মহাকাশ যাত্রা

মানুষ প্রযুক্তিগত বিকাশের বর্তমান পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত বিষ্ফোরণ দ্বারা ভূমি থেকে মহাকাশ অভিমুখে দ্রুতবেগে নিক্ষিপ্ত যানে করে মহাকাশ যাত্রা করতে পারে। এসব মহাকাশযান যাত্রীবাহী কিংবা যাত্রীবিহীন, দুই ধরনেরই হয়ে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইয়ুরি গ্যাগারিন ছিলেন মহাকাশ যাত্রাকারী প্রথম মানব। যাত্রীবাহী মহাকাশযাত্রার প্রসিদ্ধ কিছু উদাহরণ হল মার্কিন অ্যাপোলো প্রকল্প, রুশ সয়ুজ প্রকল্প, এবং বর্তমানে পৃথিবী প্রদক্ষিণরত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। যাত্রীবিহীন মহাকাশযাত্রার উদাহরণ হল পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমণকারী বহু কৃত্রিম উপগ্রহ, এবং পৃথিবীর কক্ষপথ ত্যাগকারী স্পেস প্রোবসমূহ। যাত্রীবিহীন মহাকাশযানসমূহ পৃথিবী হতে বেতার সংকেত দ্বারা দূরনিয়ন্ত্রিত, তবে অনেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেও কাজ করে।

মহাকাশ যাত্রার প্রধান বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য মহাকাশ অনুসন্ধান, এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে যোগাযোগব্যবস্থায় যুক্ত উপগ্রহ এবং মহাকাশ আনন্দভ্রমণ। এছাড়া মহাকাশযাত্রার অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে মহাকাশ পর্যবেক্ষণাগার, গুপ্তচর উপগ্রহ, এবং পৃথিবী পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ।

মহাকাশযাত্রার প্রচলিত প্রথম ধাপ হচ্ছে রকেট উৎক্ষেপন, যা পৃথিবীর অভিকর্ষ অতিক্রম করার মত শক্তির যোগান দেয়, এবং মহাকাশযানকে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মহাকাশে নিক্ষেপ করে। মহাকাশে পৌঁছানোর পর মহাকাশযানের যান্ত্রিক এবং এবং স্বাধীন গতিবিধি জ্যোতির্গতিবিদ্যার বিষয়ভুক্ত। কিছু মহাকাশযান অনির্দিষ্টকাল মহাকাশে অবস্থানের উদ্দেশ্যে উৎক্ষিপ্ত, কিছু যান পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুন:প্রবেশকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত, এবং কিছু যান গবেষণার উদ্দেশ্যে পৃথিবীভিন্ন অন্য গ্রহ, উপগ্রহ এবং গ্রহাণুপৃষ্ঠে অবতরণ করেছে।

ইতিহাস

রকেটের সাহায্যে মহাকাশে যাত্রার প্রথম তত্ত্বীয় প্রস্তাবনা পাওয়া যায় স্কটিশ জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম লেইচ এর লেখা ১৮৬১ সালের মহাকাশে ভ্রমণ (A Journey Through Space) নিবন্ধে[১]। এর চেয়ে সুপরিচিত (অবশ্য শুধু রাশিয়ার অভ্যন্তরে) প্রাসঙ্গিক কাজ হল ১৯০৩ সালে কনস্তানতিন ত্‌শিওলকোভস্কির লিখিত প্রতিক্রিয়াশীল যন্ত্র দ্বারা মহাকাশীয় অনুসন্ধান ("Исследование мировых пространств реактивными приборами")[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

মহাকাশযাত্রা তত্ত্বীয় আলোচনার বাইরে এসে বাস্তবায়নযোগ্য সম্ভাবনা অর্জন করে রবার্ট এইচ গডার্ডের চরম উচ্চতায় পৌঁছানোর একটি পদ্ধতি (A Method of Reaching Extreme Altitudes) (১৯১৯) নিবন্ধটির মধ্য দিয়ে। তরল জ্বালানী রকেটে ডি লাভাল নল ব্যবহার করে তিনি রকেটের কার্যক্ষমতাকে আন্তগ্রহ ভ্রমণের পর্যায়ে পৌঁছে দেন। এছাড়া তিনি গবেষণাগারে প্রমাণ করেন যে মহাকাশের ভ্যাকুয়ামেও রকেটের কার্যকারিতা বজায় থাকবে।[উল্লেখ করুন] তথাপি তার এসব অবদান সমকালীন জনপ্রিয়তা পায়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে গডার্ড রকেট-নিক্ষিপ্ত অস্ত্র উৎপাদনের সামরিক চুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে জার্মানির অস্ত্রসংবরণের কারণে তার এ প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। পরবর্তীতে ১৯২৬ সালে ব্যক্তিপর্যায়ের আর্থিক সমর্থনে তিনি ইতিহাসের সর্বপ্রথম তরল-জ্বালানীর রকেট উড্ডয়ন করতে সক্ষম হন।

হের্মান ওবের্ট গডার্ডের কাজ দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, এবং তার কাছ থেকে ভের্নার ফন ব্রাউন অনুপ্রেরণা নেন। আডলফ হিটলারের অধীনে কর্মরত অবস্থায় ব্রাউন সর্বপ্রথম রকেটচালিত নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেন। তার তৈরি ভি-২ ছিল মহাকাশে পৌঁছানো প্রথম রকেট, যা ১৯৪৪ এর জুনে একটি পরীক্ষামূলক উড্ডয়নে ১৮৯ কিলোমিটার (১০২ নটিক্যাল মাইল) উচ্চতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।[২]

ভের্নার ফন ব্রাউন, মহাকাশে পৌঁছানো প্রথম রকেটের আবিষ্কর্তা (১৯৬০ সালে ধারণকৃত ছবি)।

ত্‌শিওলকোভস্কির রকেট গবেষণা তার জীবনকালে উপযুক্ত মূল্যায়ন পায়নি, তবে পরবর্তীতে তা সার্গেই কোরোলেভকে রকেট নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে। কোরোলেভ জোসেফ স্তালিনের অধীনে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধান রকেট নকশাকারীর পদ গ্রহণ করেন। তার দায়িত্ব ছিল মার্কিন বোমারু বিমান প্রতিহত করার জন্য নিউক্লিয়ার অস্ত্রবাহী আন্ত:মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা। কোরোলেভের নকশায় তৈরি আর-৭ সেমিওর্কা রকেটচালিত ভস্তক ১ মহাকাশযানে করেই প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুৎনিক ১ (৪ অক্টোবর ১৯৫৭) এবং প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিনকে (এপ্রিল ১২, ১৯৬১) মহাকাশে প্রেরণ করা হয়েছিল।[৩]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ফন ব্রাউন এবং তার অধীনস্থ রকেট গবেষকদলের অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। তাদেরকে পরে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণায় নিয়োজিত করা হয়। মার্কিন সামরিক ক্ষেপণাস্ত্র সংস্থায় তাদের কাজের ফলস্বরূপ জুনো ১ এবং অ্যাটলাস রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে প্রথম মার্কিন কৃত্রিম উপগ্রহ এক্সপ্লোরার ১ উৎক্ষেপন করা হয় (ফেব্রুয়ারি ১, ১৯৫৮), এবং পরে ফ্রেন্ডশিপ ৭ এ করে প্রথম মার্কিন মহাকাশচারী জন গ্লেনকে মহাকাশে প্রেরণ করা হয় (ফেব্রুয়ারি ২০, ১৯৬২)। মার্শাল মহাকাশ যাত্রা কেন্দ্রের পরিচালক পদে থাকাকালীন ফন ব্রাউন স্যাটার্ন শ্রেনীর বৃহত্তর রকেট তৈরি করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের চন্দ্রাভিযানে অভুতপূর্ব সাফল্য এনে দেয়। এই রকেটের সাহায্যেই যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে অ্যাপোলো ১১ মহাকাশযানে করে নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিনকে চাঁদে অবতরণ করানো এবং পৃথিবীতে ফেরত নিয়ে আসার কৃতিত্ব অর্জন করে। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক একজন নভোচারীকে চাঁদে অবতরণ করানোর জন্য এন১ রকেট তৈরির প্রচেষ্টা চলছিল, তবে এ চেষ্টা সাফল্য পায়নি।

ধাপসমূহ

উৎক্ষেপন

কেপ ক্যানাভেরাল এসএলসি-৪১ উৎক্ষেপন প্যাড হতে নিউ হরাইজন্স প্রোব বহনকারী অ্যাটলাস ভি রকেটের উৎক্ষেপন

বর্তমানে মহাকাশ যাত্রায় সক্ষম একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে রকেট। এর কোন বিকল্প ব্যবস্থা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, কিংবা উপযুক্ত উচ্চতায় পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করেনি। সাধারণত রকেট উৎক্ষেপন করা হয় একটি মহাকাশ বন্দর (কসমোড্রোম) হতে, যেখানে ঊর্ধ্বমুখী রকেটের উৎক্ষেপনের লঞ্চ প্যাড এবং বিমান ও ডানাযুক্ত মহাকাশযান উড্ডয়ন/অবতরণের জন্য রানওয়ে থাকে। মহাকাশ বন্দরগুলো মানব বসতিস্থল থেকে বহুদূরে তৈরি করা হয়, কেননা এতে প্রচুর শব্দদূষণ হয় এবং নিরাপত্তাঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। আইসিবিএম নিক্ষেপের অন্যান্য বিশেষায়িত ব্যবস্থা রয়েছে।

সাধারণ রকেট উৎক্ষেপনের নির্দিষ্ট সময়সীমা (launch window) থাকে, যা কৃত্রিম উপগ্রহ এবং অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তুর গতিবিধি এবং মহাকাশীয় পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত। তবে পৃথিবীর ঘূর্ণন এক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রভাব রাখে। উৎক্ষেপন সম্পন্ন হলে পরে রকেটের কক্ষপথ সাধারণত পৃথিবীর অক্ষের সাপেক্ষে নির্দিষ্ট কোণে সমরৈখিক পথে থাকে, এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে এই কক্ষপথ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।

লঞ্চ প্যাডটি একটি টেকসই নিশ্চল কাঠামো। এতে সাধারণত একটি উল্লম্ব উৎক্ষেপন টাওয়ার এবং অগ্নিশিখা সংগ্রাহী পরিখা থাকে। রকেটকে উল্লম্বভাবে স্থাপন, জ্বালানী সরবরাহ এবং রক্ষনাবেক্ষণ প্রভৃতি দায়িত্বে নিয়োজিত যানবাহন এবং যন্ত্রাংশ লঞ্চ প্যাডের চারপাশে অবস্থান করে। উৎক্ষেপনের পূর্বে রকেটের ভর কয়েক শত টন হতে পারে। উৎক্ষেপনকালে কলম্বিয়া নভোযানের ভর ছিল প্রায় ২,০৩০ tonne (৪৪,৮০,০০০ পা)।

মহাকাশে প্রবেশ

মহাকাশের সাধারণত স্বীকৃত সংজ্ঞা হল কারমান রেখার বহিস্থ সমগ্র অঞ্চল। কারমান রেখার অবস্থান ভূপৃষ্ঠের ১০০ কিলোমিটার (৬২ মা) উচ্চতায় নির্ধারিত। তবে যুক্তরাষ্ট্র কখনও কখনও ৫০ মাইল (৮০ কিমি) উচ্চতাকে মহাকাশের সর্বনিম্ন সীমানা বলে চিহ্নিত করে।

বর্তমানে কেবলমাত্র রকেট জাতীয় বাহনই মহাকাশে পৌঁছাতে সক্ষম। বিমান এবং অন্যান্য সাধারণ উড্ডয়নযানের ইঞ্জিন অক্সিজেনের অনুপস্থিতির দরুন মহাকাশে পৌঁছাতে পারে না। রকেটের ইঞ্জিন বিপুল বেগে জ্বালানীশক্তি নির্গমন করে যা রকেটটিকে তার বিপরীত দিকে উচ্চবেগে ধাক্কা দেয়। এভাবে রকেট কক্ষপথে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় বেগ (ডেল্টা-ভি) অর্জন করতে পারে।

যাত্রীবাহী মহাকাশযানে সাধারণত নভোচারীদের জরুরি বহির্গমনের ব্যবস্থা করা থাকে।

বিকল্প

মহাকাশে পৌঁছানোর জন্য রকেটের বিকল্প হিসেবে একাধিক প্রস্তাবিত ব্যবস্থা রয়েছে, তবে কোনটিই এখনও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। মহাকাশ এলিভেটর, অথবা রোটেভেটর বা স্কাইহুক ইত্যাদি ভরবেগ-বিনিময়নির্ভর ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য যে কাঠামোগত দৃঢ়তা দরকার, বর্তমানে আবিষ্কৃত কোন পদার্থই ততটা শক্তিশালী নয়। অবশ্য তড়িৎচুম্বকীয় উৎক্ষেপক (যেমন লঞ্চ লুপ) বর্তমান প্রযুক্তি দ্বারা তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। অন্যান্য সম্ভাব্য পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে রকেট-আশ্রিত মহাকাশবিমান, যেমন রিঅ্যাকশন ইঞ্জিনস এর স্কাইলন, কিংবা স্ক্র্যামজেট অথবা আরবিসিসি-আশ্রিত মহাকাশবিমান। এছাড়া মহাকাশে মালামাল প্রেরণের জন্য বন্দুকীয় উৎক্ষেপন ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে।

কক্ষপথ ত্যাগ

১৯৫৯ সালে উৎক্ষিপ্ত লুনা ১ ছিল পৃথিবীর মুক্তিবেগ অতিক্রমকারী মানব-নির্মিত প্রথম বস্তু[৪] (একটি প্রতিকৃতির ছবি)

কেবল পৃথিবী প্রদক্ষিণকারী কৃত্রিম উপগ্রহসমূহ এবং পৃথিবীর নিকটে নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকা কিছু মহাকাশ টেলিস্কোপ নির্দিষ্ট পৃথিবী প্রদক্ষিণকারী কক্ষপথে বিরাজ করে। এছাড়া চন্দ্র- বা আন্তগ্রহ অভিযানের জন্য আবদ্ধ কক্ষপথ অর্জন দরকারী নয়। প্রারম্ভিক রুশ মহাকাশযানসমূহ কোন কক্ষপথে ভ্রমণ না করেই অতি উচ্চ অবস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। নাসা অ্যাপোলো অভিযানের যানগুলোকে সরাসরি চন্দ্রমুখী ভ্রমণপথে নিক্ষেপ করতে চেযেছিল, তবে পরে সাময়িক স্থিতিশীল বা পার্কিং কক্ষপথ (parking orbit) কৌশল ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে মহাকাশযান প্রথমে ওই স্থিতিশীল কক্ষপথে পৌঁছায় এবং পরে সেখান থেকে লক্ষ্য অভিমুখে যাত্রা করে।

এ কৌশলে অতিরিক্ত জ্বালানী খরচ হলেও সুবিধার দিক থেকে এই ব্যয় গ্রহণযোগ্য। পার্কিং কক্ষপথ অভিযান পরিকল্পনায় সাহায্য করে। এটি উৎক্ষেপনের সময়সীমা বর্ধিত করে, ফলে কাউন্টডাউনের সময় ছোটখাট সমস্যা দেখা দিলেও উৎক্ষেপন সফল হতে পারে। মহাকাশযান স্থিতিশীল কক্ষপথে পৌঁছালে অভিযানের কর্মকর্তারা উৎক্ষেপন-পরবর্তী পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য কয়েক ঘণ্টার অবকাশ হাতে পান। এসময় কোন ত্রুটি ধরা পড়লে মহাকাশযানকে সহজেই পরবর্তী লক্ষ্যে না নিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যায় কিংবা অন্য কোন নিরাপদ কক্ষীয় অভিযানে নিয়োজিত করা যায়। পার্কিং কক্ষপথের মাধ্যমে চন্দ্র অভিযানে ভ্যান অ্যালেন বিকিরণ বেষ্টনীর সবচেয়ে ক্ষতিকর এলাকা এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব।

অ্যাপোলো অভিযানে পার্কিং কক্ষপথে জ্বালানী ব্যয় যথাসম্ভব হ্রাস করার জন্য তার উচ্চতা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা হয়েছিল। যেমন, অ্যাপোলো ১৫ এর পার্কিং অরবিট ছিল মাত্র ১৭১ থেকে ১৬৯ কিলোমিটার উচ্চতায়, যা অস্বাভাবিক মাত্রায় কম। এখানে প্রচুর বায়ুমণ্ডলীয় টান ছিল; এর প্রভাব এড়ানো‌র জন্য স্যাটার্ন ভি এর তৃতীয় ধাপের বুস্টার থেকে নিরবচ্ছিন্ন হাইড্রোজেন নি:সরণ করা হত।

রোবট অভিযানে বিকিরণ এড়ানো কিংবা অভিযান বাতিল ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে না, এবং আধুনিক উৎক্ষেপকসমূহ খুব সংক্ষিপ্ত উৎক্ষেপনের সময়সীমাও অনুসরণ করতে পারে, তাই মহাকাশ প্রোবসমূহ সরাসরি লক্ষ্য (চাঁদ বা অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তু) অভিমুখী যাত্রাপথে নিক্ষেপ করা হয়, এক্ষেত্রে স্থিতিশীল কক্ষপথের প্রয়োজন পড়ে না।

মহাকাশীয় বস্তুর মুক্তিবেগ তার পৃষ্ঠ হতে উচ্চতা অনুসারে হ্রাস পেতে থাকে। তবে মহাকাশযান ভূ-পৃষ্ঠের নিকটবর্তী থাকাকালীন জ্বালানী নির্গমন করাটা সবচেয়ে সাশ্রয়ী (ওবার্থ ইফেক্ট এর কারণে)।[৫] এটি স্থিতিশীল কক্ষপথ অর্জনে জ্বালানী অপচয়ের একটি কারণ; কেননা স্থিতিশীল কক্ষপথটি ভূ-পৃষ্ঠের নিকটবর্তী না বলে এখানে জ্বালানী ব্যয় করাটা সাশ্রয়ী নয়।

কিছু কিছু ভবিষ্যত মহাকাশ অভিযানের পরিকল্পনায় কক্ষপথে অবস্থানকালে মহাকাশযান নির্মাণ প্রক্রিয়াও অন্তর্ভুক্ত, যেমন নাসার ওরিয়ন প্রজেক্ট এবং রাশিয়ার ক্লিপার/পরম যুগল।

জ্যোতির্গতিবিদ্যা

জ্যোতির্গতিবিদ্যা হল মহাকাশযানের (এবং অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তুর) ভ্রমণপথ এবং তার ওপর মহাকর্ষ ও চালিকাশক্তির প্রভাব আলোচনাকারী বিদ্যা। জ্যোতির্গতিবিদ্যার গবেষণালদ্ধ ফলাফল দ্বারা মহাকাশযানের গতিপথ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা যায়, এবং সর্বনিম্ন জ্বালানী অপচয়কারী ভ্রমণপথ নির্ধারণ করা যায়। মহাকাশে পৌঁছানোর পর সাধারণত মূল রকেটের দরকার পড়ে না, মহাকাশযান স্ব-বেগে চলমান থাকে। এসময় মহাকাশযানের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য কক্ষীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (orbital maneuvering system) ব্যবহার করা হয়।

রকেট-বিহীন কক্ষীয় চালিকা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে সৌরপাল, চুম্বকীয় পাল, প্লাজমা-বাবল চৌম্বক পদ্ধতি এবং মহাকর্ষীয় স্লিংশট (মহাকর্ষীয় সহায়তা) পদ্ধতি।

মহাকাশযানের পুন:প্রবেশকালে বায়ুমণ্ডলে উৎপন্ন আয়নিত গ্যাসের রেখা
সি-১১৯ বিমানে করে ডিসকভারার ১৪ এর পুন:প্রবেশ ক্যাপসুল উদ্ধার

পরিচলন শক্তি

পরিচলন শক্তি (transfer energy) হল রকেটের প্রতিটি ধাপ দ্বারা তার বাহিত বস্তুতে সরবরাহকৃত মোট শক্তি। তা হতে পারে প্রথম ধাপের রকেটজ্বালানী থেকে পরবর্তী ধাপে প্রদত্ত শক্তি, অথবা সর্বশেষ ধাপের চালক (কিক মোটর) দ্বারা মহাকাশযানে প্রদত্ত শক্তি।[৬][৭]

পুন:প্রবেশ

কক্ষপথে ভ্রমণরত মহাকাশযানে বিপুল পরিমাণ গতিশক্তি সঞ্চিত থাকে। নিরাপদে পৃথিবীতে অবতরণের জন্য এই অতিরিক্ত শক্তি অবশ্যই বর্জন করতে হয়, নইলে বায়ুমণ্ডলে প্রচণ্ড ঘর্ষণে মহাকাশযানটি বাষ্পীভূত হয়ে যেতে পারে। সাধারণত বায়ুগতিজনিত উত্তাপ এড়ানোর জন্য মহাকাশযানে বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। হ্যারি জুলিয়ান অ্যালেন পুন:প্রবেশ প্রক্রিয়ার তত্ত্ব গঠন করেছেন। এই তত্ত্ব মোতাবেক, মহাকাশযান পুন:প্রবেশের সময় ভোঁতা আকৃতির পাশ বায়ুমণ্ডল অভিমুখে রাখে। ভোঁতা আকৃতির ফলে মোট গতিশক্তির মাত্র ১% তাপশক্তিতে পরিণত হয়ে যানে আঘাত হানতে পারে, বাকিটা যানের পরিবর্তে বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে বিলীন হয়।

অবতরণ

মার্কারি, জেমিনাই এবং অ্যাপোলো যানগুলির ক্যাপসুুল সাগরে অবতরণ করেছিল। এদের অবতরণের সময় প্যারাশুট দ্বারা গতি হ্রাস করা হয়েছিল। রুশ সয়ুজ যানের ক্যাপসুল বৃহদায়তন প্যারাশুটের পাশাপাশি ব্রেকিং রকেট ব্যবহার করে ভূমিতে অবতরণ করে।

পুনরুদ্ধার

সফল অবতরণের পর মহাকাশযানের যাত্রী এবং বাহিত বস্তু পুনরুদ্ধার করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে অবতরণের পূর্বেই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়: প্যারাশুটের সাহায্যে অবতরণরত মহাকাশযান আকাশ থেকেই বিশেষায়িত বিমানের সাথে সংযুক্ত করে নেয়া সম্ভব। এরকম প্রক্রিয়ায় করোনা গুপ্তচর উপগ্রহে সঞ্চিত ফিল্মের বাক্স মাটিতে নামার পূর্বেই সংগ্রহ করা হয়েছিল।

প্রকারভেদ

যাত্রীবিহীন

সোজার্নার রোভার এর আলফাকণা রঞ্জনরশ্মি বর্ণালীবিক্ষণ যন্ত্রে ইয়োগি রক পরিমাপ করছে।
বুধ গ্রহে মেসেঞ্জার মহাকাশযান (শৈল্পিক কল্পনা)।

যাত্রীবিহীন মহাকাশযাত্রা হল মহাকাশে মানব উপস্থিতির প্রয়োজন বিহীন অভিযান। মহাকাশ প্রোব, কৃত্রিম উপগ্রহ এবং রোবোটিক মহাকাশযান ও রোবোটিক অভিযান এই শ্রেণীভুক্ত। রোবোটিক মহাকাশযানে কোন মানুষ অবস্থান করে না (এবং সাধারণত সেরকম ব্যবস্থাও থাকে না) এবং সাধারণত বেতার তরঙ্গের দূর-নিয়ন্ত্রণ দ্বারা পরিচালিত হয়। রোবোটিক মহাকাশযান সাধারণত বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের কাজ করে। এধরনের মহাকাশযানকে সাধারণত মহাকাশ প্রোব বলা হয়।

যাত্রীবিহীন অভিযানে দূর-চালিত তথা রিমোট-কন্ট্রোল্‌ড মহাকাশযান ব্যবহৃত হয়। প্রথম যাত্রীবিহীন অভিযান ছিল স্পুৎনিক ১, যা ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর পৃথিবী প্রদক্ষিণের জন্য উৎক্ষিপ্ত হয়। অবশ্য কিছু অভিযানে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীকেও মহাকাশে প্রেরণ করা হয়েছে। মহাকাশে পৌঁছানো প্রথম প্রাণ হল কিছু মাছি, যাদেরকে ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একটি মার্কিন ভি-২ রকেটে করে উৎক্ষেপন করা হয়েছিল। রকেটটি মহাকাশের নিম্নসীমা হিসেবে স্বীকৃত ১০০ কিলোমিটার (৬২ মা) উচ্চতা অতিক্রম করে ফিরে আসে।[৮][৯]

সুবিধা

অনেক মহাকাশ অভিযানে মানুষের চেয়ে রোবোট অধিক উপযুক্ত, যার অন্যতম কারণ অল্প খরচ এবং নিম্ন নিরাপত্তা ঝুঁকি। এছাড়া, বর্তমান প্রযুক্তি কিছু গ্রহের চরম আবহাওয়া, যেমন বৃহস্পতি বা শুক্রের পরিবেশ, থেকে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, এবং অন্যান্য দূরবর্তী লক্ষ্যসমূহ —যেমন শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, — যাত্রীবাহী মহাকাশযান প্রযুক্তির নাগালের বাইরে। তাই এসব লক্ষ্যে যাত্রার জন্য বর্তমানে দূর-নিয়ন্ত্রিত রোবটের বিকল্প নেই। এছাড়া রোবটিক মহাকাশ প্রোবের ব্যবহার করে পৃথিবী বহির্ভূত অঞ্চলকে পৃথিবী হতে জৈবদূষণ মুক্ত রাখতে পারে, কেননা যাত্রীবিহীন যান সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত রাখা যায়। মনুষ্যবাহী যানকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত করা যায় না, কারণ মানবদেহে প্রচুর অনুজীব সর্বদা সহাবস্থান করে, এবং এসব জীবাণুকে মহাকাশযান বা মহাকাশ পোশাকে পুরোপুরি আবদ্ধ রাখা সম্ভব হয় না।

দূর-উপস্থিতি

যদি মহাকাশযান নিয়ন্ত্রণের দ্রুততা বাস্তব সময়ের প্রায় সমান হয়, তাহলে দূর-নিয়ন্ত্রণ, দূর-উপস্থিতির সমকক্ষ হয়ে ওঠে। এজন্য নিয়ন্ত্রণকক্ষ হতে যানের দূরত্ব নিকটবর্তী হতে হয়, যেন নিয়ন্ত্রণ সংকেত আদানপ্রদানের গতি বাস্তব সময়ের কাছাকাছি হতে পারে। পৃথিবী থেকে চাঁদের ২ সেকেন্ড আলোকীয় দূরত্বও দূর-উপস্থিতি ব্যহত করে। L1 এবং L2 অবস্থানে সংকেত সংকেত প্রেরণ এবং ফেরত আসার জন্য মোট সময় লাগে ৪০০ মিলিসেকেন্ড, যা কার্যকর দূর-উপস্থিতি ব্যবস্থার নিম্নসীমার সামান্য বেশি। পৃথিবী থেকে কক্ষীয় মহাকাশযানের ত্রুটিসারাইয়ের জন্য দূর-উপস্থিতি একটি সুবিধাজনক সমাধান হতে পারে, কেননা তখন এ কাজের জন্য অতিরিক্ত একটি যাত্রীবাহী মহাকাশযানের প্রয়োজন পড়বে না। ২০১২ সালে নাসার আয়োজিত টেলিরোবোটিক্স সম্মেলনে দূর-উপস্থিতির বাস্তবায়ন এবং প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।[১০]

যাত্রীবাহী

আইএসএস এর ক্রু-গণ গবেষণার নমুনা সংরক্ষণ করছেন।

১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিলের ভস্তক ১ ছিল প্রথম মানব যাত্রীবাহী মহাকাশ যাত্রা, যা সোভিয়েত কসমোনট ইয়ুরি গ্যাগারিনকে পৃথিবীর চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করিয়ে নিয়ে আসে। অবশ্য গ্যাগারিন তার অবতরণ পথের শেষ সাত মাইল প্যারাশুটে করে নেমেছিলেন, যা কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি।[১১] বর্তমানে শুধুমাত্র রুশ সয়ুজ এবং চৈনিক শেনঝু মহাকাশযান যাত্রীবাহী অভিযানের জন্য নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে। মার্কিন স্পেস শাটল বহর ২০১১ সালের জুলাই মাসে দায়িত্ব থেকে অবসর পেয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি স্পেসশিপওয়ান দুইবার যাত্রীবাহী উপকক্ষীয় উড্ডয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়াও একাধিক ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান সুলভ যাত্রীবাহী মহাকাশ যান ব্যবস্থা গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

উপকক্ষীয়

পৃথিবী কক্ষপথে ভ্রমণরত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (এসটিএস-১১৯ অভিযানে ক্রু-গণের পরিদর্শনের পর)।

উপকক্ষীয় মহাকাশযাত্রায়, মহাকাশযান মহাকাশে পৌঁছানোর পর পুনরায় বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে (সাধারণত একটি নিক্ষেপন গতিপথের অনুসরণে)। সাধারণত অপর্যাপ্ত কক্ষীয় শক্তির কারণে উপকক্ষীয় উড্ডয়ন মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়, তবে পর্যাপ্ত শক্তি উপস্থিত থাকলে তা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে। পায়োনিয়ার ১ ছিল নাসার চন্দ্রাভিযানের জন্য তৈরি প্রথম মহাকাশ প্রোব। উৎক্ষেপনের পর আংশিক ত্রুটির কারণে এটি ১,১৩,৮৫৪ কিলোমিটার (৭০,৭৪৬ মা) উচ্চতায় উপকক্ষীয় যাত্রাপথ অর্জন করে, এবং উৎক্ষেপনের ৪৩ ঘণ্টা পর বায়ুমণ্ডলে পুন:প্রবেশ করে।

সাধারণত পৃথিবীপৃষ্ঠের ১০০ মাইল (১৬০ কিমি) ওপরোস্থিত কারমান রেখা মহাকাশের নিম্নসীমা বলে স্বীকৃত (তবে নাসা ১০০ মাইল (১৬০ কিমি) উচ্চতায় ভ্রমণকারী ব্যক্তিকে নভোচারী সংজ্ঞা দেয়)। কারমান রেখা অতিক্রমের জন্য যে পরিমাণ বিভব শক্তির বৃদ্ধি প্রয়োজন, তা সর্বনিম্ন কক্ষীয় শক্তির (বিভব এবং গতিশক্তির সমষ্টি) মাত্র ৩%। অর্থাৎ, মহাকাশে পৌঁছানো অতটা সোজা, সেখানে রয়ে যাওয়া মোটেই ততটা সোজা নয়। ২০০৪ সালের ১৭ মে তারিখে সিভিলিয়ান স্পেস এক্সপ্লোরেশন টিম (সিএসএক্সটি) তাদের গোফাস্ট রকেটের উপকক্ষীয় উড্ডয়নে সক্ষম হয়, যা ছিল প্রথম শখের মহাকাশযাত্রা। পরে ২০০৪ সালের ২১ জুন স্পেসশিপওয়ান সর্বপ্রথম ব্যাত্রিগত অর্থায়নের যাত্রীবাহী মহাকাশ যাত্রা সম্পন্ন করে, এবং এটিও একটি উপকক্ষীয় পথে যাত্রা করেছিল।

পয়েন্ট-থেকে-পয়েন্ট

পয়েন্ট-থেকে-পয়েন্ট যাত্রা হল এক ধরনের উপকক্ষীয় মহাকাশ যাত্রা যা ভূ-পৃষ্ঠের দুটি এলাকার মধ্যে দ্রুত চলাচলে ব্যবহৃত হয়। এটি বিমানযাত্রার বিকল্প হতে পারে। লন্ডন থেকে সিডনি বরাবর সাধারণ বিমান যাত্রায় মোটামুটি প্রায় একুশ ঘণ্টা সময় লাগে। পয়েন্ট-থেকে-পয়েন্ট মহাকাশভ্রমণে একই দূরত্ব মাত্র এক ঘণ্টায় অতিক্রম করা সম্ভব।[১২] যদিও বর্তমানে কোন প্রতিষ্ঠান এধরনের যাত্রার সুবিধা দিচ্ছে না, তবে স্পেসএক্স ২০২০ সালের মধ্যে বিএফআর রকেটের সাহায্যে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভ্রমণ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা উন্মোচন করেছে।[১৩]

আন্তমহাদেশীয় দূরত্ব অতিক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় উপকক্ষীয় বেগ, নিকট-পৃথিবী কক্ষপথে পৌঁছাতে প্রযোজনীয় বেগের প্রায় কাছাকাছি।[১৪] যদি এক্ষেত্রে রকেট ব্যবহৃত হয়, তবে বাহিত ভর বা পে লোডের তুলনায় রকেটের আকার হবে প্রায় একটি আইসিবিএমের অনুরূপ। এছাড়া আন্তমহাদেশীয় মহাকাশযাত্রা বাস্তবায়নের জন্য স্বাভাবিক মহাকাশযাত্রার মতই বায়ুমণ্ডলে পুন:প্রবেশকালীন উত্তাপ নিষ্পত্তি সমস্যা সমাধান করতে হবে।

কক্ষীয়

অ্যাপোলো ৬ কক্ষপথ অভিমুখে যাচ্ছে

একটি ক্ষুদ্রতম কক্ষীয় মহাকাশ অভিযানে ক্ষুদ্রতম উপ-কক্ষীয় অভিযানের চেয়ে অনেক বেশি গতিবেগ প্রয়োজন হয়, এবং তা প্রযুক্তিগতভাবেও অনেক জটিলতর। কক্ষীয় যাত্রার সফলতার জন্য উচ্চতা এবং পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে স্পর্শক-রৈখিক বেগ, দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। মহাকাশে স্থিতিশীল এবং দীর্ঘস্থায়ী ভ্রমণপথ অর্জনের জন্য মহাকাশযানের অবশ্যই প্রাসঙ্গিক ব্যাসার্ধের আবদ্ধ কক্ষপথের জন্য নিম্নতম কক্ষীয় গতি অর্জন করতে হয়।

আন্তগ্রহ

আন্তগ্রহ যাত্রা হল একই গ্রহমণ্ডলের একটি গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে মহাকাশযাত্রা। বর্তমান বাস্তবিকতায়, "আন্তগ্রহ মহাকাশযাত্রা" বলতে পৃথিবী হতে সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে মহাকাশযানে করে ভ্রমণ করাকে বোঝায়। বর্তমানে চাঁদে অবতরণকারী অ্যাপোলো অভিযান ব্যতীত আর কোন যাত্রীবাহী মহাকাশযান পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহ বা উপগ্রহপৃষ্ঠে পৌঁছায়নি। অবশ্য বিভিন্ন মহাকাশ প্রোব অভিযান দ্বারা সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ পরিদর্শন করা হয়েছে, যেমন পায়োনিয়ার, ভয়েজার, এবং ভেনেরা, মেরিনার, জুনো, ক্যাসিনি-হাইগেনস, নিউ হরাইজন্স প্রভৃতি।

আন্তনক্ষত্র

বর্তমানে পাঁচটি মহাকাশযান সৌরজগতের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ ত্যাগ করেছে বা করছে: ভয়েজার ১, ভয়েজার ২, পায়োনিয়ার ১০, পায়োনিয়ার ১১, এবং নিউ হরাইজন্স। এদের মধ্যে সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী যান হল ভয়েজার ১, যার দূরত্ব প্রায় ১০০ এইউ এবং বার্ষিক ৩.৬ এইউ করে বর্ধনশীল।[১৫] তবে সূর্যের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই প্রায় ২৬৭,০০০ এইউ দূরত্বে অবস্থিত। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে ভয়েজার ১ এর ৭৪,০০০ বছরেরও বেশি সময় লাগবে। অবশ্য নিউক্লিয়ার স্পন্দন পরিচালনা এর মত অত্যাধুনিক কৌশলে তৈরি মহাকাশযান এই দূরত্ব আরও অনেক কম সময়ে অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। তবে তারপরেও অতিক্রান্ত সময় মানুষের স্বাভাবিক জীবনকালের চেয়ে বেশি সময় লাগে বলে যাত্রীবাহী আন্তনক্ষত্র যাত্রা বর্তমানে বাস্তবায়নযোগ্য নয়।

মনুষ্যবাহী আন্তনক্ষত্র যাত্রার একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে আপেক্ষিক সময় দীর্ঘায়নের প্রয়োগ। অতি-উচ্চবেগে ভ্রমণশীল যানের যাত্রীরা লম্বা দূরত্ব অতিক্রম করলেও তাদের বয়সবৃদ্ধির হার কম হবে। অর্থাৎ উচ্চ বেগের কারণে মহাকাশযানের অভ্যন্তরে সময়ের প্রবাহের গতি কমে যাবে। তবে এরকম প্রভাব বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্য মহাকাশযানের যে মাত্রার গতি প্রয়োজন, তা অর্জন করার মত প্রযুক্তি বর্তমানে আবিষ্কৃত হয়নি।

আন্তগ্যালাক্সি

আন্তগ্যালাক্সি যাত্রা হল একটি গ্যালাক্সি হতে অন্য একটি গ্যালাক্সিতে মহাকাশ যানে করে যাত্রা, যা সফল করার জন্য আন্তনক্ষত্র ভ্রমণের চেয়েও অতি উন্নত পর্যায়ের প্রাযুক্তিক দক্ষতা প্রয়োজন। বর্তমান প্রযুক্তির প্রেক্ষিতে আন্তগ্যালাক্সি যাত্রা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বলে বিবেচ্য।

মহাকাশযান

চন্দ্রপৃষ্ঠে অ্যাপোলো লুনার মডিউল

মহাকাশযান হল মহাকাশে নিজের ভ্রমণপথ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম যান। অ্যাপোলো লুনার মডিউলকে কখনও কখনও প্রথম বিশুদ্ধ মহাকাশযান বলা হয়[১৬], কারণ এটিই ছিল প্রথম মনুষ্যবাহী যান যা কেবল মহাকাশে চালনার জন্য নকশাকৃত, এবং এর অ্যারোডায়নামিক গঠন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ব্যবহারযোগ্য ছিল না।

চালিকাশক্তি

বর্তমানের মহাকাশযানসমূহের চালিকাশক্তি হিসেবে সর্বাগ্রে রয়েছে রকেট এবং রকেট জ্বালানী ( কঠিন কিংবা তরল)। তবে অন্যান্য চালিকাশক্তির প্রয়োগ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে (যেমন আয়ন ড্রাইভ), বিশেষত যাত্রীবিহীন যানের জন্য, যা মহাকাশযানের সামগ্রিক ভরের বহুলাংশ কমিয়ে আনতে পারে, এবং ফলস্বরূপ যানের গতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।

উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা

উৎক্ষেপন পদ্ধতি বলতে একটি বস্তু বা পে লোডকে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে মহাকাশে পৌঁছে দেয়ার সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিকে বোঝায়। উৎক্ষেপন পদ্ধতির অংশের মধ্যে রয়েছে উৎক্ষেপক যান, রকেট, উৎক্ষেপন প্যাড, মহাকাশযান উৎপাদন এবং জ্বালানী সরবরাহ প্রক্রিয়া, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থা।

ব্যয়িত

বর্তমানে সকল মহাকাশ যাত্রায় বহুধাপসম্পন্ন ব্যয়িত উৎক্ষেপন ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি ধাপের জ্বালানী ব্যয় করে পরবর্তী ধাপে শক্তি সরবরাহ করা হয় এবং শেষে সেই ধাপের জ্বালানী এবং রকেটের খণ্ডাংশ বাতিল হয়ে যায়।

পুন:ব্যবহার্য

সর্বপ্রথম উংক্ষিপ্ত পুন:ব্যবহার্য মহাকাশযান হল এক্স-১৫, যা ১৯৬৩ সালের ১৯ জুলাই বায়ুমণ্ডল থেকে একটি উপকক্ষীয় পথে প্রেরণ করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস শাটল শ্রেনীর মহাকাশযানগুলো প্রথম আংশিক পুন:ব্যবহার্য কক্ষীয় যান, যা ইয়ুরি গ্যাগারিনের মহাকাশযাত্রার বিশতম বার্ষিকীতে, ১৯৮১ সালের ১২ এপ্রিল, চালু করা হয়। স্পেস শাটল যুগে ছয়টি কক্ষীয় যান তৈরি করা হয়েছিল, যার মধ্যে পাঁচটি মহাকাশে যাত্রা করেছিল। স্পেস শাটল এন্টারপ্রাইজ কেবল অবতরণ পরীক্ষায় ব্যবহার করা হত। মহাকাশগামী প্রথম শাটলটি হল কলম্বিয়া, এরপর যথাক্রমে চ্যালেঞ্জার, ডিসকভারি, আটলান্টিস এবং এনডেভারএনডেভার তৈরি করা হয়েছিল চ্যালেঞ্জার এর বিকল্প হিসেবে, যা ১৯৮৬ সালের জানুয়রিতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কলম্বিয়া ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বায়ুমণ্ডলে পুন:প্রবেশকালে ধ্বংস হয়ে যায়।

স্পেস শাটল কলম্বিয়া। এসটিএস-১ অভিযানে ইঞ্জিন চালু করার কয়েক সেকেন্ড পরে তোলা ছবি।
এসটিএস-১ শেষে অবতরণরত কলম্বিয়া
এসটিএস-২ অভিযানে কলম্বিয়া পুনরায় উড্ডয়ন করছে।

প্রথম স্বয়ংক্রিয় আংশিক পুন:ব্যবহার্য মহাকাশযান হল রুশ মহাকাশবিমান বুরান বুরান। এটি ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর উৎক্ষিপ্ত হয়, এবং কেবল একবারই উড্ডয়ন করেছিল। এই মহাকাশবিমানটি ক্রুবাহী এবং গঠনের দিক দিয়ে মার্কিন মহাকাশ শাটলের অনুরূপ ছিল, তবে এর অবমুক্ত বুস্টারে তরল জ্বালানী ব্যবহৃত হত, এবং ইঞ্জিনের অবস্থানে পার্থক্য ছিল। অর্থায়নের অভাবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার ফলে বুরানের পরবর্তী উড্ডয়ন ব্যহত হয়।

মার্কিন মহাকাশ অনুসন্ধান দৃষ্টিকল্প অনুযায়ী ২০১১ সালে স্পেস শাটলের কার্যক্রম বাতিল করা হয়, মূলত এর বয়স এবং উচ্চ খরচের জন্য (এর প্রতিটি উড্ডয়নে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ হচ্ছিল)। ২০২১ সাল মোতাবেক স্পেস শাটলের অনুরূপ যাত্রীবহনের দায়িত্ব নেবে ক্রু এক্সপ্লোরেশান ভেহিকল বা সিইভি। এবং শাটলের মত কার্গো পরিবহন দায়িত্ব পাবে ব্যয়যোগ্য রকেট, যেমন ইইএলভি (Evolved Expendable Launch Vehicle) অথবা শাটল-উদ্ভূত রকেট।

স্কেল্ড কম্পোজিটস এর তৈরি স্পেসশিপওয়ান (SpaceShipOne) ছিল একটি পুন:ব্যবহারযোগ্য উপকক্ষীয় মহাকাশবিমান, যা ২০০৪ সালে দুটি উপর্যুপুরি যাত্রায় পাইলট মাইক মেলভিল এবং ব্রায়ান বিনিকে বহন করে আনসারি এক্স পুরস্কার জয় করে। এর উত্তরসুরি, স্পেসশিপটু, দ্যা স্পেসশিপ কোম্পানি দ্বারা তৈরি হচ্ছে। ভার্জিন গ্যালাক্টিক ২০০৮ সালে একদল স্পেসশিপটু ব্যবহার করে তাদের মহাকাশ আনন্দভ্রমণ বাণিজ্যের পরিকল্পনা করছিল, তবে চালিকাশক্তিজনিত ত্রুটির কারণে তা ব্যহত হয়।[১৭]

জটিলতা

মহাকাশ দুর্ঘটনা

সকল উৎক্ষেপণ বাহনে প্রচুর পরিমাণ বিস্ফোরক থাকে, যা মহাকাশে পৌঁছানোর যথেষ্ট গতিলাভের জন্য প্রয়োজন, আবার তা অত্যধিক ঝুঁকিরও কারণ। সঠিক সময়ের পূর্বে বা সঠিক পরিমাণের চেয়ে বেশি জ্বালানী অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যয় হলে যে অতিরিক্ত শক্তি মুক্তি পায়, তার ব্যাপক ক্ষতি করতে সক্ষম। ১৯৯৭ সালের ১৭ জানুয়ারি একটি ডেলটা ২ রকেট বিস্ফোরিত হলে প্রায় ১০ মাইল (১৬ কিমি) দূরেরও জানালার কাঁচ ভেঙে যাওয়ার রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল[১৮]

মহাকাশীয় পরিবেশ মোটামুটি মোটা দাগে পূর্বাভাসযোগ্য, তথাপি দুর্ঘটনাজনিত বায়ুচাপ নির্গমন এবং যান্ত্রিক ত্রুটির সম্ভাবনা থাকে, বিশেষত অল্প পরীক্ষিত নতুন যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে। ১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি তারিখে ফ্লোরিডা থেকে উৎক্ষেপনের ৭৩ সেকেন্ড পর মহাকাশযান চ্যালেঞ্জার বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়, এবং এতে অবস্থানকারী সাতজন যাত্রীই নিহত হন। এ দুর্ঘটনার কারণ ছিল চ্যালেঞ্জারের ডানপাশের রকেট বুস্টারের একটি সংযোগস্থলের দুর্বলতা।[১৯]

২০০৪ সালে নেদারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক মহাকাশ নিরাপত্তা উন্নতি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য মহাকাশ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিসমূহের নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রসার ঘটানো।[২০]

ওজনহীনতা

আইএসএস-এ ওজনহীন পরিবেশে কর্মরত নভোচারীগণ।

পৃথিবীপ্রদক্ষিণরত মহাকাশযানের অভ্যন্তরে ক্ষীণমহাকর্ষীয় পরিবেশ তৈরি হয়, যেখানে ওজনহীনতা অনুভব করা যায়। ক্ষীণমহাকর্ষীয় পরিবেশে স্বল্পকালীন অবস্থান করলে মহাকাশ অভিযোজন উপসর্গ দেখা দিতে পারে; যা চিহ্নিত হয় শারীরবৃত্তীয় ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলাজনিত বিবমিষা দ্বারা। এ পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান একাধিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে হাড়ক্ষয়, এছাড়া পেশী এবং সংবহনতন্ত্রের দূর্বলতাও দেখা দেয়।

বিকিরণ

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে ভ্যান অ্যালেন বেষ্টনীর বিকিরণ, সৌর বিকিরণ, এবং মহাজাগতিক বিকিরণ জনিত সমস্যা দেখা দেয় এবং ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। পৃথিবী থেকে যত সরে যাওয়া হয়, সৌর বিস্ফোরণ তত মারাত্মক হয়, এমনকি কয়েক মিনিটেই মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এছাড়া স্বাস্থ্যের ওপর মহাজাগতিক বিকিরণের প্রভাবে ক্যান্সারের সম্ভাবনাও ক্রমশ বাড়তে থাকে।[২১]

জীবনরক্ষাব্যবস্থা

মানববাহী মহাকাশযাত্রায় মহাকাশে মানুষের জীবনধারণের জন্য ত্রুটিহীন জীবনরক্ষাব্যবস্থা অপরিহার্য। নাসা তাদের যাত্রীবাহী মহাকাশযানে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ও জীবনরক্ষায় ইসিএলএসএস নামক ব্যবস্থা যুক্ত রাখে।[২২] জীবন রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত বাতাস, পানি এবং খাদ্যের ব্যবস্থা, এবং যাত্রীদের স্বাভাবিক শারীরিক তাপমাত্রা ও চাপ বজায় রাখা এবং শারীরিক বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা অপরিহার্য। এছাড়া প্রয়োজনমাফিক বিকিরণ এবং ক্ষুদ্র গ্রহাণুকণা ইত্যাদি বাহ্যিক ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থাও থাকে। জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থার ত্রুটিহীনতা অত্যন্ত গুরুগ্বপূর্ণ, এবং এসব ব্যবস্থা নকশা ও বাস্তবায়ন কালে উচ্চ নিরাপত্তায় প্রাধান্যদানকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল প্রয়োগ করা হয়।

মহাকাশীয় পরিবেশ

অরোরা অস্ট্রালিস এবং ডিসকভারি মহাকাশযান, মে ১৯৯১।

মহাকাশীয় পরিবেশ বলতে মহাকাশের পরিবশগত পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়। এটি ভূ-প্রাকৃতিক এবং বায়ুমণ্ডলীয় আবহাওয়ার ধারণা থেকে ভিন্ন। প্রাকৃতিক প্লাজমা, চৌম্বক ক্ষেত্র, বিকিরণ এবং মহাকাশীয় বস্তুসমূহ নিয়েই গঠিত হয় মহাকাশীয় পরিবেশ। মার্কিন জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির ভাষ্যমতে:

"মহাকাশীয় পরিবেশ, পৃথিবী এবং আমাদের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থায় প্রভাববিস্তারকারী মহাকাশীয় পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে।পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র, সূর্যের আচরণ এবং সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থানই আমাদের মহাকাশীয় পরিবেশের উৎস।"[২৩]

মহাকাশীয় পরিবেশ মহাকাশ গবেষণা এবং মহাকাশযাত্রায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ভূ-চুম্বকীয় পরিস্থিতির পরিবর্তন বায়ুমণ্ডলের ঘনত্বে পরিবর্তন আনতে পারে, যার ফলে নিকট-পৃথিবী কক্ষপথে অবস্থানরত মহাকাশযানের উচ্চতায় দ্রুত অবনতি হতে পারে। বর্ধিত সৌর প্রতিক্রিয়া এবং ভূ-চুম্বকীয় ঝড়ের ফলে মহাকাশযানে অবস্থিত সেন্সর যন্ত্রাংশ অকার্যকর হয়ে যেতে পারে, অথবা ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশে ক্ষতিরও কারণ হতে পারে। তাই মহাকাশযান তৈরিতে মহাকাশীয় পরিবেশ সম্পর্কিত জ্ঞানগুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।

পরিবেশের ওপর প্রভাব

রকেট শ্রেনীর বাহন বৈশিষ্ট্যগতভাবে অতিরিক্ত দুষণকারী নয়। তবে কিছু রকেটে বিষাক্ত জ্বালানী ব্যবহৃত হয়, তাছাড়া অধিকাংশ মহাকাশযানের জ্বালানী কার্বন-নিরপেক্ষ নয়। কিছু রকেটে পারক্লোরেট রূপে ক্লোরিনের মজুদ থাকে, যার ফলে ঊর্ধ্ব-বায়ুমণ্ডলে জ্বালানী নির্গমনকালে ওজোন স্তর সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পুন:প্রবেশকারী মহাকাশযান নাইট্রেট নির্গমন করে, এভাবেও ওজোন স্তরের সাময়িক ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাছাড়া রকেটসমূহ এবং অন্যান্য মহাকাশব্যবস্থাপনা যন্ত্রাংশ ধাতু থেকে উৎপাদিত হয়, এবং এর উৎপাদনপ্রক্রিয়া পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

পরিবেশগত প্রভাব ছাড়াও নিকট-পৃথিবী অঞ্চলেও মহাকাশীয় কার্যক্রমের প্রভাব রয়েছে। মহাকাশযানের কেসলার সিনড্রোম এবং বাহ্যিক ক্ষয়ের কারণে এই অঞ্চলে মহাকাশ বর্জ্যের পরিমাণ নিয়ত বাড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান বর্জ্যের জন্য ভবিষ্যতে মহাকাশযাত্রায় বাধা সৃষ্টি হবার তীব্র সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য বর্তমানে অনেক মহাকাশযান পুন:প্রবেশ- এবং পুন:ব্যবহারযোগ্য করে তৈরি করা হচ্ছে।

প্রয়োগ

এটি তীব্র অতিবেগুনী বর্ণালীতে সূর্যের চিত্র, যা স্কাইল্যাব ৩ এর অ্যাপোলো টেলিস্কোপ মাউন্ট এসও৮২এ পরীক্ষাকালে প্রাপ্ত। ছবির ডান অংশে সূর্যের হিলিয়াম নি:সরণ উজ্জ্বলভাবে এবং বাম অংশে লৌহ নি:সরণ ম্রিয়মানভাবে উঠে এসেছে[২৪]
মহাকাশযাত্রার একটি প্রয়োগক্ষেত্র হল, ভূ-পৃষ্ঠ হতে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের বাধা দূর করা। স্কাইল্যাবে একটি বিশাল যাত্রীবাহী সৌর পর্যবেক্ষণাগার যুক্ত ছিল, যা ১৯৭০ দশকের শুরুতে সৌর বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব অগ্রগতি এনে দিয়েছিল।

মহাকাশ যাত্রার বাস্তবিক এবং প্রস্তাবিত প্রয়োগক্ষেত্র হল:

প্রারম্ভিক মহাকাশ যাত্রার আর্থিক সমর্থন আসত মূলত সরকারি পর্যায় থেকে। তবে বর্তমানে যোগাযোগ এবং বিনোদন ব্যবস্থায় ব্যবহৃত কৃত্রিম উপগ্রহসমূহ সম্পূর্ণভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কাজ করে (অবশ্য এদের অনেকেই প্রারম্ভিকভাবে সরকারি সহায়তায় কাজ শুরু করেছিল)।

ব্যক্তিপর্যায়ের মহাকাশ যাত্রার ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে। বর্তমানে কেবল বাণিজ্যিক বা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেই নয়, বরং ব্যক্তিগত মহাকাশযাত্রা প্রতিষ্ঠান থেকেও মহাকাশে যাত্রার অর্থায়ন করা হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ধরে নিয়েছে যে মহাকাশযাত্রার প্রচলিত অত্যধিক খরচের মূল কারণ হচ্ছে সরকারি উদ্যমের নিম্ন কার্যকারিতাজনিত অপব্যয়, যা তারা এড়াতে পারবে। এই ধারণার বাস্তব সমর্থনও পাওয়া যায়, কেননা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক কম খরচে উৎক্ষেপনে সফল হয়েছে (যেমন ব্যক্তিগত অর্থায়নে স্পেসএক্স-নির্মিত ফ্যালকন ৯ উৎক্ষেপক যান)। তথাপি, মহাকাশে আনন্দভ্রমণ এবং মহাকাশে উপনিবেশ বাস্তবায়নের জন্য মহাকাশযাত্রার খরচ আরও হ্রাস করা এবং নিরাপত্তা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য করা অবশ্যপ্রয়োজন।

আরও দেখুন

  • Aerial landscape art
  • মঙ্গল গ্রহে মানব অভিযান
  • সৌর জাগতিক প্রোবের তালিকা
  • মহাকাশে যাত্রার কৃতিত্বের তালিকা
  • যাত্রীবিহীন মহাকাশ অভিযানের তালিকা
  • নিউস্পেস
  • অরবিটার (সিমুলেটর)
  • মহাকাশ ব্যবস্থাপনা
  • মহাকাশযানের চালিকাশক্তি
  • কৃত্রিম উপগ্রহ এবং স্পেসপ্রোবের সময়কাল
  • সৌরজাগতিক অনুসন্ধানের সময়কাল

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

বহি:সংযোগ

🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী