আয়া সোফিয়ায় কনস্টান্টিনের মোজাইক, অংশ: কনস্টান্টিনোপলের পৃষ্ঠপোষক সন্তু হিসেবে মারিয়া, বিশদ: শহরের মডেল সহযোগে সম্রাট প্রথম কনস্টান্টিনের প্রতিমূর্তি
মহান কনস্টান্টিন বা সন্ত কনস্টান্টিন[৬] নামে সুপরিচিত প্রথম কনস্টান্টিন (ফ্লাভিউস ভালেরিউস কনস্তান্তিনুস; ২৭ ফেব্রুয়ারি আনু. ২৭২ - ২২ মে ৩৩৭) ৩০৭ হতে ৩৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমান সম্রাট ছিলেন। তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা প্রথম রোমান সম্রাট।[ছ] ডেসিয়া মেডিটারেনিয়ার নাইসুসে (বর্তমান নিশ, সার্বিয়া) জন্মগ্রহণকারী কনস্টান্টিন ইলিরীয় বংশোদ্ভূত রোমান সামরিক কর্মকর্তা ও টেটরার্কির চারজন শাসকের একজন ফ্লাভিউস কনস্টান্টিউসের পুত্র। তার মাতা হেলেনা নিম্ন জাতির গ্রিক খ্রিস্টান নারী ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি সন্ত হিসেবে সিদ্ধি লাভ করে তার পুত্রকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। কনস্টান্টিন রোমান সম্রাট ডাইয়োক্লিশন ও গালেরিউসের অধীনে সামরিক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূর্বের প্রদেশসমূহে (পার্সিদের বিরুদ্ধে) আক্রমণ চালানোর মধ্য দিয়ে তার সামরিক জীবন শুরু করেন এবং ৩০৫ খ্রিস্টাব্দে তার পিতার সাথে পশ্চিমে ব্রিটেনে যুদ্ধ করার জন্য যোগদান করেন। ৩০৬ খ্রিস্টাব্দে তার পিতার মৃত্যুর পর কনস্টান্টিন সম্রাট হন। এবোরাকুঁয়ে (ইয়র্ক, ইংল্যান্ড) তার সেনাবাহিনী তাকে সম্রাট হিসেবে স্বীকার করে নেয় এবং ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে গৃহযুদ্ধে সম্রাট মাক্সেন্তিউস ও লিসিনিউসকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে রোমান সাম্রাজ্যের একক শাসক হয়ে ওঠেন।
সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আসীন হওয়ার পর কনস্টান্টিন তার সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে অসংখ্য সংস্কার কার্যক্রম করেন। তিনি সরকার ব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তন করেন এবং বেসামরিক ও সামরিক দপ্তর পৃথক করেন। মুদ্রাস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে তিনি নতুন স্বর্ণমুদ্রা সোলিদুস বাজারে ছাড়েন যা বাইজেন্টিনীয় ও ইউরোপীয় মুদ্রাব্যবস্থার মানদণ্ড হিসেবে এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে টিকে ছিল। রোমান সেনাবাহিনীকে অভ্যন্তরীণ হুমকি ও বার্বারীয়দের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য চলমান দল (কমিতাতেন্সেস) এবং গ্যারিসন দলে (লিমিতানেই) ভাগ করা হয়। কনস্টান্টিন ফ্রাঙ্ক, আলেমান্নি, গোথ, সারমাতি প্রভৃতি রোমান সীমান্তবর্তী জাতির বিরুদ্ধেও জয় লাভ করেন এবং রোমান সংস্কৃতির জনগণের তৃতীয় শতাব্দীর সংকটকালীন তার পূর্বসূরীদের পরিত্যাগ করা অঞ্চলসমূহে পুনরায় বসতি স্থাপন করেন।
যদিও কনস্টান্টিন তার জীবনের বেশিরভাগ সময় পৌত্তলিক ও পরে ক্যাটিকিউমেন হিসেবে কাটান। তিনি ৩১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টধর্মকে পক্ষে কাজ শুরু করেন এবং খ্রিস্টান হন। তিনি আর্য বিশপ নিকোমিডিয়ার ইউসেবিয়াস অথবা পোপ প্রথম সিলভেস্টারের নিকট বাপ্তিস্ম গ্রহণ করেন। প্রথম মতটি উল্লেখযোগ্য আর্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব দ্বারা সত্যায়িত এবং দ্বিতীয় মতটি ক্যাথলিক চার্চ ও আলেক্সান্দ্রীয় কিবতীয় সনাতনপন্থী মণ্ডলী মেনে চলে। তিনি ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে মিলানের ফরমান জারির ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেন, যার মাধ্যমে রোমান সাম্রাজের খ্রিস্টধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার ঘোষণা দেওয়া হয়। তিনি ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে নিসিয়ার প্রথম কাউন্সিল গঠন করেন যা নিসিন ধর্মবিশ্বাস নামে পরিচিত খ্রিস্টান বিশ্বাসের নির্বচন তৈরি করে। জেরুসালেমে যিশুর সমাধির কথিত স্থানে তার নির্দেশে চার্চ অব দ্য হলি সেপুলচার তৈরি করা হয় এবং একে সমস্ত খ্রিস্টান জগতের পবিত্রতম স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হত। উচ্চ মধ্যযুগে কনস্টান্টিনের মনগড়া দানের উপর ভিত্তি করে পোপরা অস্থায়ী ক্ষমতা দাবি করে। তাকে ঐতিহাসিকভাবে "প্রথম খ্রিস্টান সম্রাট" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং তিনি খ্রিস্টান মণ্ডলীর পক্ষে ছিলেন। যদিও কিছু আধুনিক বিদ্বান তার বিশ্বাস ও এমনকি খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে তার উপলব্ধি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন,[জ]পূর্বদেশীয় খ্রিস্টধর্মে তাকে সন্ত হিসেবে সম্মান করা হয় এবং তিনি খ্রিস্টধর্মকে রোমান সংস্কৃতির মূলধারার অংশ করার জন্য ভূমিকা পালন করেন।
কনস্টান্টিনের যুগ রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র যুগ এবং ধ্রুপদী প্রাচীনত্ব থেকে মধ্যযুগে পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত।[৯] তিনি বাইজেন্টিয়াম শহরে সম্রাটের নতুন বাসভবন তৈরি করেন এবং এর নামকরণ করেন নোভা রোমা। পরে সম্রাটের সম্মানার্থে সবাই এটিকে কনস্টান্টিনোপল ডাকা শুরু করলে তিনি এই নামটি গ্রহণ করেন, যেখানে আধুনিক ইস্তাম্বুল অবস্থিত। এটি পরবর্তীকালে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল, পরবর্তী পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যকে প্রায়শই ইংরেজিতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য নামে ডাকা হয়। জার্মান ইতিহাসবিদ হাইয়েরোনিমাস উল্ফ কর্তৃক উদ্ভাবিত এই নামটি এই সাম্রাজ্য কখনও ব্যবহার করত না। তার আরও সমকালীন রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ছিল যে তিনি তার পুত্র এবং কনস্টানটিন রাজবংশের অন্যান্য সদস্যদের কাছে সাম্রাজ্য ছেড়ে দিয়ে রাজবংশের উত্তরাধিকারের ডি ফ্যাক্টো নীতি দিয়ে ডাইয়োক্লিশনের টেটরার্কিকে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন। তার খ্যাতি তার সন্তানদের জীবদ্দশায় এবং তার রাজত্বের কয়েক শতাব্দী ধরে বিকাশ লাভ করে। মধ্যযুগীয় গির্জা তাকে সদগুণের প্রতিমূর্তি হিসেবে এবং ধর্মনিরপেক্ষ শাসকরা তাকে আদর্শ ও সাম্রাজ্যবাদী বৈধতা ও পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করত।[১০]রেনেসাঁর শুরুতে কনস্টান্টিন-বিরোধী উৎসসমূহের পুনঃআবিষ্কারের ফলে তার রাজত্বের আরও ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিল। আধুনিক এবং সাম্প্রতিক পাণ্ডিত্যমূলক রচনায় পূর্ববর্তী পাণ্ডিত্যের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
ওরিয়ায় কনস্টানটাইন দ্য গ্রেটের মূর্তি
উৎস
কনস্টান্টিন একজন গুরুত্বপূর্ণ শাসক এবং সবসময় একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন।[১১] তার রাজত্বকালের প্রাচীন উৎসসমূহে তার খ্যাতির ওঠানামা প্রতিফলিত হয়। এই উৎসের পরিমাণ অনেক এবং তার বর্ণনার পরিধিও বিশাল,[১২] তবে তা সেই সময়কালের দাপ্তরিক প্রচারণার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত,[১৩] এবং প্রায়ই একপাক্ষিক।[১৪] তার জীবন ও শাসন নিয়ে কোনো সমসাময়িক ইতিহাস বা জীবনী টিকে নেই।[১৫] ৩৩৫ থেকে আনুমানিক ৩৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে[১৬] ইউসিবিয়াসের উচ্চ প্রশংসামূলক রচনা ও সাধু মহাপুরুষদের জীবনীর সংমিশ্রণ ভিতা কনস্তান্তিনি,[১৭] যা কনস্টান্টিনের নৈতিক ও ধর্মীয় গুণাবলীর প্রশংসা করে।[১৮]ভিতা কনস্টান্টিনের বিতর্কের সাথে ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে,[১৯] কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবিদগণ প্রায়ই এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন।[২০] কনস্টান্টিনের সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ জীবনী হল বেনামী লেখকের ওরিগো কনস্তান্তিনি,[২১] যার রচনাকালও অনিশ্চিত।[২২] এতে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়াবলিকে উপেক্ষা করে সামরিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে দৃষ্টি নিবন্ধ করে।[২৩]
ডাইয়োক্লিশানের রাজত্ব ও টেটরার্কি নিয়ে লাক্তান্তিউসের লেখা রাজনৈতিক খ্রিস্টীয় পুস্তিকা দে মর্তিবাস পার্সেকুতোরুম কনস্টান্টিনের পূর্বসূরীদের ও তার প্রারম্ভিক জীবনের মূল্যবান কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক বর্ণনা প্রদান করে।[২৪]সক্রেটিস, সোজোমেন ও থিওডোরেটের খ্রিস্টধর্মীয় ইতিহাস কনস্টান্টিনের রাজত্বকালের শেষভাগের খ্রিস্টধর্মীয় বিরোধসমূহ বর্ণনা করে।[২৫] কনস্টান্টিনের রাজত্বকালের এক শতাব্দীর পর দ্বিতীয় থিওডোসিয়াসের (রাজত্বকাল ৪০২-৪৫০) সময়কালের রচিত এইসব খ্রিস্টধর্মীয় ইতিহাসবিদগণ ভুল নির্দেশনা, ভুল উপস্থাপনা এবং ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতার মাধ্যমে কনস্টান্টিনীয় সময়কালের ঘটনাবলি ও ধর্মতত্ত্বকে অস্পষ্ট করে তুলে।[২৬] গোড়াবাদী খ্রিস্টান আথানাসিউসের লেখনী ও ফিলোস্তোরজিউসের আর্যবাদী খ্রিস্টধর্মীয় ইতিহাসও এখনও টিকে আছে, তবে তাদের পক্ষপাতও বেশ দৃঢ়।[২৭]
আউরেলিউস ভিক্তরের দে কিসারিবুস, ইউত্রোপিউসের ব্রেভিয়ারিউম, ফেস্তুসের ব্রেভিয়ারিউম শীর্ষক সারসংক্ষেপ এবং অজানা লেখকের ইপিটমি দে সিজারিবুস সেই সময়ের সংক্ষিপ্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক এবং সামরিক ইতিহাসের বিবৃত করে। খ্রিস্টান না হলেও এই সারসংক্ষেপসমূহে কনস্টান্টিনের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরে কিন্তু কনস্টান্টিনের ধর্মীয় নীতির প্রসঙ্গসমূহ বাদ দেয়।[২৮] ৩য় শতাব্দীর শেষভাগে ও ৪র্থ শতাব্দীর শুরুর দিকের স্তুতি সংকলন প্যানিজিরিক লাতিনি কনস্টান্টিনের টেটরার্কি যুগের রাজনীতি ও মতাদর্শ এবং প্রারম্ভিক জীবনের মূল্যবান তথ্য প্রদান করে।[২৯]রোমে কনস্টান্টিনের ধনুকাকৃতির খিলান এবং গামজিগ্রাদ ও কর্দোবার প্রাসাদের মত সমসাময়িক স্থাপত্যের অধিলিপি[৩০] এবং সেই যুগের মুদ্রা সাহিত্যের উৎসের পরিপূরক।[৩১]
পরিবার
মহান কনস্টান্টিনের পরিবার
গোলাকৃতির বাক্স আউগুস্তি হিসেবে তারিখসহ সম্রাটদের চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়েছে। ১: কনস্টান্টিনের পিতামাতা ও সৎ ভাইবোন
Henry Stuart Jones (1911). "Constantine (emperors)". In Chisholm, Hugh (ed.). Encyclopædia Britannica. 6. (11th ed.), Cambridge University Press. pp. 988–992.
Charles George Herbermann and Georg Grupp (1908). "Constantine the Great". In Catholic Encyclopedia. 4. New York: Robert Appleton Company.