বিশ্বব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ঋণ[৪] ও অনুদান প্রদান করে। বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য হল বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন। সারা বিশ্বের ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রেরওয়াশিংটন, ডি.সি.-তে অবস্থিত।
সংগঠনটির আর্টিকেলস্ অব এগ্রিমেন্ট (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯ সালে এ সংশোধনীটি কার্যকরী হয়) অনুযায়ী, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেকে সহজতর করা এবং পুঁজির বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, এ দু'টি উদ্দেশ্য হবে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রধান নিয়ামক।[৫] দুইটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিশ্বব্যাংক গঠিত: পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যাংক (International Bank for Reconstruction and Development, IBRD) আর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (International Development Association, IDA)। বিশ্বব্যাংক বিশ্ব ব্যাংক গোষ্ঠী মোট চারটি সদস্যের মধ্যে একটি। অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠান হল ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, বহুপাক্ষিক বিনিয়োগ গ্যারান্টি সংস্থা বা মিগা (Multilateral Investment Guarantee Agency) ও আইসিএসআইডি (International Centre for Settlement of Investment Disputes, ICSID)।[৬]
ইতিহাস
১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রেরনিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস নামক স্থানে জাতিসংঘ মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আর সেই সম্মেলনে দুটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়: আইএমএফ এবং পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যাংক বা বিশ্বব্যাংক। এ সম্মেলনে আরও অনেক দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও দরকষাকষিতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সুস্পষ্ট প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।[৮]:৫২-৫৪
ঐতিহ্যগতভাবে আইএমএফের প্রধান নির্বাচিত হন ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আর বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
১৯৪৪–১৯৬৮
১৯৬৮ সালের আগে বিশ্বব্যাংক যেসব পুনর্গঠনমূলক এবং উন্নয়নমুখী ঋণ প্রদান করত সেগুলো তুলনামূলক কম ছিল। এ সময় আর্থিক রক্ষণশীলতা নীতি গৃহীত হয় এবং ঋণ পেতে হলে দেশগুলোকে কঠিন সব শর্ত পূরণ করতে হত। তবে পরে অধিক হারে ঋণ প্রদান করার প্রয়োজনীয়তা অতি শীঘ্রই অনুভূত হয়।[৮]:৫৬-৬০
প্রথম দেশ হিসেবে ফ্রান্স বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণ করে। ব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন ম্যাকক্লয় অন্য দুইটি ঋণ আবেদনকারী দেশ পোল্যান্ড ও চিলির চেয়ে ফ্রান্সকে বেশি সক্ষম মনে করেছিলেন। ফ্রান্স যে পরিমাণ অর্থের আবেদন করেছিল, তার অর্ধেক (২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) প্রদান করা হয়েছিল; তাও কঠিন শর্তের অধীনে। শর্ত ছিল ঋণ পরিশোধকালে দেশটি অন্য যেকোন ঋণদাতার চেয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণ পরিশোধে অগ্রাধিকার দেবে। এছাড়া দেশটির তৎকালীন বাজেটে ব্যাপক কাটছাঁট করতে হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল কঠোর নজরদারীর মধ্যে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ অবলোকন করছিল। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল দেশটি বিশ্বব্যাংকের শর্তসমূহ সঠিকভাবে পালন করছে কিনা। এছাড়া ঋণ অনুমোদনের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ফরাসি সরকারকে আদেশ দিয়েছিল যে সরকারে যেসব কমিউনিস্ট সদস্য রয়েছে তাদের সবার আগে বিদায় করতে হবে। ফরাসি সরকার তাদের কোয়ালিশন সহযোগী কমিউনিস্ট পার্টি অব ফ্রান্সের সব সদস্যকে সরকার থেকে বিতাড়ন করতে বাধ্য হয়। এ পদক্ষেপের ঘণ্টখানেকের মধ্যে ফ্রান্সের ঋণ অনুমোদন করা হয়।[৯]:২৮৮, ২৯০-২৯১
১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মার্শাল পরিকল্পনা গৃহীত হলে ইউরোপীয় দেশগুলো আর্থিক সহায়তা পাওয়ার নতুন এক উৎসের সন্ধান পায়। এ প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে বিশ্বব্যাংক অ-ইউরোপীয় দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়। ১৯৬৮ সালের আগ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের ঋণপ্রদান কার্যক্রম কেবলমাত্র আয়-বৃদ্ধিকারী অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের অবকাঠামোর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, সড়ক ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র অন্যতম। এ ধরনের ঋণ প্রদান করার উদ্দেশ্য ছিল যাতে দেশগুলো এ অবকাঠামো থেকে উপার্জিত অর্থ ঋণ পরিশোধে ব্যয় করতে পারে।
১৯৬৮–১৯৮০
১৯৬৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের মূল লক্ষ্য ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়তা করা। অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে সংস্থাটির লক্ষ্য গিয়ে দাঁড়ায় সামাজিক পরিসেবা ও অন্যান্য কার্যক্রমের উন্নয়ন। এর ফলে ঋণ প্রদানের পরিমাণ বহুলাংশে বেড়ে যায়।[১০]
এ পরিবর্তন যে মানুষটির হাত ধরে হয়েছিল তার নাম রবার্ট ম্যাকনামারা। মার্কিন প্রেসিডেন্টলিন্ডন বি. জনসন ১৯৬৮ সালে তাকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন।[৮]:৬০-৬৩ ম্যাকনামারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব ও ফোর্ড মোটর কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট থাকাকালে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তা বিশ্বব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন।[৮]:৬২ বিদ্যালয় ও হাসপাতাল নির্মাণ, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার প্রভৃতি কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানটির সহায়তা পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় অধিক হারে বৃদ্ধি করেন। তিনি সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতা দেশগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহের নতুন এক পদ্ধতির প্রচলন করেন। ফলে সংস্থাটির ঋণ প্রদান করার ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বাড়তি ঋণের সংস্থান করার জন্য ম্যাকনামারা উত্তরাঞ্চলের ব্যাংকগুলোর বিপরীতে অন্য কোন উৎস থেকে পুঁজির সংস্থান করার জন্য ব্যাংকের ট্রেজারার ইউজিন রটবার্গকে নির্দেশ দেন। রটবার্গ বৈশ্বিক বন্ড বাজার ব্যবহার করে ব্যাংকের পুঁজির পরিমাণ বাড়াতে সক্ষম হন।[১১]
তবে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণের পরিমাণ গড়ে প্রতি বছর ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়।[১২][১৩] এছাড়া ১৯৮০ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ এবং তার কর্মচারীদের মধ্যে নানাবিধ দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য বিশ্বব্যাংক প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। প্রধানত যেসব ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক নিয়োগ চুক্তি সংক্রান্ত বিবাদের সৃষ্টি হয় ট্রাইব্যুনাল সেখানে তার দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পায়।[১৪]
১৯৮০–১৯৮৯
১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার কর্তৃক মনোনিত এ. ডব্লিউ. ক্লসেন ম্যাকনামারার স্থলাভিষিক্ত হন। ক্লসেন ম্যাকনামারার কর্মীবাহিনীতে বিরাট পরিবর্তন আনেন এবং নতুন আদর্শগত লক্ষ্যের সূত্রপাত ঘটান। ১৯৮২ সালে তিনি সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে অ্যান ক্রুগারকে নিয়োগ করেন। এ নিয়োগ ক্লসেনের নয়া লক্ষ্য সম্পর্কে মোটামুটি আভাস দেয়। ক্রুগার উন্নয়নমূলক অর্থনীতির একজন বিরাট সমালোচক ছিলেন। তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলোকে তিনি নাম দিয়েছিলেন "দান-খোঁজা রাষ্ট্র"।
আশির দশকে বিশ্বব্যাংকের মূল কার্যক্রম ছিল তৃতীয় বিশ্বের ঋণ আদায়সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড। এছাড়া সংস্থাটি কাঠামোগত সমন্বয় পরিকল্পনার অবতারনা করে যার মূল লক্ষ্য ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির লাগাম টেনে ধরা। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের এ কাঠামোগত সমন্বয় প্রকল্পের কারণে "এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার প্রায় এক কোটি শিশু শিক্ষা বঞ্চিত হয়েছে এবং অস্বাস্থ্য ও অপুষ্টির শিকার হয়েছে।".[১৫]
১৯৮৯–বর্তমান
বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও কার্যকলাপ পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করে। এসব কর্মকাণ্ড ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এসব সমালোচনার প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক ১৯৮৯ সালের শুরুর দিকে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ও এনজিওকে তার কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করে।[৮]:৯৩-৯৭ মন্ট্রিল প্রটোকলের সাথে সাথে সংস্থাটি একটি বাস্তবায়ন সংস্থার সৃষ্টি করে যার উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশে ওজোনস্তরের ক্ষতিসাধন কমিয়ে আনা। ২০১৫ সালের মধ্যে ওজোনস্তরের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ ৯৫% কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরপর থেকে তথাকথিত "ছয় কৌশলগত পটভূমি"-এর মধ্যে থেকে বিশ্বব্যাংক পরিবেশ রক্ষার সাথে সাথে উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কর্মসূচী চালিয়ে যায়। যেমন ১৯৯১ সালে বিশ্বব্যাংক ঘোষণা করে যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাঠ কাটা বা পরিবেশের ক্ষতি করে এমন স্থাপনা নির্মাণের জন্য সংস্থাটি কোন অর্থায়ন করবে না।
ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য মহামারী মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংক বিশ্বব্যাপী টিকাদান ও সরবরাহ কার্যক্রম শুরু করে। ২০০০ সালে সংস্থাটি "এইডসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" ঘোষণা করে এবং ২০১১ সালে স্টপ টিউবারকিউলোসিস পার্টনারশিপে যোগ দেয়।[১৬]
ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যকার অলিখিত সমঝোতা অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনিত ব্যক্তিবর্গ নির্বাচিত হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে। প্রথা ভেঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২৩ মার্চ ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসাবে দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক জিম অং কিম-এর নাম ঘোষণা করেন। [১৭] ১৬ এপ্রিল, ২০১২ সালে দাপ্তরিক ভাবে কিম-কে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত করা হয়।[১৮] গত ৫ এপ্রিল, ২০১৯ বিশ্বব্যাংকের ২৫ সদস্যের নির্বাহী পর্ষদ ডেভিড ম্যালপাসকে বিশ্বব্যাংকের ১৩তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে।[১৯] গত ৯ এপ্রিল ২০১৯ থেকে ম্যালপাস আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাংকের দায়িত্ব পালন করছেন।
নেতৃত্ব
বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান হচ্ছে প্রেসিডেন্ট এবং তিনি পুরো বিশ্ব ব্যাংক গোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরিচালনা পর্ষদের সভা এবং ব্যাংকের সার্বিক ব্যবস্থাপনা প্রেসিডেন্টের উপর নাস্ত থাকে। ওইতিহ্যগতভাবে, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট সর্বদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা মনোনীত এবং মার্কিন নাগরিক হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ হয় ৫ বছর।[২০]
ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছে এর প্রধান ব্যবস্থাপক যারা ব্যাংকের বিভিন্ন অঞ্চল, সেক্টর, নেটওয়ার্ক এবং কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব পালন করেন। ব্যবস্থাপনা পর্ষদে দু'জন নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট, তিনজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ২৪ ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন।[২১]