বেথুন কলেজ
বেথুন কলেজ বাংলার ইতিহাসে প্রথম মহিলা কলেজ যা ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটনের প্রচেষ্টায় কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
![]() | |
নীতিবাক্য | বিদ্যয়া বিন্দতে অমৃতাম |
---|---|
স্থাপিত | ১৮৪৯ |
অধ্যক্ষ | মণিমালা দাস |
অবস্থান | , , |
অধিভুক্তি | কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় |
ওয়েবসাইট | www |
![]() |
ইতিহাস
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৮১৮ সালে কলকাতায় ডেভিড হেয়ার স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকেই, বাঙালিদের মধ্যে নারীর শিক্ষার অধিকার পুরুষের সমান কিনা তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছিল। এই সোসাইটির একজন সচিব রাজা রাধাকান্ত দেবের নারীশিক্ষার পক্ষে মত থাকলেও স্কুল সোসাইটির অন্যান্য সদস্যদের অনেকেই এবিষয়ে একমত ছিলেন না। ১৮২১ সালে ব্রিটিশ ফরেন সোসাইটির মিস মেরি অ্যান কুককে ভারতে নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য পাঠানো হয়। সোসাইটির মতানৈক্যের কারণে মেরি অ্যান কুককে তার কাজ নির্বাহ করা থেকে বিরত থাকতে হওয়ায় তিনি চার্চ মিশন সোসাইটির সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। তার প্রচেষ্টায় প্রায় ২৭৭টি বালিকা ১০টি স্কুলে পড়বার সুযোগ পায়।[১] এর পর লর্ড আর্মহার্স্টের স্ত্রী লেডি আর্মহার্স্টের উদ্যোগে "বেঙ্গল লেডিস সোসাইটি" গঠন করা হয়। ১৮৩৮ সালের এক সরকারি রিপোর্ট অনুসারে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ১৯টি মেয়েদের স্কুলে প্রায় ৪৫০টি বালিকাকে ভর্তি করা হয়েছিল।[১] তখনও বাংলার সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের এইসব স্কুলে যাবার অনুমতি ছিলনা।
জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন ভারতে নারী শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করলে পণ্ডিত মদন মোহন তর্কালঙ্কার, রামগোপাল ঘোষ, রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। [২]
বেথুন স্কুল
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/0/0c/Laying_of_the_foundation_stone_at_Cornwallis_Square%2C_Bethune_School%2C_Kolkata%2C_West_Bengal%2C_India.jpg/300px-Laying_of_the_foundation_stone_at_Cornwallis_Square%2C_Bethune_School%2C_Kolkata%2C_West_Bengal%2C_India.jpg)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/2/25/Bethune_College_1999_stamp_of_India.jpg/300px-Bethune_College_1999_stamp_of_India.jpg)
কোলকাতার মির্জাপুরে রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের দান করা সুকিয়া স্ট্রীটের বৈঠকখানা জমিতে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। প্রথমে নাম ছিল হিন্দু ফিমেল স্কুল । ২১ জন ছাত্রী নিয়ে সূচনা করে । ভর্তি হয়েছিলেন মদনমোহন তর্কলঙ্কারের দুই মেয়ে, কুন্দমালা আর ভুবনমালা। [৩] ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার এটিকে অধিগ্রহণ করে এবং ১৮৬২-'৬৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এর নাম পরিবর্তন করে বেথুন স্কুল রাখা হয়। মেয়েদের স্কুল তৈরির বিষয়ে বরাবরই বেথুন সাহেবের প্রধান সহকারী , পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই স্কুলের কার্যকারী সমিতির প্রথম সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। মির্জাপুরে নিজের জমি ছেড়ে দিয়েছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। কিন্তু সবাই বেশ ভালই বুঝল অত দূরে মেয়েদের স্কুল হলে আর একটি ছাত্রীও অবশিষ্ট থাকবে না। শেষ পর্যন্ত জমি নেওয়া হল হেদুয়ার পশ্চিম পাড়ে। বর্তমানে এটাই স্থায়ী কেন্দ্র।
জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন তার যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি এই স্কুলকে দান করেন। কর্ণওয়ালিস স্কোয়ারের পশ্চিমদিকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই নভেম্বর বাংলার ডেপুটি গভর্নর স্যার জন লিটার একটি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটনের মৃত্যুর পর বেথুন স্কুলকে ঐ ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। [২] তৎকালীন গভর্নর স্যার হার্বার্ট লিটলারের স্ত্রী বেথুন সাহেবের অনুরোধে একটি অশোক গাছ পুঁতলেন। নারী জাতির অগ্রগতির প্রতীক হিসাবে। ২১টি ছাত্রী নিয়ে শুরু করলেও একটা সময় কমতে লাগল বেথুনের ছাত্রী সংখ্যা। এসে দাঁড়াল মোটে সাতটিতে। ১৮৫১ সালের জুলাই মাসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বড় মেয়ে সৌদামিনী দেবীকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। তারফলে আরও অনেক ছাত্রী উৎসাহিত হলো এখানে ভর্তি হতে।
বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ
বেথুন স্কুলের সভাপতি বিচারপতি স্যার রিচার্ড গার্থ ও সম্পাদক মনোমোহন ঘোষের প্রচেষ্টায় ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১লা আগস্ট বেথুন স্কুল বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। [২]
বেথুন কলেজ
১৮৭৯ সালে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বেথুন স্কুলের প্রথম স্নাতক কাদম্বিনী বসু উচশিক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার স্বীকৃতিতে বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন মাত্র ছাত্রী কাদম্বিনী বসুকে নিয়ে কলেজের পঠন-পাঠন শুরু হয়। [২]
ধর্ম নিরপেক্ষ নারীশিক্ষালয়
ইয়ং বেঙ্গল দল ভারতীয় নারীর কল্যাণের জন্য সদা মুখর ছিল। পূর্বতন হিন্দু স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ও তখনকার বারাসত গভমেন্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্যারীচরণ সরকার (Peary Charan Sarkar) ১৮৪৭ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে বারাসতে বালিকাদের জন্য একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কালীকৃষ্ণ মিত্রর নামে। যার নাম রাখা হয় কালীকৃষ্ণ গার্লস হাই স্কুল। সম্ভবতঃ এই স্কুলটিই বেথুন সাহেবকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল যখন তিনি সেখানে কাউন্সিল অফ এডুকেশনের (শিক্ষা পর্ষদ) সভাপতি হিসাবে পরিদর্শনে যান।[৪]
দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,[৫] মদন মোহন তর্কালঙ্কার [৬] ইত্যাদি কয়েকজনের সুপারিশে স্কুল কমিটির সচিব হিসাবে নিযুক্ত হয়ে বেথুন সাহেব ১৮৪৯ সালে সেকুলার নেটিভ ফিমেল স্কুল (ধর্মনিরপেক্ষ দেশীয় নারী বিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন [৭] । কলকাতায় এইধরনের প্রচেষ্টা এই প্রথম ছিল এবং তা তৎকালীন সমাজে গভীর রেখাপাত করেছিল [৮] ১৮৫১ সালের ১২ই অগষ্ট বেথুন মারা যান। তিনি নিজের স্থাবর ও অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি স্কুলকে দান করে যান[৭] ১৮৫৬ সালে তৎকালীন সরকার এটি অধিগ্রহণ করে ও ১৮৬২ সালে এর নামে রাখা হয় বেথুন স্কুল –[৬]
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ এবং আরো কয়েকজন উদারপন্থী কুড়ি বছর ধরে স্কুলটির ক্রিয়াকাণ্ড সমর্থন করলেও স্কুলটি বৃহত্তর জনসমর্থন হতে বঞ্চিত ছিল। ১৮৬৮ সালে তদানীন্তন প্রধানা শিক্ষিকা মিস পিগট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন কারণ তিনি খ্রীষ্ট ধর্ম পঠনপাঠনের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন যা ভারতীয় সমাজে ভীতিপ্রদ স্ম্লেচ্ছ অর্থাৎ ঘৃণ্য বিদেশী ধর্ম হিসাবে পরিগণিত ছিল। [৯]
প্রতিক্রিয়া
স্কুলটি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের কট্টর অংশ থেকে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যখন চারিদিকে ঢাকা পালকি বা চতুর্দোলায় চড়ে এর ছাত্রীরা সড়ক দিয়ে নতুন স্কুলে পড়তে যেত তখন লোকজন তার দিকে অবাক হয়ে তাকাত ও গালিগালাজ করত।
তখনকার বিখ্যাত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তখনকার জনমানসকে সুন্দর ভাবে চিত্রিত করেছেন:
- যতো ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে,
- এ বি শিখে, বিবি সেজে, বিলাতি বোল কবেই কবে;
- আর কিছুদিন থাকরে ভাই! পাবেই পাবে দেখতে পাবে,
- আপন হাতে হাঁকিয়ে বগি গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে। [৮]
স্কুলটি প্রথম দিকে বহু দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে চলে যতদিননা স্কুলটি অ্যানেট অ্যাক্রয়েড ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ইত্যাদি কিছু ব্রাহ্ম সমাজীয় লোকেদের পরিচালিত বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলিত হয়। বেশ কিছু মেধাবী ছাত্রী এরপর স্কুলটিতে যোগ দেন– কাদম্বিনী বোস (পরে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী), সরলা দাস (পরে সরলা রায়), অবলা দাস (পরে অবলা বসু) এবং সুবামাপ্রভা বসু, যাঁদের সবাই পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বেথুন স্কুল বাঙালি "ভদ্রলোক"দের চোখ খুলে দিয়েছিল। এর দেখাদেখি আরো অনেক মেয়েদের স্কুল এর পরে খুলতে শুরু করে। দ্র্রষ্টব্য বিষয় হল ধর্মনিরপেক্ষ স্কুলগুলি খোলার পর পূর্বের ধর্মপাঠ সর্বস্য স্কুলগুলি উঠে যায়। [৬]
উনিশ শতকের রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে নারীর পুঁথি পাঠ পাপ বলে মানা হত। তারা বিশ্বাস করত সাক্ষর পত্নীর স্বামী নিরক্ষর পত্নীর স্বামীর থেকে তাড়াতাড়ি মারা যায়। এমনকি উনিশশো আশির দশকেও নারীশিক্ষা তীব্র বিরোধিতার চলতে থাকে। অনেক দশক ধরেই বেথুন স্কুলের ছাত্রসংখ্যা অপরিবর্তিত থেকে যায়। এদের অধিংশই ছিল ব্রাহ্ম পরিবারের। ১৮৮৮ সালে বেথুন স্কুলের ১৩৬ জন ছাত্রীর মধ্যে ৮৭ জন ছিল ব্রাহ্ম, ৪৪ জন হিন্দু, এনং ৫ জন খ্রিষ্টান। ১৮৮৬ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজকে পুনর্নবীকরণ করে একটি উচ্চবিদ্যালয়ে (সেকেণ্ডারী স্কুল) পরিণত করা হয়। ১৮৯০ সালে ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেবছর ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলেও মেয়েদের ভর্তির পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়। তার অর্থ ব্রাহ্ম ও খ্রিষ্টান পরিবারের থেকে বড় সংখ্যক মেয়েরা বেথুন ছাড়া অন্যান্য স্কুলেও যেত। ১৮৯৪ সালে ১৩৮ জন ছাত্রীর মধ্যে ৭০ জন ছিল হিন্দু, ৫৫ জন ব্রাহ্ম, এবং ১৩ জন খ্রিষ্টান। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ প্রান্তে এসে তবেই বাংলায় নারী শিক্ষাবিরোধী ভ্রান্ত ধারণাগুলি ধীরে ধীরে অপসারিত হয়। [১০]
অন্তর্ভুক্তি
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই কলেজের বি.এ. ডিগ্রী সম্পূর্ণ রূপে অনুমোদন করে। [২]
কয়েকজন বিখ্যাত প্রাক্তন ছাত্রী
- কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, ভারতের প্রথম দুজন মহিলা স্নাতকদ্বয়ের একজন[১১] এবং ইউরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতিতে শিক্ষিতা প্রথম দক্ষিণ এশীয় মহিলা ডাক্তার।
- চন্দ্রমুখী বসু, কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর সঙ্গেই স্নাতক, পরে হন বেথুন কলেজের অধ্যক্ষ্যা - দক্ষিণ এশীয় কোন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম মহিলা অধ্যক্ষা।
- কামিনী রায়, বাঙালি কবি, সমাজসেবী এবং নারীবাদী ভারতের প্রথম মহিলা অনার্স গ্রাজুয়েট।[১২]
- প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশ বিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, চট্টগ্রাম অস্ত্রগার লুণ্ঠনের নেতৃত্বদানকারী
- লীলা রায়, সমাজ সেবী, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী।
- ফজিলতুন্নেসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ও ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষা।
- কঙ্কাবতী দেবী, বাঙালী গায়িকা ও অভিনেত্রী
বহিঃসংযোগ
- On Bethune College, বাংলাপিডিয়া থেকে।
- About Bethune, calonline.com থেকে।
- কলেজের শতবর্ষের ডাকটিকিট