লিওনার্দো ভিলহেল্ম ডিক্যাপ্রিও (/dɪˈkæprioʊ/; জন্ম: ১১ই নভেম্বর ১৯৭৪) হলেন একজন মার্কিন অভিনেতা, প্রযোজক এবং পরিবেশবাদী। তাকে প্রায়ই জীবনীনির্ভর ও কালসীমানির্ভর চলচ্চিত্রে এবং প্রথার বাইরের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। ২০১৯ সাল মোতাবেক, তার চলচ্চিত্রসমূহ বিশ্বব্যাপী $৭.২ বিলিয়ন আয় করেছে এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক গ্রহীতা অভিনয়শিল্পীর বাৎসরিক তালিকায় তিনি অষ্টম স্থান অধিকার করেন। তিনি বহু পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেছেন এবং একবার একাডেমি পুরস্কার, তিনবার গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার ও একবার বাফটা পুরস্কার লাভ করেছেন।
লস অ্যাঞ্জেলেসে জন্মগ্রহণকারী ডিক্যাপ্রিও ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে কাজের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯০-এর দশকে শুরুতে তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন ধারাবাহিক, যেমন সিটকম প্যারেন্টহুড-এ একাধিক পর্বে অভিনয় করেন। তার প্রথম বড়মাপের কাজ ছিল দিস বয়স লাইফ এবং হোয়াটস ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ-এ পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে তিনি সমাদৃত হন এবং শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন। তিনি মহাকাব্যিক প্রণয়ধর্মী টাইটানিক চলচ্চিত্রে জ্যাক ডসন চরিত্রে অভিনয় করে বিশ্বব্যাপী তারকা খ্যাতি লাভ করেন। ছবিটি সে সময় ও পরবর্তী এক দশক সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্র ছিল। এরপর তার অভিনীত কয়েকটি চলচ্চিত্র বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হয় এবং তিনি ২০০২ সালে জীবনীমূলক চলচ্চিত্র ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান এবং ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র গ্যাংস অফ নিউ ইয়র্ক-এ অভিনয় করেন। গ্যাংস অফ নিউ ইয়র্ক-এর মাধ্যমে ডিক্যাপ্রিও পরিচালক মার্টিন স্কোরসেজির সাথে জুটি গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে বেশকিছু সফল চলচ্চিত্রের নেপথ্যে ছিল।
লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ১৯৭৪ সালের ১১ই নভেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ারহলিউডে জন্মগ্রহণ করেন।[৩] তার বাবা জর্জ ডিক্যাপ্রিও ছিলেন একজন কমিক শিল্পী ও কমিক বই পরিবেশক এবং তার মাতা ইরমেলিন (বিবাহপূর্ব ইন্ডেনবার্কেন) ছিলেন একজন আইন সচিব। তিনি তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।[৪] ডিক্যাপ্রিওর বাবা ছিলেন ইতালীয় (নাপোলস) ও জার্মান (বাভারিয়া) বংশোদ্ভূত।[৫][৬][৭] ডিক্যাপ্রিওর নানা ভিলহেল্ম ইন্ডেনবার্কেন ছিলেন একজন জার্মান।[৮] তার নানী হেলেন ইন্ডেনবার্কেন ছিলেন একজন রুশ বংশোদ্ভূত জার্মান নাগরিক।[৯][১০][১১] রাশিয়ায় এক সাক্ষাৎকারে ডিক্যাপ্রিও নিজেকে অর্ধেক রুশ হিসেবে পরিচয় দেন এবং বলেন তার বাবা-মা দুই দিক থেকেই তিনি রুশ।[১০] ডিক্যাপ্রিওর বাবা-মা কলেজে পড়াকালীন পরিচিত হন এবং পরে বিয়ে করে ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে বসবাস করেন।[৫]
লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর নামকরণ সম্পর্কে বলা হয় যে তার মা যখন গর্ভবতী ছিলেন তিনি ইতালিতে একটি জাদুঘরে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ছবি দেখতেছিলেন। সেসময়ে তিনি প্রথম পেটে সন্তানের নড়াচড়া টের পান।[১৩] তার এক বছর বয়সে তার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এবং বেশিরভাগ সময়ে তিনি তার মায়ের সাথে থাকেন।[১৪] তার মায়ের চাকরির কারণে মা-ছেলে দুজন লস আঞ্জেলেসের বিভিন্ন স্থানে, যেমন ইকো পার্ক ও লস ফেলিজ বসবাস করেন।[৫] ডিক্যাপ্রিও লস অ্যাঞ্জেলেস সেন্টার ফর এনরিচড স্টাডিজ-এ চার বছর পড়ার পর সিডস এলিমেন্টারি স্কুল (বর্তমান ইউসিএলএ ল্যাব স্কুল) এবং জন মার্শাল হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন।[১৫] তিন বছর পর তিনি স্কুল থেকে ঝড়ে পড়েন, কিন্তু ততদিনে তিনি সমমানের ডিপ্লোমা জেনারেল এডুকেশনাল ডেভলপমেন্ট অর্জন করেন।[১৬][১৭] ডিক্যাপ্রিও তার শৈশবের বেশ কিছু সময় জার্মানিতে তার নানা-নানী ভিলহেল্ম ও হেলেনের সাথে কাটিয়েছেন। তার জার্মান ও ইতালীয় ভাষায় দখল রয়েছে।[১৮][১৯][২০]
ডিক্যাপ্রিও বলেন শৈশবে তিনি সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী বা অভিনয়শিল্পী হতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে করেন, কারণ তিনি বিভিন্ন চরিত্র ও ব্যক্তিকে অনুকরণ করতে পছন্দ করতেন।[২১] যখন তার দুই বছর বয়স তিনি একটি পরিবেশনা উৎসবে মঞ্চে যান এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে নাচেন। দর্শকদের নিকট থেকে উল্লসিত প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে অভিনয়ের আগ্রহ জাগায়।[২২] যখন তার বড় সৎভাই একটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপন থেকে $৫০,০০০ উপার্জন করেন, ডিক্যাপ্রিও এতে মুগ্ধ হন ও অভিনয়শিল্পী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[২৩] ১৯৭৯ সালে পাঁচ বছর বয়সী ডিক্যাপ্রিওকে শিশুতোষ টেলিভিশন ধারাবাহিক রম্পার রুম থেকে তার ভাঙচুর প্রবণতার জন্য বাদ দেওয়া হয়েছিল।[২৪][২৫] ১৪ বছর বয়সে তিনি ম্যাটেলের ম্যাচবক্স গাড়ির বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেন। এটি তার প্রথম কাজ হিসেবে স্বীকৃত।[২৪][২৬] এরপর তিনি ক্রাফট ফুডস, বাবল ইয়াম ও অ্যাপল জ্যাকসের কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেন।[২৭] ১৯৮৯ সালে তিনি টেলিভিশন অনুষ্ঠান দ্য নিউ ল্যাসির দুটি পর্বে গ্লেন চরিত্রে অভিনয় করেন।[২৮][২৯]
কর্মজীবন
১৯৮০-এর দশক: প্রাথমিক কর্মজীবন
ডিক্যাপ্রিওর কর্মজীবন শুরু হয় পাঁচ বছর বয়সে কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র ও শিক্ষামূলক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। রম্পার রুম টেলিভিশন ধারাবাহিকের সেটে ভাংচুরের জন্য তাকে এই নাটক থেকে বাদ দেওয়া হয়,[২৪] তিনি পরে ১৪ বছর বয়সে তার সৎ বড় ভাই অ্যাডাম ফেরারের হাত ধরে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে আসেন এবং ম্যাচবক্স গাড়ির বিজ্ঞাপন করেন।[২৪]
১৯৯০ সালে ডিক্যাপ্রিও প্রথম টেলিভিশনে অভিনয়ের সুযোগ পান। তিনি পেরেন্টহুড চলচ্চিত্র অবলম্বনে একই নামের মিনি ধারাবাহিকে অভিনয় করেন। এরপর তিনি দ্য নিউ ল্যাসি ও রোজিয়ান টেলিভিশন ধারাবাহিকে ছোট খাট চরিত্রে এবং সান্তা বারবারা সোপ অপেরায় ম্যাসন ক্যাপওয়েলের ছোট বেলার চরিত্রে অভিনয় করেন। পেরেন্টহুড ও সান্তা বারবারায় অভিনয়ের জন্য তিনি ইয়ং আর্টিস্ট পুরস্কার-এর জন্য মনোনয়ন লাভ করেন।[৩০]
১৯৯১-১৯৯৫: চলচ্চিত্রে আগমন
ডিক্যাপ্রিওর চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় ১৯৯১ সালে কমেডি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ক্রিটারস ৩ দিয়ে। এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন ভূস্বামীর সৎ ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন।[৩১] এর পরপরই তিনি এবিসিরগ্রোয়িং পেইনস চলচ্চিত্রে এক অনাথ লুক ব্রোয়ার চরিত্রে অভিনয় করেন। ডিক্যাপ্রিওর অভিনয় জীবনের প্রথম বড় সুযোগ আসে ১৯৯২ সালে যখন ৪০০ শিশু শিল্পী থেকে তাকে রবার্ট ডি নিরো নিজে দিস বয়'স লাইফের জন্য বাচাই করেন।[২৪]
১৯৯৩ সালে তিনি হোয়াট’স ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ-এ জনি ডেপের মানসিক বিকারগ্রস্থ ছোট ভাই আর্নি গ্রেপ চরিত্রে অভিনয় করেন। পরিচালক লাসে হালস্ত্রোম প্রথমে চেয়েছিলেন একটু দেখতে অসুন্দর কাউকে এই চরিত্রে নেওয়ার জন্য, কিন্তু অডিশনের জন্য আসা সকলের মধ্যে ডিক্যাপ্রিওর কাজই তার পছন্দ হয়।[৩১] চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করে এবং ডিক্যাপ্রিও পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ন্যাশনাল বোর্ড অব রিভিউ পুরস্কার লাভ করেন এবং একাডেমি পুরস্কার ও গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সমালোচক জ্যানেট মাসলিন ডিক্যাপ্রিওর অভিনয়ের প্রশংসা করে লিখেন যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আর্নি চরিত্রে তার অভিনয় ছিল চমকপ্রদ ও সুস্পষ্ট।[৩২]
১৯৯৫ সালে ডিক্যাপ্রিও স্যাম রেইমি পরিচালিত পশ্চিমা ঘরানার দ্য কুইক অ্যান্ড দ্য ডেডে অভিনয় করেন। সনি পিকচার্স তাকে নেওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান হলে এই ছবিতে তার সহ-অভিনয়শিল্পী ও ছবির প্রযোজক শ্যারন স্টোন তার কাজের মূল্য নিজে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[৩৩] ছবিটি বক্স অফিসে $১৮.৫ মিলিয়ন ব্যবসা করে এবং সমালোচকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লাভ করে।[৩৪] এরপর তিনি টোটাল ইক্লিপসে, ফরাসি কবি আর্তুর র্যাঁবোর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ছবিতে আর্থার রিমবাউ ও কবি পল ভের্লেনের মধ্যে সমকামী সম্পর্ক তুলে ধরা হয়। তিনি মূলত রিভার ফিনিক্স মারা যাওয়ায় তার পরিবর্তে এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান।[৩৫] ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে মোটামুটি সফল হয়।[৩৬]
ডিক্যাপ্রিও উঠতি পরিচালক আর. ডি. রবের অনুরোধে ডন'স প্লাম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু রব ছবিটিকে পূর্ণদৈর্ঘ্যে রূপান্তর করতে চাইলে ডিক্যাপ্রিও ও তার সহ-অভিনেতা টোবি ম্যাগুইয়ার এর বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং বলেন তারা কখনো চাননি ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।[৩৭] তবে ছবিটি ২০০১ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং সমালোচকদের ইতিবাচক সাড়া লাভ করে।[৩৮] ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে তার অভিনীত দ্য বাস্কেটবল ডায়েরিজ মুক্তি পায়। লেখক জিম ক্যারলের জীবনী নিয়ে নির্মিত ছবিটি পরিচালনা করেছেন স্কট কালভার্ট।[৩৯]
১৯৯৬-২০০১: মূলধারায় সাফল্য
১৯৯৬ সালে ডিক্যাপ্রিও উইলিয়াম শেকসপিয়র রচিত প্রণয়-বিয়োগাত্মক নাটক রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট এর আধুনিক চিত্রনাট্যে ব্যাজ লুরমানের পরিচালনায় রোমিও + জুলিয়েট চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এতে তার বিপরীতে জুলিয়েটের ভূমিকায় অভিনয় করেন ক্লেয়ার ডেইন্স।[৪০] ছবিটি ব্যবসাসফল হয় এবং বিশ্বব্যাপী $১৪৭ মিলিয়ন আয় করে।[৪১] একই বছরে তিনি জেরি জ্যাকস পরিচালিত পারিবারিক-নাট্য চলচ্চিত্র মারভিন্স রুম এ পুনরায় রবার্ট ডি নিরোর সাথে অভিনয় করেন। স্কট ম্যাকফার্সনের চিত্রনাট্যে তারই ১৯৯১ সালের একই নামের নাটক অবলম্বনে ছবিটিতে আরও অভিনয় করেন মেরিল স্ট্রিপ ও ডায়ানা কিটন। তারা দুই বোনের চরিত্রে অভিনয় করেন। ডিক্যাপ্রিও মেরিল স্টিপের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন।[৪২]
দ্য বীচ চলচ্চিত্রের সংবাদ সম্মেলনে ডিক্যাপ্রিও, ফেব্রুয়ারি ২০০০।
১৯৯৭ সালে ডিক্যাপ্রিও জেমস ক্যামেরন পরিচালিত টাইটানিক চলচ্চিত্রে ২০ বছর বয়সী জ্যাক ডসনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি প্রথমে এই চরিত্রে অভিনয় করতে চান নি, কিন্তু ক্যামেরন তার অভিনয় দক্ষতার ব্যাপারে আস্থা প্রদর্শনে কারণে তিনি এই চরিত্রে অভিনয় করতে অনুপ্রাণিত হন।[৪৩] চলচ্চিত্রটি বক্স অফিসে $১.৮৪৩ বিলিয়ন আয় করে ২০১০ সালের পূর্ব পর্যন্ত হলিউডের সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্রের তালিকায় নাম লেখায়।[৪৪] ডিক্যাপ্রিও অচিরেই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সুপারস্টার হয়ে ওঠেন এবং কিশোরী ও তরুণীদের মধ্যে তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, যা "লিও-ম্যানিয়া" নাম ধারণ করে।[৪৫] উদাহরণস্বরূপ ১৯৯৮ সালের মে মাসে কমপক্ষে চারটি টিন ম্যাগাজিনে ডিক্যাপ্রিও ছবি কভার পেজে আসে এবং তার মধ্যে তিনটি বই দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার তালিকার সেরা ছয়টি বইয়ের তালিকায় স্থান করে নেয়।[৪৬] এছাড়া দুইশতাধিক ভক্ত একাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস এর সাথে যোগাযোগ করেন কেন ডিক্যাপ্রিওকে ৭০তম একাডেমি পুরস্কারে মনোনয়ন দেওয়া হয় নি।[৪৭] তিনি এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তার দ্বিতীয় গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন এবং এমটিভি মুভি পুরস্কার লাভ করেন।
পরের বছর ডিক্যাপ্রিও তার নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গধর্মী চলচ্চিত্র সেলিব্রেটি (১৯৯৮) ছবিতে অভিনয় করেন। ছবিটি পরিচালনা করেন উডি অ্যালেন। সেবছর তিনি দ্য ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক চলচ্চিত্রে রাজা চতুর্দশ লুই ও তার ভাই ফিলিপের দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন। র্যান্ডাল ওয়ালেস পরিচালিত চলচ্চিত্রটি ১৯৩৯ সালের একই নামের চলচ্চিত্র অবলম্বনে নির্মিত হয়। ছবিটি মিশ্র ও নেতিবাচক সমালোচনা লাভ করলেও বিশ্বব্যাপী $১৮০ মিলিয়ন আয় করে বক্স অফিসে সফল হয়।[৪৮] এন্টারটেইনমেন্ট উইকলির সমালোচক ওয়েন গ্লেইবার্ম্যান ডিক্যাপ্রিও অভিনয়ের প্রশংসা করলেও[৪৯] তিনি দ্বৈত চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সেবছরের সবচেয়ে বাজে পর্দা জুটি হিসেবে গোল্ডেন রাসবেরি পুরস্কার পান।[৫০]
২০০০ সালে ডিক্যাপ্রিও নাট্যধর্মী দ্য বীচ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ছবিটি আলেক্স গারল্যান্ডের ১৯৯৬ সালের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। ছবিতে তিনি একজন মার্কিন ভ্রমণকারীর চরিত্রে অভিনয় করেন, যে থাইল্যান্ড উপসাগরের একটি নির্জন দ্বীপে জীবনযাপনের পরিকল্পনা করেন। $৫০ মিলিয়ন বাজেটের ছবিটি $১৪৪ মিলিয়ন আয় করে,[৫১] কিন্তু ডিক্যাপ্রিওর আগের ছবির মত এই ছবিটিতেও তার অভিনয়ের নেতিবাচক সমালোচনা দেখা যায়। ফলে তিনি আবার গোল্ডেন রাসবেরি পুরস্কারে মনোনীত হন।
ডিক্যাপ্রিও ২০০২ সালের প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ফ্রাঙ্ক আবেগনেল জুনিয়রের জীবনীভিত্তিক অপরাধ নাট্য ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান। ফ্রাঙ্ক তার ১৯তম জন্মদিনের পূর্বেই তার আস্থা ও ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্বের দ্বারা ১৯৬০ এর দশকে মিলিয়নিয়ার হয় গিয়েছিল। স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত চলচ্চিত্র মাত্র ৫২ দিনের মধ্যে ১৪৭টি ভিন্ন স্থানে ধারণ করা হয়। এটি ডিক্যাপ্রিওর করা সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এবং প্রাণবন্ত চলচ্চিত্র।[৫২]ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান ছবিটি সমালোচকদের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লাভ করে এবং আন্তর্জাতিক সাফল্য অর্জন করে। $ ৩৫১.১ মিলিয়ন আয় করা ছবিটি টাইটানিক-এর পর ডিক্যাপ্রিওর সর্বোচ্চ উপার্জনকারী চলচ্চিত্র।[৫৩] চলচ্চিত্র সমালোচক রজার ইবার্ট তার অভিনয়ের প্রশংসা করে বলেন, "ডিক্যাপ্রিও সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে দুর্বোধ্য ও দুর্দশাপীড়িত চরিত্রে অভিনয় করেছেন, এখানে তিনি নিখুঁত এবং কৌতুকপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যে নিজে আবিষ্কার করেছে সে কিসে ভাল এবং তাই করে।"[৫৪] পরের বছর ডিক্যাপ্রিও এই ছবিতে তার কাজের জন্য তার তৃতীয় গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারের মনোনয়ন পান।[৫৫]
২০০২ সালে ডিক্যাপ্রিও ১৯শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের নিউ ইয়র্ক সিটির ফাইভ পয়েন্ট জেলার পটভূমিতে মার্টিন স্কোরসেজি পরিচালিত ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র গ্যাংস অফ নিউ ইয়র্ক-এ অভিনয় করেন। প্রথম দিকে পরিচালক স্কোরসেজির এই চলচ্চিত্রটি উপলব্ধি করার জন্য তার ধারণাটি বুঝাতে কষ্ট হচ্ছিল। পরে ডিক্যাপ্রিও আইরিশ গোষ্ঠীর একজন তরুণ নেতা আমস্টারডাম ভ্যালন চরিত্রে অভিনয় করতে আগ্রহী হন। ফলে মিরাম্যাক্স ফিল্মস এই ছবিতে অর্থায়ন করতে উৎসাহিত হয়।[৫৬] তবুও চলচ্চিত্রটি নির্মাণকালে বাজেট ঘাটতি এবং প্রযোজক-পরিচালক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যার ফলে দীর্ঘ আট মাস লেগে যায় শুটিংয়ে এবং ব্যয় হয় ১০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্কোরসেজি নির্মিত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র।[৫৬] মুক্তির পরে গ্যাংস অফ নিউ ইয়র্ক বাণিজ্যিক ও সমালোচনামূলক সাফল্য লাভ করে।[৫৭] ডিক্যাপ্রিওর অভিনয় প্রশংসিত হয় কিন্তু অধিকাংশ সমালোচকগণ তার অভিনয়ে ড্যানিয়েল ডে-লুইসের প্রভাব দেখতে পান।[৫৮][৫৯]
মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক ও বৈমানিকদের মধ্যে অগ্রদূত হাওয়ার্ড হিউজের জীবনীমূলক দ্য অ্যাভিয়েটর চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি আবার স্কোরসেজির সাথে জুটি গড়েন এবং স্কোরসেজির সঙ্গে তার জুটি জোরদার হয়। ১৯২০ এর দশক থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত হিউজের জীবনীকে কেন্দ্র করে ডিক্যাপ্রিও প্রথমে মাইকেল মানের সাথে এই ছবির পরিকল্পনা করেন। মান পূর্বে পরপর জীবনীমূলক দি ইনসাইডার (১৯৯৯) এবং আলি (২০০১) পরিচালনা করেন।[৫৯] পরে ডিক্যাপ্রিও জন লোগানের চিত্রনাট্যে স্কোরসেজির নির্দেশনায় চুক্তিবদ্ধ হন। দ্য অ্যাভিয়েটর সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করে এবং বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়।[৬০] ডিক্যাপ্রিও তার অভিনয়ের জন্য ইতিবাচক সমালোচনা লাভ করেন এবং শ্রেষ্ঠ নাট্য চলচ্চিত্র অভিনেতার জন্য গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার লাভ করেন, এছাড়াও শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন।[৬১][৬২]
২০০৫ সালে শিল্পকলায় তার অবদানের জন্য ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রী তাকে অর্দের দে আর্তস এত দে লেত্রে-এর কমান্ডার ঘোষণা দেন।[৬৩] পরের বছর ডিক্যাপ্রিও ব্লাড ডায়মন্ড এবং দ্য ডিপার্টেড ছবিতে অভিনয় করেন। এডওয়ার্ড জুইক পরিচালিত যুদ্ধের ছবি ব্লাড ডায়মন্ড-এ তিনি সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধে জড়িত থাকা রোডেশিয়া থেকে হীরক চোরাচালানকারী হিসেবে অভিনয় করেন। ছবিটি ইতিবাচক সমালোচনা লাভ করে[৬৪] এবং দক্ষিণ আফ্রিকার আফ্রিকানদের মত বাচনভঙ্গী অনুকরণ করতে পারার জন্য ডিক্যাপ্রিও প্রশংসিত হন কারণ আফ্রিকানদের বাচনভঙ্গী অনুকরণ করা কঠিন বলে বিবেচিত।[৬৫] স্কোরসেজির দ্য ডিপার্টেড ছবিতে তিনি বিলি কস্টিগানের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এতে তিনি বোস্টনে এক আইরিশ মবের সাথে রাজ্য সৈন্যের গুপ্তচর হিসেবে অভিনয় করেন। মুক্তির পর প্রত্যাশিতভাবে চলচ্চিত্রটি ইতিবাচক সমালোচনা লাভ করে এবং ২০০৬ সালের সর্বোচ্চ-রেটিং প্রাপ্ত বৃহৎ পরিসরে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের একটি হয়ে উঠে।[৬৬] $৯০ মিলিয়ন বাজেটের ছবিটি সহজেই দ্য অ্যাভিয়েটরের $২১৩.৭ মিলিয়ন আয়ের রেকর্ড ভেঙ্গে ডিক্যাপ্রিও এবং স্কোরসেজি জুটির সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে।[৬৭] এই চলচ্চিত্রে ডিক্যাপ্রিও অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেন এবং তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতার জন্য স্যাটেলাইট পুরস্কার অর্জন করেন।[৬৮] একই বছর তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে গোল্ডেন গ্লোব[৬৯] এবং স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন[৭০] এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে তার তৃতীয় একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন।[৭১]
ব্যক্তিগত জীবন
ক্যালিফোর্নিয়ারলস অ্যাঞ্জেলেসে তার একটি বাড়ি এবং নিউ ইয়র্কের ব্যাটারি পার্ক সিটিতে একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে।[৭২] ২০০৯ সালে তিনি বেলিজে একটি দ্বীপ কিনেন। সেখানে তার একটি পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৪ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার পাম স্প্রিংয়ে ডোনাল্ড ওয়েক্সলারের নকশাকৃত একটি বাড়ি কিনেন।[৭৩] ডিক্যাপ্রিও একজন অজ্ঞেয়বাদী।[৭৪]
ডিক্যাপ্রিওর প্রেমের সম্পর্ক সারাবিশ্বে প্রচারিত হয়।[৭৫] ১৯৯৭ সালে তিনি ব্রিটিশ গায়িকা এমা বান্টনের সাথে দেখা যায়।[৭৬][৭৭] এছাড়া তাকে অভিনেত্রী বিজৌ ফিলিপস, মডেল ক্রিস্টেন জাং ও এমা মিলারদের সাথে দেখা যায়।[৭৮] ২০০০ সালে তার ব্রাজিলীয় মডেল গিসেল বান্দচেনের সাথে পরিচয় হয় এবং ২০০৫ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক ছিল। ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তার ইসরায়েলি মডেল বার রেফায়লির সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এসময়ে তিনি ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি সিমন পেরেজের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং রেফায়েলির শহর হোড হাশারনে যান।[৭৯][৮০] ডিক্যাপ্রিও ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জার্মান ফ্যাশন মডেল টনি গার্নের সাথে ডেট করেন এবং ২০১৭ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুনরায় একত্রিত হন।[৮১]
২০০৫ সালে একটি হলিউড পার্টিতে মডেল আরেথা উইলসন তার মাথায় ভাঙ্গা বোতল দিয়ে মারলে ডিক্যাপ্রিও মুখে আঘাতপ্রাপ্ত হন। ২০১০ সালে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর উইলসনকে দুই বছরের জেল দেওয়া হয়।[৭৮]