রক্তরস

মনে রাখবেন, উইকিপিডিয়া কোনো চিকিৎসীয় পরামর্শ দেয় না

রক্তরস হল রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি হালকা হলুদাভ তরল যা সাধারণত দেহের বিভিন্ন প্রকার রক্তকোষ ধারণ করে। মানব দেহের শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগই হল রক্তরস।[১] রক্তরস মূলত কোষপর্দার বাইরের রক্তগহ্বরের মধ্যকার তরল পদার্থ। এর ৯৫ শতাংশ হল জল এবং ৬-৮% (শতাংশ) বিভিন্নপ্রকার প্রোটিন (অ্যালবুমিন, গ্লোবুলিন, ফাইব্রিনোজেন),[২] গ্লুকোজ, ক্লোটিং উপাদান, ইলেক্টোপ্লেট (Na+, Ca2+, Mg2+, HCO3-, Cl-, ইত্যাদি), হরমোন এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড (রক্তরস বিপাকীয় সংবহনতন্ত্রের মূল মাধ্যম)। রক্তরস মানবদেহের আমিষ সংরক্ষণের কাজও করে থাকে। এটি রক্তগহ্বরের অভিস্রবণ প্রক্রিয়া অটুট রাখে যাতে রক্তে বিভিন্ন ইলেক্ট্রোলাইট যথানুপাতে বিদ্যমান থাকে এবং মানবদেহ জীবাণু সংক্রমণ ও বিবিধ রক্তবৈকল্য থেকে মুক্ত থাকে।[৩]

রক্তরসকে তৈরি করা হয় সেন্ট্রিফিউজে অ্যান্টিকোগুলেন্টেধারী বিশুদ্ধ রক্তের নলকে স্পিনিং করে; যতক্ষণ না রক্তকোষ নলের নিচে পড়ে যায়। এরপর রক্তরস অন্য একটি পাত্রে ঢেলে পৃথক করা হয়।[৪] রক্তরসের ঘনত্ব প্রায় ১০২৫ কেজি/মিটার, বা ১.০২৫ গ্রাম/মিলিলিটার[৫]

রক্ত সিরাম হল ক্লোটিং উপাদান ব্যতীত একধরনের রক্তরস।.[৪]

প্লাজমাফেরেসিস হল একধরনের মেডিকেল থেরাপি যার মধ্যে আছে রক্তরস এক্সট্রেকশন, চিকিৎসা এবং রিইনটিগ্রেশন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর সময় ইংল্যান্ডইউনাইটেড স্টেটে ব্যবহৃত শুকানো রক্তরস প্যাকেজ

গঠন

আয়নসাধারণ পরিমাণের পরিসর (মিলিমোল.১−১)
সোডিয়াম১৩৫–১৪৫
পটাশিয়াম৩.৬–৫.১
ক্লোরাইড৯৫–১০৫
ক্যালসিয়াম২.১-২.৮
রক্তপরীক্ষার স্বাস্থ্যকর পরিসর (রেফারেন্স রেঞ্জেস ফর ব্লাড টেস্ট), রক্তরসের উপাদানগুলোর সাধারণ পরিমাণ ভর অনুপাতে দেখাচ্ছে।
একই তথ্য, ভরের জায়গায় আয়তন অনুপাতে দেখানো হয়েছে।

রস আয়তন

রক্তরসের পরিমাণ কমে বা বেড়ে গিয়ে এক্সট্রাভাস্কুলার কলায় পরিণত হতে পারে। এরকম ঘটে থাকে যখন ধমনীর দেয়াল বরাবর স্টারলিং বলে পরিবর্তন হয়। উদাহরণস্বরুপ, যখন রক্তচাপ পড়ে ধমনীর শক ঘটে, স্টারলিং বল কলাকে তরল করে দেয় যাকে বলা হয় "থার্ড স্পেসিং

যদি কেউ দীর্ঘক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে ট্রান্সক্যাপিলারি হাইড্রোস্ট্যাটিক চাপের বৃদ্ধি ঘটে। এতে হেমাটোক্রিট, সিরাম টোটাল প্রোটিন, রক্ত সান্দ্রতা বেড়ে যায় এবং কোয়াগুলেশন উপাদানগুলোর ঘনত্বের বৃদ্ধিতে অর্থোস্ট্যাটিক হাইপারকোয়াগুলাবিলিটি (orthostatic hypercoagulability) ঘটে।[৬]

চিকিৎসাজগতে রক্তরসের ইতিহাস

১৯৪৩ সালের আগস্টে সিসিলিতে আহত হবার পর প্রাইভেট রায় ডব্লিউ হামফারিকে রক্তরস দেয়া হচ্ছে।

গর্ডন আর. ওয়ার্ড ব্রিটিড মেডিকেল জার্নাল-এ রক্তের পরিবর্তে রক্তরসের ব্যবহার এবং সংবহনের কাজে লাগানোর জন্য ১৯১৮ সালের মার্চে একটি প্রস্তাব করেন। শুকনো রস পাউডার অথবা স্ট্রিপ হিসেবে উপাদান বিন্যাস করার পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধে আমেরিকার যোগদানের পরপরেই রক্তরস ও রক্ত ব্যবহৃত হতে লাগল। ১৯৪০ সালের প্রথম দিকে ডাক্তার চার্লস ড্রিউর চেষ্টায় ইংল্যান্ডের জন্য রক্ত বা ব্লাড ফর ব্রিটেন কর্মসূচী বেশ সফল হয় (আমেরিকাতেও)। ১৯৪০ সালের আগস্টে রক্ত সংগ্রহের জন্য এবং ইংল্যান্ডে পাঠানোর জন্য নিউ ইয়র্কের হাসপাতালগুলিতে একটি বড় কর্মসূচী শুরু হয়। ড. ড্রিউকে ইংল্যান্ডের জন্য রক্তরস বা প্লাজমা ফর ব্রিটেন কর্মসূচীর জন্য তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়। এই সময়ে তার উল্লেখযোগ্য অবদান পরিবর্তিত হয়ে টেস্ট টিউব পদ্ধতিতে উপনীত হয় যা অনেক রক্ত গবেষককে প্রথম বিপুল উৎপাদন পদ্ধতির দিকে নিয়ে যায়।

তবু, সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য শুকনো রক্তরস প্যাকেজের সিদ্ধান্তটি উন্নীত হয় কারণ এটি ভাঙ্গন কমাবে এবং যোগাযোগ, প্যাকেজিং এবং সংরক্ষণ সহজতর করে।[৭] এর ফলশ্রুতিতে দুইটি টিন ক্যান, যাতে ৪০০ সিসি বোতল ছিল, এসে পৌছায়। একটি বোতলে প্রয়োজনমত পাতিত পানি ছিল যাতে রক্তরসকে পুনরায় তাজা করা যায়। তিন মিনিটের মধ্যে রক্তরস ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে এবং চার ঘণ্টার মত তাজা থাকে।[৮]

ব্রিটেনের জন্য রক্তরস আবিষ্কারের পরে ড. ড্রিউকে রেড ক্রস ব্লাড ব্যাংকের পরিচালক এবং রক্তসংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া পূর্বক আমেরিকা জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল-এর উপ-পরিচালক করা হয়। ড. ড্রিউ সামরিক সংস্থার পরিচালকের বিরুদ্ধের প্রতিবাদ করেছিলেন কারণ তারা রক্তসংগ্রহের ক্ষেত্রেও জাতিগত বিভাজন মেনে চলতেন। ড. ড্রিউ বলেছিলেন যে মানুষের রক্তের দিক দিয়ে কোন জাতি নেই, সকলের রক্তই এক। তিনি এও বলেন যে এর ফলে অনেক সৈনিককে মৃত্যুবরণ করতে হবে কারণ তারা "একই জাতি"র রক্তগ্রহণ করতে চায়।[৯]

যুদ্ধের শেষে আমেরিকান রেড ক্রস প্রায় ৬ মিলিয়ন রক্তরসের প্যাকেজ দিয়েছিল। এর বেশিরভাগই পরবর্তীকালে বেসামরিক ব্যবহারের জন্য আমেরিকায় ফিরিয়ে আনা হয়। কোরিয়ান যুদ্ধে সিরাম অ্যালবুমিন শুকনো রক্তরস-এর স্থানে ব্যবহৃত হয়।[১০]

রক্তরস দান

রক্তরস একধরণের রক্ত উপাদান এবং রক্তদান কর্মসূচীর মাধ্যমে রক্ত থেকে প্রস্তুত করা হয়। রক্ত পরিব্যপ্তির জন্য, সাধারণত তাজা হিমশীতল রক্তরস (ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা বা এফএফপি)-র জন্য ব্যবহৃত হয় এ রস। যখন সম্পূর্ণ রক্তদান করা হয় বা প্যাকড লোহিত রক্তকণিকা (প্যাকড রেড ব্লাড সেল বা পিআরবিসি) পরিব্যপ্ত হয়, তখন ও- সবচেয়ে আকাঙ্খিত রক্তগ্রুপ কারণ তারা বিশ্বদাতা। এবি+ গ্রুপের ব্যক্তিরা হলেন বিশ্বগ্রহীতা। তবে রক্তরস সংগ্রহের সময় বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত। রক্তরস সংগ্রহের জন্য রক্তসংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কেবলমাত্র এবি দাতাদের কাছ থেকেই অ্যাফেরেসিস প্রক্রিয়ায় রক্তরস সংগ্রহ করে থাকে কারণ তাদের রক্তরসে এমন কোন অ্যান্টিবডি থাকে না যা গ্রহীতার সাথে মিলবে না। কাজেই রক্তরস দানের ক্ষেত্রে এবি হল বিশ্বদাতা। শুধুমাত্র পুরুষ এবি রক্তরস দানের ক্ষেত্রে আলাদা কর্মসূচী পালন করা হয়ে থাকে কারণ তাদের পরিব্যপ্তী সম্পর্কিত ব্যাপক ফুসফুসীয় ক্ষত (ট্রান্সফিউশান রিলেটেড একিউট লাং ইনজুরি বা টিআরএএলআই) এবং নারী দাতাদের উচ্চ শ্বেত রক্তকণিকা অ্যান্টিবডি থাকতে পারে।[১১] যদিও কিছু গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায় যে টিআরএএলআই-এর অধিক বিপদ সত্ত্বেও গর্ভবতী মহিলাদের অধিক শ্বেতরক্তকণিকা অ্যান্টিবডি থাকতে পারে।[১২]

দাতার নিরাপত্তা এবং অর্থ

রক্তের চেয়ে রক্তরস কম সময়ের ব্যবধানে অধিকবার দেয়া যায় (প্রতি সপ্তাহে তিন বারের সাথে তুলনা করা হয় সম্পূর্ণ রক্তদানের ক্ষেত্রে প্রতি আট সপ্তাহে একবার) কারণ সম্পূর্ণ রক্তকোষগুলো দেহে পুনরায় ফিরে আসে। অধিকাংশ রক্তরস দাতার দেহে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসে। অবশ্য সম্পূর্ণ রক্তদানের ক্ষেত্রে রক্তরসদানকারীরা আর্থিক দিক দিয়ে ($১০-$১০০ প্রতি সপ্তাহে ৩-৭ ঘণ্টার জন্য, সাধারণত)। বিভিন্ন নৈতিক, ধার্মিক এবং সাংষ্কৃতিক কারণে এটি সময় এবং অসুবিধার জন্য দেয়া অর্থ, কোন অংশ বিক্রয় বা ক্রয়-এর জন্য না।

কৃত্রিম রক্তরস

কৃত্রিম দেহের তরল (সিমুলেটেড বডি ফ্লুইড বা এসবিএফ) এক ধরনের দ্রবণ যাতে মানবদেহের রক্তরসের সমপরিমাণ এবং সমঘনত্ব বিশিষ্ট উপাদান থাকে। এসবিএফ সাধারণত ধাতব ইমপ্ল্যান্টের পৃষ্ঠ মডিফিকেশনের জন্য এবং বর্তমানে জিন ডেলিভারিরর জন্য এর ব্যবহার রয়েছে।

আরো দেখুন

  • রক্তরস ফ্র্যাকশনিং
  • রক্ত প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্রোমোটোগ্রাফি

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী