মেন্ডীয়বাদ

অজ্ঞেয়বাদী একেশ্বরবাদী ধর্ম

মেন্ডীয়বাদ বা মান্দাই ধর্ম (ইংরেজি: Mandaeism আরবি: مَنْدَائِيَّة); একটি নস্টিক, একেশ্বরবাদী ধর্ম।[১]: এ ধর্মের অনুসারীরা আদম, অ্যাবেল, সেথ, ইনস, নুহ, শ্যাম, আরাম ও বিশেষভাবে জন দ্যা ব্যাপ্টিস্টকে শ্রদ্ধা করে থাকে। মেন্ডিয়ানরা জাতিতে সেমিটিক আর তাদের ভাষা হল পূর্ব অ্যারামাইক ভাষা যা মেন্ডাইক নামে পরিচিত। মেন্ডিয়ান নামটি এসেছে অ্যারামাইক মেন্ডা থেকে যার মানে জ্ঞান,[৭][৮] যা গ্রিক ভাষায় নসিস। তাদের সমাজ বাদে, মধ্যপ্রাচ্যে সাধারণত তারা 'সুব্বা' বা স্যাবিয়ান নামে পরিচিত। সুব্বা পদটি অ্যারামাইক মূল থেকে নেয়া হয়েছে যা খ্রিস্টান ব্যাপ্টিজমের সাথে সম্পর্কিত, অধুনা-ম্যানডিক ভাষায় যা স্যাবি।[৯] কোরান-এ ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের পাশাপাশি স্যাবিয়ানদের (আরবি: الصَّابِئُون‎) তিনবার উল্লেখ আছে। মাঝে মাঝে, মেন্ডিয়ানদের 'আসমানী গ্রন্থের মানুষ' বলে বর্ণনা করা হয়েছে।[১০]

মেন্ডীয়বাদ
ࡌࡀࡍࡃࡀࡉࡉࡀ
গিনজা রব্যা; মেন্ডীয়বাদের বিভিন্ন পবিত্র গ্রন্থের মধ্যে সর্ববৃহৎ
প্রকারভেদনস্টিক[১]
ধর্মগ্রন্থগিনজা রব্যা, কুওলুটা, and যোহনের আসমানী কিতাব
ধর্মতত্ত্বএকেশ্বরবাদ
মডারেটরসতার জাবার হিলো আল-জাহরোনি [২]
অঞ্চলইরাক এবং ইরান
ভাষামেন্ডাইক ভাষা[৩]
উৎপত্তিখ্রিষ্টাব্দ প্রথম তিন শতক[৪]
দক্ষিণ-পশ্চিম মেসোপটেমিয়া বা লেভান্ত[৪]
সদস্যআনু. ৬০,০০০[৫] - ৭০,০০০[৬]
অন্যান্য নামস্যাবিয়ানিস্ম
মান্দেয়ান দারফাশ, মেন্ডীয় বিশ্বাসের প্রতীক

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে, মেন্ডীয় ধর্ম প্রথম তিন খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর মধ্যে উদ্ভূত হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম মেসোপটেমিয়া অথবা সিরিয়া-ফিলিস্তিন অঞ্চলে।[৪] তবে কিছু বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন যে মেন্ডীইজম আরও পুরানো এবং খ্রিস্টান ধর্মের আগের থেকেই বিদ্যমান।[১১] মেন্ডীয়ানরা দাবি করে যে একেশ্বরবাদ বিশ্বাসে তারা ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্মেরও পূর্ব থেকে উপস্থিত।[১২]

এই ধর্ম প্রধানত কারুন, ইউফ্রেটিসটিগ্রিস নদীর তীরে এবং শাত-আল আরব খালের পাশের নদীগুলো, দক্ষিণ ইরাকের কিছু অংশে ও ইরানের খুজেস্তান রাজ্যে এ ধর্মের চর্চা করা হত। সারা পৃথিবীতে ৬০-৭০ হাজার মেন্ডীয়ানরা আছে বলে ধারণা করা হয়।[১৩] ইরাক যুদ্ধের সময় পর্যন্ত, তাদের বেশিরভাগই ইরাকে বাস করত।[১৪] আগামী সময়ে ২০০৩-এর ইরাক আক্রমণ, ও পরবর্তী মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর দখল, এবং চরমপন্থীদের বর্ধিয়মান সাম্প্রদায়িক হিংসার ফলে সৃষ্ট হুলুস্থূল-এর জন্য অনেক মেন্ডিয়ান ইরাকিরা তাদের দেশ থেকে পলায়ন করেছে।[১৫] ২০০৭-এর অনুসারে, ইরাকে মেন্ডিয়ানদের জনসংখ্যা প্রায় ৫,০০০ পর্যন্ত কমে গিয়েছে।[১৪]

মেন্ডিয়ানরা বিচ্ছিন্ন এবং অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে বাস করে। তাদের এবং তাদের ধর্মের বিষয়ে প্রতিবেদনগুলি মূলত বাইরের লোকদের কাছ থেকে এসেছে: বিশেষত জুলিয়াস হেনরিচ পিটারম্যান, একজন প্রাচ্যবিদ[১৬] এবং নিকোলাস সিউফি, একজন সিরিয়ান খ্রিস্টান যিনি ১৮৮৭ সালে মসুলে ফরাসি সহ-দূত ছিলেন[১৭][১৮] এবং ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী ভদ্রমহিলা ই.এস. ড্রোয়ার। ১৬৫০ এর দশক থেকে ফরাসি ভ্রমণকারী জিন-ব্যাপটিস্টে টেভেরনিয়ার[১৯] এর একটি পূর্বকালীন কিন্তু অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট বিবরণ আছে।

ইতিহাস

মেন্ডীয় গ্রন্থ 'হারান গাওয়াইতা' অনুযায়ী মেন্ডীয়দের যাত্রা শুরু হয় যখন নেসেরীয়রা ফিলিস্তিন ত্যাগ করে ও মেসোপটেমিয়ায় প্রথম শতাব্দীতে স্থানান্তরিত হয়। কারণ জেরুজালেমতে তাদেরকে অত্যাচার করা হয়েছিল যখন শহরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তারা প্রথমে হারানে (আধুনিক তুরস্ক) ও পরে ইরানের মিডিয়ান হিলে যায়। অবশেষে মেসোপটেমিয়ায় দক্ষিণ অংশে বসতি স্থাপন করে। মুসলিমরা যখন মেসোপটেমিয়া দখল করে তখন মেন্ডীয়দের নেতা আনুশ মুসলিমদের সামনে তাদের ধর্মগ্রন্থ গিনযা রাব্বা দেন।

মুসলিমদের তারা বলেন, তাদের প্রধান নবী জন দ্যা ব্যাপ্টিস্ট, ইসলামে ইয়াহিয়া নামে পরিচিত।

ধর্মীয় বিশ্বাস

ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ

মেন্ডীয়বাদ একটি ধার্মিক বিশ্বাস বা মতবাদের চেয়েও আসলে একটি সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত। ই.এস.ড্রাওয়ারের মতে মেন্ডিজমের নয়টি  বৈশিষ্ট্য রয়েছে,

  1. একজন সর্বোচ্চ আকৃতিহীন সত্তা
  1. দ্বৈতবাদ (একজন মহাজাগতিক পিতা ও মাতা)
  1. ধারণার জগত
  1. আত্মা একটি বন্দী সত্তা
  1. গ্রহ নক্ষত্ররা মানুষের ভাগ্যে প্রভাব ফেলে ও মানুষ মৃত্যুর পর সেখানে ফিরে যায়
  1. একজন ত্রাণকর্তা থাকেন যিনি জীবনে আত্মার সাথে ভ্রমণ করেন
  1. রুপক ও প্রতীকের একটি সাংকেতিক ভাষা
  1. রহস্য (যা আত্মাকে সাহায্য ও বিশুদ্ধ করে)
  1. ধর্মের নতুন অনুসারীদের মাঝে উচ্চ পর্যায়ের গোপনীয়তা বজায় থাকে

বিশ্বতত্ত্ব

মেন্ডীয়বাদে কোন সাজানো বিশ্ব তত্ত্ব নেই। মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে সে ব্যাপারে কোন একক বর্ণনা নেই। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনার সমন্বয় রয়েছে।  

প্রধান নবীগন

মেন্ডীয়রা বিভিন্ন নবীকে স্বীকার করে। যেমন ইয়াহিয়া ইবনে জাকারিয়া। তাকে মেন্ডীয়রা তাদের ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে না মানলেও বিশ্বাস করেন যে তার শিক্ষার মূল এসেছে নবী আদম থেকে। তারা ঈসা কে মিথ্যা মসীহ মনে করেন। তাছাড়া ইব্রাহীমমুসা কেও মিথ্যা নবী মনে করে। তবে নূহ ও বাইবেলের কিছু নবী যেমন এনস, শেম ও অ্যারামকে বিশ্বাস করে। তবে মুহাম্মদ সম্পর্কে তাদের কোনো মতামত নেই।

ধর্মগ্রন্থ

মেন্ডীয়দের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল গিনযা, যা ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব ও প্রার্থনার সমন্বয়ে গঠিত। গিনযা আবার দুই ভাগে বিভক্ত- বাম গিনযা ও ডান গিনযা। সবচেয়ে প্রাচীনতম গ্রন্থগুলো তৃতীয় শতাব্দীর। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পান্ডুলিপিগুলো ষোল শতাব্দীর আগের নয়, যার বেশিরভাগই ১৮ ও উনিশ শতাব্দীতে এসেছে। গিনযা সাসানীয় সাম্রাজ্যইসলামী খিলাফতের সময়ও বিকশিত হতে থাকে।

অনুসারী সংখ্যা

Mandaean Beth Manda (Mashkhanna) in Nasiriyah, southern Iraq in 2016

মেন্ডীয় ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা ৬০,০০০- ৭০,০০০ বলে মনে করা হয়।[২০] ইরাক যুদ্ধের ফলে তাদের স্থানীয় অঞ্চলে তাদের অংশ ভেঙ্গে পড়ে এবং ফলস্বরূপ তাদের বেশিরভাগ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যেমন ইরান, সিরিয়াজর্ডানে স্থানান্তরিত হয়। জর্ডানে আনুমানিক ২,৫০০ মেন্ডিয়ানরা আছে।[২১]

২০১১ সালে সৌদি আরব এর টিভি চ্যানেল আল আরাবিয়া ইরানে গোপন এবং হিসাববহির্ভূত ইরানীয় মেন্ডীয়দের সংখ্যা ৬০,০০০জন মতন অধিক বলে প্রকাশ করে।[২২] তবে হল্যান্ডের পত্রিকা দ্য হল্যান্ড সেন্টিনেল ২০০৯ সালে প্রকাশ করে যে ইরানে মেন্ডীয়দের সংখ্যা ক্রমে হ্রাস হচ্ছে, এবং ৫ হাজার থেকে ১০ হাজারে কমে গেছে।

অধিকাংশ মেন্ডিয়ানরা মধ্যপ্রাচ্যে বাস করে।.[২১] অনেক মেন্ডিয়ানরা মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে অভিবাসী সমাজ গড়ে তুলেছে, যেমন সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, এবং বিশেষত অস্ট্রেলিয়ায়, যেখানে প্রায় ১০,০০০জন বাস করে, প্রধানত সিডনির কাছাকাছি, সারা পৃথিবীর মোট মেন্ডিয়ানদের ১৫% নিবাস সেখানে।[২৩]

২০০২ সালে মার্কিন প্রাদেশিক বিভাগ তাদের সংরক্ষণশীল শরণার্থীর মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে রাজি হওয়ার পর, প্রায় ১,০০০ ইরানীয় মেন্ডিয়ানরা যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়।[২৪] ২,৫০০জনের একটি সমাজ উস্টার, ম্যাসাচুসেটস বাস করে বলে অনুমান করা হয়, যেখানে তারা ২০০৮ সাল থেকে বসবাস আরম্ভ করেছিল। অধিকাংশ ইরাক হতে আগত। [২৫]

মেন্ডিয়বাদে ধর্মপরিবর্তনের অনুমতি নাই। যেই মেন্ডিয়ানরা অন্য ধর্মের কারোর সাথে বিবাহসূত্রে বদ্ধ হয়, তাদের এবং তাদের বাচ্চাদের ধর্ম একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে আছে।

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী