মাহিষ্য

বাঙালি হিন্দু জাতি বিশেষ

মাহিষ্য হলো ঐতিহাসিকভাবে কৃষিপ্রধান বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়,[১][২] এবং অবিভক্ত বাংলায় বৃহত্তম জাতি গঠন করেছিল।[৩][৪] মাহিষ্যরা সম্ভবত সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বাঙালি জাতি ছিল এবং আছে যারা বৈষয়িক অবস্থা ও পদমর্যাদার দিক থেকে সম্ভাব্য সকল শ্রেণির মানুষ নিয়ে গঠিত একটি সমাজ ।[৫]

মাহিষ্য
রাণী রাসমণি, কলকাতার দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা মাহিষ্য পরিবারের
ধর্ম হিন্দুধর্ম
ভাষাবাংলা
জনবহুল অঞ্চলনদীয়া, ২৪ পরগণা, হাওড়া, হুগলী, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর, মালদহ, ঢাকা, কলকাতা (আনু. ১৯৩১ সালের আদমশুমারি)

১৯৩১ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুসারে, মাহিষ্যরা ভৌগলিকভাবে সমস্ত অবিভক্ত বাংলায় ছিল এবং বঙ্গদেশের হিন্দু জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ গঠন করেছিল, তবে তারা জনবহুল ভাবে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় প্রধানত বসবাস করত।[৬][৭][৮]

উৎস

বর্তমানের মাহিষ্য সম্প্রদায় পূর্বে চাষী কৈবর্ত, উত্তর রাঢ়ী কৈবর্ত, পূর্বদেশী কৈবর্ত, পরাশর দাস, চাষী দাস, হালিক দাস প্রভৃতি আঞ্চলিক নামে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচিত ছিল বা নিজেদের পরিচয় দিত।[৯][১০] মাহিষ্য নামটি নর্মদার তীরে অবস্থিত প্রাচীন মাহিষ্মতি নগরের নাম থেকে নেওয়া হয়েছিল।[১১]

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত যুগে বাংলার কলাইকুড়ি-সুলতানপুর তাম্রশাসন শিলালিপিতে কৈবর্তশর্ম্মা নামে এক ব্রাহ্মণ কুটুম্বিন(কৃষক গৃহস্থ)-এর উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি স্থানীয় সভার (অধিকরণ) সদস্য ছিলেন - এটি বাংলার ইতিহাসে কৈবর্ত নামের প্রথম উল্লেখ। ঐতিহাসিক স্বপ্না ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন যে বরেন্দ্রতে কৈবর্ত শুধুমাত্র জেলে এবং চাষী নয়, ব্রাহ্মণদেরও প্রতিনিধিত্ব করেছিল।[১২][১৩] পাল যুগের তাম্রশাসনে বরেন্দ্রতে উদ্ধন্নকৈবর্তবৃত্তিবহিকল ও ওসিন্নকৈবর্তবৃত্তি নামে দুটি জায়গা বা স্থানবাচক নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।[১৪]

গৌরিপদ চ্যাটার্জি উল্লেখ করেছেন, মেদিনীপুরের কৈবর্ত হলো উড়িষ্যা এবং মেদিনীপুরের পশ্চিমে অবস্থিত ছোটনাগপুর মালভূমির ভূইয়া আদিবাসী জনজাতির বংশধর এবং এই অঞ্চলে এদের সংখ্যাবল প্রচুর হওয়ায় এরা আর্যদের বাংলায় প্রবেশের সঙ্গেই সসম্মানে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে এবং প্রাচীন কালে এদের মধ্যে থেকে অল্প কিছু ব্রাহ্মণও হয়েছিল।[১৫] গদাধর ভট্টের কুলজি অনুযায়ী তমলুক, বালিসীতা (ময়না), তুর্কা, সুজামুঠা ও কুতুবপুরে কৈবর্তরা পাঁচটি ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।[১৬] আবুল ফজল লিখেছেন আকবরের রাজত্বকালে তমলুক এবং প্বার্শবর্তী অঞ্চলে মেদিনীপুরের জমিদাররা ছিল খান্ডায়ত ।[১৭] বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্তও তমলুক, ময়না, সুজামুঠায় কৈবর্ত ক্ষুদ্র জমিদার ছিলো।[১৬]

রিসলের মতে, কৈবর্তরা হলো আর্য ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা একটা জাতি। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে মাহিষ্যরা( চাষী কৈবর্ত) মূলনিবাসী জনগোষ্ঠী ও আর্য জাতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা জাতি। ভারতীয় বিজ্ঞানী ও পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের মতে, নৃতাত্ত্বিকভাবে কায়স্থ, সদগোপ, কৈবর্ত হলো "যথার্থ বঙ্গজন প্রতিনিধি"। [১৮][১৯]

প্রাচীন বাংলায়় মাহিষ্য খুব প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী ছিল ‌। বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার হলে এরা বেশিরভাগই বৌদ্ধ হয়ে যায় । পশ্চিমবঙ্গের চাষী কৈবর্ত ও পূর্ববঙ্গের মাহিষ্য(দাস ও পরাশর দাস) পরবর্তীতে একই সম্প্রদায় হিসেবে পরিগণিত হয়।[২০][২১]

পুরাণ, স্মৃতি ও সংহিতা

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান হল কৈবর্ত।[২২] গৌতম ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে এই ক্ষত্রিয় বৈশ্য সন্তান মাহিষ্য নামে উল্লেখিত হয়েছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী, শূদ্র পিতা ও ক্ষত্রিয় মাতার সন্তান হল দাস, এরা উত্তম সংকর পর্যায়ভুক্ত এবং এদের পেশা কৃষিকর্ম ।[২৩] [২৪] মনুসংহিতা অনুযায়ী, মাহিষ্যদের পেশা হয় জ্যোতির্বিদ্যা, সঙ্গীতচর্চা, নৃত্যশিল্প ও ফসলাদির রক্ষা করা ।সূতসংহিতাতে মাহিষ্যদের অম্বষ্ঠ বলা হয়েছে।[২৫][২৬]

ইতিহাস

বাংলার সর্ববৃহৎ, বৈচিত্র্যময় ও ঐতিহ্যপূর্ণ জনগোষ্ঠী হল মাহিষ্য। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে পূর্ব বঙ্গের মাহিষ্য তথা হালিক দাস ও পরাশর দাস ও পশ্চিমবঙ্গের চাষী কৈবর্ত একই জাতি ধরা হত। পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের সময় সামন্ত রাজা দিব্য-এর বিদ্রোহ করে বরেন্দ্রভূমি দখল এবং তিনি ও তাঁর দুই বংশধর রূদক ও ভীমের শাসন থেকে বোঝা যায় প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় রাষ্ট্র ও সমাজে মাহিষ্যদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল।[২৭][২৮] ইতিহাসবেত্তা রোমিলা থাপরের মতে সামন্ত রাজাদের নেতৃত্বে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এই লড়াই সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সফল কৃষক বিদ্রোহ ।[২৯][২৭] প্রাচীন বাংলায় মাহিষ্যরা রাজকর্মচারী ও রাজ্যশাসক ছিলেন। পূর্ববঙ্গের মাহিষ্যদের মধ্যে রাজকর্মচারী ও সভাকবি ছিলেন। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে ব্রাহ্মণ, অম্বষ্ঠ-বৈদ্য, করন-কায়স্থ ছাড়াও মাহিষ্যদের এক সম্প্রদায় খুব প্রভাবশালী ছিলেন এবং পরবর্তীতেও খুব সম্ভবত সেই প্রভাব অক্ষুন্ন রেখেছিলেন।[৩০]

ঊনবিংশবিংশ শতকের শেষের দিকে সমাজে কৈবর্ত বা মাহিষ্যদের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ লক্ষ্য করা গেছে। ১৮৬৪ সালে ঢাকার বিক্রমপুরে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ৬৪ জন ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের থেকে প্রথম ব্যবস্থাপত্র নেওয়া হয়‌। ঢাকার নান্নুর এর জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের উৎসাহে বসন্তকুমার রায় মাহিষ্যদের নিয়ে প্রথম গ্রন্থ লেখেন- "মাহিষ্য বিবৃতি" । ক্রমে এই আন্দোলন পাবনা, নদীয়া , মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, মেদিনীপুরে ছড়িয়ে পড়ে।[৩১] প্রাচীনপন্থী সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে, মাহিষ্যরা ক্ষুদ্র চাষী সম্প্রদায়ের যারা আধুনিকতাকে অর্থাৎ বিদ্যালয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত না। কিন্তু নদীয়া পন্ডিত কলেজের প্রেসিডেন্ট যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর ১৮৯৬ সালে বাংলার "হিন্দুবর্ণ ও সম্প্রদায়"-এর উপর রচিত প্রধান গ্রন্থ অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, মেদিনীপুরের কাঁথি ও তমলুক মহকুমায় যেখানে কৈবর্ত জনসংখ্যা অর্ধেকের বেশি এবং উচ্চবর্ণের সংখ্যা খুব কম, সেখানে কৈবর্তরাই সম্ভ্রান্ত শ্রেণী।[৩২] পূর্ববঙ্গের কিছু অঞ্চলে বিশেষত সিলেটে হালিক দাস বা মাহিষ্য ও বৈদ্য, কায়স্থদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল।[৩৩] মাহিষ্য একটি অবিশ্বাস্যভাবে বৈচিত্র্যময় জাতি ছিল।  ২৪ পরগণায় তারা সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় 'লাঠদার' জমিদারদের একটি বড় অংশ গঠন করে।  নদিয়া জেলায়, তারা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠন করেছিল এবং কিছু শ্রেণী ইউরোপীয় নীলকরদের কাছে 'সরকার' হিসেবে কাজ করে ধনী হয়েছিল। বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া, ফরিদপুর জেলায় জোতদার, কৃষক গৃহস্থ, কৃষিজাত পণ্যের ব্যবসায়ী ছিল মাহিষ্যরা। ঢাকা জেলায় মাহিষ্যেদের সকল উচ্চ ও মধ্যবিত্তই ছিল জমিদার এবং জোতদার ।[৩৪] কলকাতায় এক বিরাট মাহিষ্য দল ব্যবসায়ী ও আইনজীবী হিসেবে কাজ করত।[৩৫]  কলকাতায় কিছু বিখ্যাত জমিদার পরিবার - যেমন জানবাজারের মাড় পরিবার এবং টালিগঞ্জের বাওয়ালি মণ্ডল পরিবার মাহিষ্য ছিলেন। ঘাটাল, তমলুক, উলুবেড়িয়া মহকুমা অঞ্চলে প্রমুখ মণ্ডল, চৌধুরী, মাইতি, পাঞ্জা, বেরা ইত্যাদি পরিবারেরা রেশম উৎপাদন ও বাণিজ্য করে স্বচ্ছলতা অর্জন করেছিলেন ।[৩৬][৩৭] অপর দিকে মাহিষ্যদের মধ্যে বহু সংখ্যক আইনজীবী ও উদ্যোগপতিও ছিলেন। যেমন এরা ছিলেন ―  বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হাওড়ার আয়রন ফাউণ্ড্রি সেক্টরের আলামোহন দাশের পরিবার ও অসংখ্য সৎ ও বিনয়ী উদ্যোক্তারা। তবুও তাদের বেশিরভাগই মানুষজন ছিলেন সম্ভবত ক্ষুদ্র চাষীই। ১৮৬০ দশকে পূর্ব মেদিনীপুরের একচেটিয়া লবণের ব্যবসা বন্ধের ফলে তারা সে জমি পুনরুদ্ধার করে। সেই সঙ্গে কেউ কেউ গৃহস্থালির কাজে অথবা কৃষি মজদুর হিসাবে কাজ করতে থাকেন।[৩৮]

অনেকেই গ্রামীণ এলাকায় পুরুষানুক্রমে কৃষিকাজে লিপ্ত থাকেন, তবে মাহিষ্য সম্প্রদায়ের বহুসংখ্যক মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে হাওড়া ও কলকাতার শহুরে এলাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রশিক্ষিত কর্মী হিসাবে কাজ করতে থাকেন। হাওড়ায় মাহিষ্যেরা সংখ্যায় অনেক এবং একটি বড়ো অংশ সফল ব্যবসায়ী। বিশ শতকের শুরুতে জেলার বেশিরভাগ জমি ও কারখানার মালিক ছিলেন কায়স্থ সম্প্রদায়ের। কিন্তু ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৬৭ শতাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং - সামগ্রীর ব্যবসা মাহিষ্যেরা নিয়ে নেয়।[৩৯][৪০][৪১]

লৌকিক ধর্ম ও সংস্কৃতি

লৌকিক ধর্ম ও সংস্কৃতিতে মাহিষ্য সম্প্রদায়ের অবদান‌ ছিল অনেক। সপ্তদশ শতকে হুগলির সাধক কবি রামদাস আদক ধর্মমঙ্গল সাহিত্য শ্রী অনাদি মঙ্গল বা ধর্মপুরান রচনা করেন।[৪২][৪৩][৪৪] শিব সংকীর্তন বা শিবায়ন কাব্যে দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের কৃষিনির্ভর সমাজের দরিদ্র সামাজিক অবস্থা নিপুনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে; এ কাব্যে শিব নিজেই চাষী এবং গৌরী চাষী ঘরণী।[৪৫] বাংলার একটি ঐতিহ্যে শিব চাষী কৈবর্ত রূপে ভবানী ভর্তার সাথে অভিন্ন হয়ে গিয়েছন, অপর ঐতিহ্যে তিনি মৎস্যেন্দ্রনাথ রূপে যোগী ঈশ্বরে পরিণত হয়েছেন।[৪৬]

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বালকদাস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বালকদাসী সম্প্রদায়, যেটা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সাথে সম্পর্কিত কিন্তু স্বতন্ত্র একটা লৌকিক ধর্ম সম্প্রদায় ছিল, যেখানে গোপাল বা বালককৃষ্ণ উপাস্য দেবতা ছিল। যশোর-খুলনা অঞ্চলের অনেক ছোট ব্যবসায়ী এবং কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁর শিষ্য হয়েছিল। বালকদাস চৈতন্য মহাপ্রভুর অচিন্ত্য ভেদ অভেদ তত্ত্ব সরল ও বোধগম্য করে শিষ্যদের দীক্ষা দিতেন ।[৪৭] অষ্টাদশ শতকের শেষে নদীয়ার মেহেরপুরে হাড়ি জাতির বলরাম হাড়ি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলরামী সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র একটি লৌকিক ধর্ম ছিল কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে এক মাহিষ্য তনু মণ্ডল ( বা পাল) এবং পরবর্তীতে অন্য মাহিষ্যরা এই সম্প্রদায়ের "সরকার" বা গুরু হতে শুরু করার পর থেকে এই লৌকিক সম্প্রদায়ের সংস্কৃতায়ন শুরু হয়। ১৮৭২ সালে নদীয়া , বর্ধমান, বীরভূম, পুরুলিয়া, কলকাতা, পাবনা, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর জেলার থেকে প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ এই সম্প্রদায়ের অনুসারী ছিল।[৪৮] অন্যদিকে বাওয়ালির মণ্ডল জমিদাররা ও জানবাজারের রাণী রাসমণির পরিবার পরম্পরাগত বৈষ্ণবশাক্ত ধর্মের পৃষ্ঠাপোষকতা করেছিলেন।[৪৯]

স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা

নদীয়ার দুই ক্ষুদ্র জমিদার ও মহাজন - দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস - নদীয়া ও যশোহরের কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং একটি লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করেন। এই অঞ্চলে তাঁরা নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন এবং বিদ্রোহের পরবর্তীতে কৃষকদের ঋণ শোধ করেন। এই বিদ্রোহে অন্যান্য কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষ, পূর্বতন নীলকুঠির কর্মচারী এবং গ্রাম প্রধানরা (মণ্ডল) ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন।[৫০][৫১]

মাহিষ্যরা কংগ্রেস পরিচালিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে।[৫২][৫৩] ১৯১৩ সালে "মাহিষ্য সমাজ" পত্রিকা থেকে জানা যায় নদীয়ার জমিদার ও "মাহিষ্য ব্যাংকিং এন্ড ট্রেডিং" কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর গগনচন্দ্র বিশ্বাস ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে করাচি গিয়েছিলেন ।[৫৪] দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ১৯১৯ সালে ইউনিয়ন বোর্ড করের বিরুদ্ধে মাহিষ্যদের নেতৃত্ব দেন যা পরে মেদিনীপুরে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে একীভূত হয়।[৫৫] তিনি ১৯২০-এর দশকে কলকাতার মেয়র পদে সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় (১৯৩০-৩৪) মাহিষ্যরা তমলুক এবং কাঁথি অঞ্চলে ব্রিটিশ প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে ভবিষ্যত আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করেছিল।[৫৬]

১৯৪০ এর দশকে কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মাহিষ্যেরা মেদিনীপুরে ও দক্ষিণ বঙ্গে সামগ্রিকভাবে ছিলেন আসল শক্তি। প্রকৃতপক্ষে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বেশিরভাগ নেতা ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন মাহিষ্য। তারা তমলুকে সমান্তরাল জাতীয় সরকার  ― তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠন করেন এবং এটি প্রায় দু-বছর চলেছিল। সরকারের নিজস্ব সেনাবাহিনী,  বিচার ব্যবস্থা ও অর্থ দপ্তর ছিল।[৫৭][৫৮]

বর্ণ অবস্থান

ঊনবিংশ শতকের বাংলায় চাষী কৈবর্তকে সৎশুদ্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যদিও জালিয়া কৈবর্ত এবং কৈবর্তের পুরোহিতরা অশুচি হিসাবে বিবেচিত হত।[৫৯] বাংলার বর্ণ কাঠামোতে মাহিষ্যরা সাধারণত 'মধ্যম-বর্ণ' হিসেবে বিবেচিত হয়।[৬০][৬১] দক্ষিণ ভারতে যেমন সমাজ পুরোহিত, অপুরোহিত- এই ভাবে বিভক্ত ছিল; উত্তর ভারতের মতো চার বর্ণের অস্তিত্ব ছিল না। বাংলাতেও সমাজে অব্রাহ্মণ সকলকেই বিভিন্ন মর্যাদার শূদ্র বা সংকর পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার এর কারণ হিসেবে বলেছেন, অতীতে বাংলায় তন্ত্র ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য ছিল; কিছুুু শ্রেণীর ব্রাহ্মণ এভাবে সমাজকে বিভক্ত করেন । অধ্যাপক মজুমদার এর মতে প্রাচীনকাল থেকেই কৈবর্তরা দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল- কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী।[৬২][৩৫]

১৯০১ সালে, মাহিষ্যরা নিজেদেরকে বৈশ্য বলে দাবি করেছিল, যে মর্যাদা তাদের পুরোহিত, গৌড়াদ্য ব্রাহ্মণরাও মহিষ্যদের জন্য দাবি করেছিলেন। ১৯৩১ সালের আদমশুমারিতে, তারা নিজেদের ক্ষত্রিয় বা মাহিষ্য ক্ষত্রিয় হিসাবে নথিভুক্ত করার দাবি করে।[৬৩][৬৪][৬৫] ঐতিহাসিক জ্যোতির্ময়ী শর্মা অভিমত দিয়েছেন যে মাহিষ্যদের বর্ণ মর্যাদা 'বিতর্কের বিষয়'।[৬৬]

আর্থসামাজিক অবস্থা

যদিও মাহিষ্যদের আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সাফল্য উল্লেখযোগ্য, তারা প্রায়শই তাদের কৃষিভিত্তিক শিকড়ের কারণে অপদস্থ হয়েছিল। মাহিষ্যরা কায়িক শ্রমের বিরুদ্ধাচরণ করেনি, যা প্রায়ই "উচ্চ বর্ণের" মধ্যে অভিজাতদের দ্বারা হেয় প্রতিপন্ন করা হত।[৬৭] উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৪ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল ​​কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদের জন্য যখন সুভাষচন্দ্র বসু এবং বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল, যা তখন বাংলার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করত, বোস বিজয়ী হয়েছিলেন। যদিও চিত্তরঞ্জন দাস প্রথমে শাসমলের রাজনৈতিক অবদানের জন্য তাকে ওই পদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তিনি শীঘ্রই পিছু হটলেন যখন তিনি জানতে পারলেন যে এই নির্বাচন শহরের কায়স্থ চক্রকে অখুশি করবে। যাঁদের মধ্যে একজন এতদূর গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন: 'মেদিনীপুরের কেওট থেকে কলকাতায় এসে শাসন করবে?’ আবার একটি সংবাদপত্র রিপোর্ট করেছিল যে উড়ে বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে শাসমলকে অবমাননাকর স্লোগান দিয়ে ভর্ৎসনা জানানো হয়েছিল এবং এই পদের জন্য তাঁর দাবি বাতিল করা হয়েছিল।[৬৮] শাসমল চরম অপমান ও ক্রোধে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি ত্যাগ করেন, এবং কাঁথি ও মেদিনীপুরের তাঁর নিয়ন্ত্রণের স্থানীয় রাজনীতি ও ওকালতি পেশায় চলে যান।[৬৯]

১৯২১ সালের আদমশুমারিতে মাহিষ্যদের "ডিপ্রেসড ক্লাস" তালিকায় চাষী-কৈবর্ত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর ব্যক্তিরা এটি অস্বীকার করেছিল কারণ তারা বিশ্বাস করেছিল যে এরফলে তাদের "উচ্চ বর্ণের হিন্দু" হওয়ার দাবি নস্যাৎ হয়ে যেত। [৭০] ১৯৪৬ সালে, যাইহোক, মাহিষ্যদের একটি জাতি সমিতি নির্দেশ করেছিল যে তারা বাংলার "মধ্যমবর্গ এবং অবদমিত" জাতিগুলির মধ্যে ছিল কারণ তাদের বৈধ দাবি এবং চাকরিতে অংশীদারিত্ব থেকে পরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। তারা ভারতের ব্রিটিশ সরকারকে "বর্ণ হিন্দু" এবং তফসিলি জাতিদের থেকে আলাদা নির্বাচকমণ্ডলী প্রদান করে, শিক্ষা, সমস্ত বিভাগে নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ সুবিধা প্রদানের দাবি করেছিল।[৭১]

মণ্ডল কমিশন পশ্চিমবঙ্গের ১৭৭টি "অনগ্রসর শ্রেণীর" তালিকায় চাষী-কৈবর্ত এবং মাহিষ্য উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১৯৮৯ সাল থেকে, কমিশনের প্রস্তাবগুলি কার্যকর হওয়ার পরে, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মাহিষ্যদের মধ্যে একটি অংশ ওবিসি মর্যাদার জন্য প্রচারণা চালায়। যদিও এর বিরোধিতা করেছিল সচ্ছল শ্রেণীর কিছু ব্যক্তি, যারা এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে সেন কমিশন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে চাষী-কৈবর্ত একটি অনগ্রসর শ্রেণী গঠন করেছিল এবং মাহিষ্য নামে এটি রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণী ছিল না। এইসময় থেকে এদের মধ্যে যে কেউ নিজেদের চাষী কৈবর্ত বলে নথি দেখিয়ে ওবিসি হতে পারে। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে, চাষী-কৈবর্তকে ওবিসি মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। ২০১০-এর দশকে মুসলিম এবং কিছু হিন্দু গোষ্ঠীকে ওবিসি এর মর্যাদা দেওয়া হয় । ২০১০-এর দশকের গোড়া থেকেই মাহিষ্যরা তাদের সমগ্র বর্ণের জন্যই ওবিসি দাবি করে আন্দোলন চালাচ্ছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত মাহিষ্যরা "জেনারেল কাস্ট" শ্রেণীভুক্ত এবং বাংলার বৃহত্তম গোষ্ঠী গঠন করেছে।[৭২][৭৩][৭৪]

উপনাম সমূহ

মাহিষ্য সমাজে প্রচলিত উপনাম বা পদবীর মধ্যে বৈচিত্র অনেক বেশি। উপনাম গুলি অন্যান্য সমাজ বা সম্প্রদায়ের মধ্যেও অনেক দেখা যায়। মাহিষ্য সমাজের প্রধান কিছু পদবী হলো - বিশ্বাস, মণ্ডল/মন্ডল, সরকার, মজুমদার, দাস/দাশ, ভৌমিক, জোয়ার্দার, নায়েক, খাঁ, তালুকদার, তরফদার, শিকদার, লস্কর, রায়, চৌধুরী, মহালদার, হালদার, পুরকাইত, আদক, সাঁতরা, হাজরা, ভাণ্ডারী, ভূঁইয়া, সামন্ত, শাসমল, বৈদ্য , জানা, বেরা, ঘড়াই, ধাড়া, গিরি, মান্না, দিন্দা, কারক, বারিক, কোলে, পাঁজা, গুছাইত, প্রধান, পাল, সাহা, বাগ, কাঁড়ার, সিংহ, হাইত, দে, গলুই, দলুই, ধর, নিয়োগী, প্রামানিক, গায়েন, খাঁড়া, কয়াল, মাজী, শীট, বক্সী, রায়চৌধুরী, পাত্র, মহাপাত্র প্রভৃতি।[৭৫][৭৬]

বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী