, উর্বরতা ও যৌনতা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে"। [৩৯]
বংশাবলি
তেরাহ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
সারাহ[৪০] | আব্রাহাম (ইব্রাহিম) | হাজেরা | হারান | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
নাহোর | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ইসমাঈল | মিল্কা | লোত (লূত) | ইস্কা | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ইসমাইলগণ | ৭টি ছেলে[৪১] | বেথিউ | ১ম কন্যা | ২য় কন্যা | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ইসহাক | রেবেকা | লাবন | মোয়াবগণ | আমেনগণ | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
এষৌ | ইয়াকুব | র্যাচেল | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
বিলহা | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
ইদোমগণ | জিল্পাহ | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
লিয়া | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
১. রেউবেন ২. সিমোন ৩. লেভি ৪. জুদাহ ৯. ইসসাচার ১০. জেবুলুন ১১. দিনাহ (মেয়ে) | ৭. গাদ ৮. আশের | ৫. দান ৭. নাফতালি | ১২. জোসেফ (ইউসুফ) ১৩. বেনিয়ামিন | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
আরও দেখুন
- ইব্রাহিম ও হাজেরা
- ইব্রাহিম ও ইসমাইল
- পারাশাহ লেখ-লেখা
- পারাশাহ ভায়েরা