বাহরি রাজবংশ
বাহরি রাজবংশ বা বাহরিয়া মামলুক (আরবি: المماليك البحرية) বেশিরভাগ কুমান-কিপচাক তুর্কি বংশোদ্ভূত একটি মামলুক রাজবংশ ছিল যারা ১২৫০ থেকে ১৩৮২ সাল পর্যন্ত মিশরীয় মামলুক সালতানাত শাসন করেছিল। তারা আইয়ুবীয় রাজবংশকে অনুসরণ করেছিল। এবং দ্বিতীয় মামলুক রাজবংশ বুরজি রাজবংশ তাদের উত্তরাধিকারী হয়েছিল।
মামালিকুল বাহরিয়্যাহ | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
১২৫০–১৩৮২ | |||||||||
বাহরি রাজবংশের সময় মিশরীয় মামলুক সালতানাত | |||||||||
রাজধানী | কায়রো | ||||||||
অন্য ভাষা | আরবি | ||||||||
ধর্ম | সুন্নি ইসলাম | ||||||||
সরকার | রাজতান্ত্রিক | ||||||||
• প্রথম সুলতান | রুকনুদ্দিন বাইর্বাস | ||||||||
ইতিহাস | |||||||||
• প্রতিষ্ঠা | ১২৫০ | ||||||||
• বিলুপ্ত | ১৩৮২ | ||||||||
|
তাদের নামের "বাহরিয়া" অর্থ 'নদীসংক্রান্ত'। শব্দটি মধ্যযুগীয় কায়রোর[ক] রোদাহ দুর্গে নীল নদের (নাহর আল-নীল ) রোদাহ দ্বীপে তাদের আদি বসতি স্থাপনের অবস্থানকে নির্দেশ করে। যেটি নির্মাণ করেছিলেন আইয়ুবীয় সুলতান সালিহ আইয়ুব।[২][খ]
ইতিহাস
মামলুকরা সেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ধনী সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি গঠন করেছিল। যা ১২৫০ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত শারকুল আদনা তথা, মিশর, উত্তর আফ্রিকা এবং শামে স্থায়ী হয়েছিল।
উত্থান
১২৫০ সালে যখন আইয়ুবীয় সুলতান সালিহ আইয়ুব মারা যান, তখন তিনি যে মামলুকদের মালিক ছিলেন, তারা তার পুত্র এবং উত্তরাধিকারী মুয়াযযাম তুরানশাহকে হত্যা করে এবং সালিহের বিধবা পত্নী শাজারাতুদ দুর মিশরের সুলতানা হন। তিনি আতাবেগ (কমান্ডার ইন চিফ) আমির আইবাককে বিয়ে করেন এবং পদত্যাগ করেন, আইবাক সুলতান হন। তিনি ১২৫০ থেকে ১২৫৭ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন।[৫][গ]
মামলুকরা দশ বছরে তাদের ক্ষমতা সুসংহত করে এবং অবশেষে বাহরি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের দ্বারা বাগদাদের পতনের কারণেও তাদের উত্থান সহজ হয়েছিল, যা কার্যকরভাবে আব্বাসীয় খিলাফতকে ধ্বংস করেছিল। এর ফলে কায়রো আরও বিশিষ্ট হয়ে ওঠে এবং তারপরে এটি মামলুকদের রাজধানী ছিল।
মামলুকরা ছিল শক্তিশালী অশ্বারোহী যোদ্ধা যারা তুর্কি স্টেপে জনগণের অনুশীলন এবং আরবদের সাংগঠনিক ও প্রযুক্তিগত পরিশীলিততা এবং ঘোড়সওয়ারের সাথে মিশেছিল। ১২৬০ সালে মামলুকরা বর্তমান ইসরায়েলে অবস্থিত আইন জালুতের যুদ্ধে মঙ্গোল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এবং অবশেষে হানাদারদের আধুনিক ইরাকের এলাকায় পিছু হটতে বাধ্য করে।[৬] মামলুকদের হাতে মঙ্গোলদের পরাজয়ের ফলে দক্ষিণ ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায় মামলুকদের অবস্থান বৃদ্ধি পায়।[৭][ঘ] যুদ্ধের অন্যতম নেতা বাইবার্স বাড়ি ফেরার পথে সুলতান কুতুযকে হত্যার পর নতুন সুলতান হন।[৯][ঙ]
১২৫০ সালে বাইবার্স ছিলেন মামলুক কমান্ডারদের একজন যিনি ফ্রান্সের লুই নবমের ক্রুসেড নাইটদের বিরুদ্ধে মানসুরাহকে রক্ষা করেছিলেন। ক্রুসেডাররা পরে নিশ্চিতভাবে পরাজিত হয়েছিল, ফারিসকুরে বন্দী হয়েছিল এবং মুক্তিপণ দিতে বাধ্য হয়েছিল। বাইবার্সও মিশরের মামলুক দখলে অংশ নিয়েছিলেন। ১২৬১ সালে, তিনি সুলতান হওয়ার পর, তিনি কায়রোতে একটি নামকাওয়াস্তে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন[চ] এবং মামলুকরা ফিলিস্তিনে ক্রুসেডার রাষ্ট্রগুলোর অবশিষ্টাংশের সাথে লড়াই করে। শেষপযর্ন্ত তারা ১২৯১ সালে আক্কা দখল করে।[ছ]
তাতার এবং মঙ্গোল
অনেক তাতার মিশরে বসতি স্থাপন করেছিল এবং বাইবার্সদের দ্বারা নিযুক্ত ছিল।[জ][১৩] এলবিস্তানের যুদ্ধে তিনি মঙ্গোলদের পরাজিত করেন [১৪] এবং আব্বাসীয় খলিফাকে মাত্র ২৫০ জন লোক নিয়ে বাগদাদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে পাঠান, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। ১২৬৬ সালে তিনি সিলিসীয় আর্মেনিয়াকে ধ্বংস করেন এবং ১২৬৮ সালে ক্রুসেডারদের কাছ থেকে অ্যান্টিওক পুনরুদ্ধার করেন।[১৫][ঝ] এছাড়াও তিনি সেলজুক ওহাশশাশিনদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন।[ঞ] এবং তিনি ১২৭৭ সালে তার মৃত্যুর আগে[১৩] প্রথমবারের মতো নুবিয়াতে মুসলিম ক্ষমতা প্রসারিত করেন।
সুলতান কালাউন ১২৮০ সালে সানকুর আশকারের নেতৃত্বে সিরিয়ায় হওয়া একটি বিদ্রোহকে পরাজিত করেন।[১৭][ট] এবং ১২৮১ সালে হিমসের বাইরে আবাকার নেতৃত্বে আরেকটি মঙ্গোল আক্রমণকেও পরাজিত করেন।[১৯] মঙ্গোল হুমকি অতিক্রম করার পর তিনি ১২৮৯ সালে ক্রুসেডারদের কাছ থেকে ত্রিপোলি পুনরুদ্ধার করেন।[২০] তার ছেলে খলিল ১২৯১ সালে শেষ ক্রুসেডার শহর আক্কা দখল করে।[২১]
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/d/d5/Golden_Horde_1389.svg/220px-Golden_Horde_1389.svg.png)
মঙ্গোলরা ১২৯৯ সালে তাদের আগ্রাসন পুনর্নবীকরণ করে।[২২] কিন্তু ১৩০৩ সালে শাকহাবের যুদ্ধে আবার পরাজিত হয়।[২৩] মিশরীয় মামলুক সুলতানরা গোল্ডেন হোর্ডের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।[ঠ] এবং ১৩২২ সালে মঙ্গোলদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি স্থাপন করে।[২৫]
সুলতান নাসির মুহাম্মদ ১৩১৯ সালে একজন মঙ্গোল রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। তার কূটনৈতিক সম্পর্ক আগের যেকোনো সুলতানের তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল এবং এতে বুলগেরীয়, ভারতীয় এবং আবিসিনীয় ক্ষমতাধরদের পাশাপাশি পোপ, আরাগনের রাজা এবং ফ্রান্সের রাজা অন্তর্ভুক্ত ছিল।[২৬] নাসির মুহাম্মদ ১৩১১ সালে একটি খাল পুনঃখননের আয়োজন করেছিলেন, যা আলেকজান্দ্রিয়াকে নীলনদের সাথে সংযুক্ত করেছিল।[২৫] তিনি ১৩৪১ সালে মারা যান।
পতন
পরবর্তীকালে সুলতানদের ক্রমাগত পরিবর্তন প্রদেশগুলোতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এদিকে ১৩৪৯ সালে মিশর এবং সাধারণভাবে শামে কালো মৃত্যু দেখা দেয়, যা অনেক বাসিন্দাকে হত্যা করেছিল বলে কথিত আছে।[২৭][ড]
১৩৮২ সালে শেষ বাহরি সুলতান হাজ্জি দ্বিতীয় সিংহাসনচ্যুত হন এবং সালতানাত সার্কাসীয় আমির বারকুক দ্বারা দখল করা হয়। তিনি ১৩৮৯ সালে বহিষ্কৃত হন কিন্তু ১৩৯০ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। এরপর বুরজি রাজবংশ স্থাপন করেন। [২৮]
সামরিক সংস্থা
সাধারণ স্তরে বাহরি রাজবংশের সময় সামরিক বাহিনীকে কয়েকটি দিক দিয়ে ভাগ করা যায়।
- মামলুক: রাজনৈতিক ও সামরিক ঘাঁটির মূল, এই ক্রীতদাস সৈন্যদের আরও ভাগ করা হয়েছিল খাসাকি (সাম্রাজ্যিক রক্ষীদের সাথে তুলনীয়), রাজকীয় মামলুক (সুলতানের অধীনে সরাসরি মামলুক) এবং নিয়মিত মামলুক (সাধারণত স্থানীয় আমিরদের কাছে নিযুক্ত)।
- আল-হালকা: প্রাথমিকভাবে স্বাধীনভাবে জন্ম নেওয়া পেশাদার বাহিনী, তারাও সরাসরি সুলতানের অধীন।
- ওয়াফিদিয়া: এরা হল তুর্কি এবং মঙ্গোল যারা মঙ্গোল আক্রমণের পর রাজবংশের সীমান্তে চলে এসেছিল, সাধারণত সামরিক পরিষেবার বিনিময়ে ভূমি অনুদান দেওয়া হয়, তারা সুপরিচিত বাহিনী।
- অন্যান্য শুল্কগ্রহণকারী: প্রাথমিকভাবে বেদুইন উপজাতি, তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তুর্কোমান এবং অন্যান্য বসতি স্থাপনকারী আরবদের বিভিন্ন দলও।
বাহরি সুলতানদের তালিকা
রাজকীয় উপাধি | ব্যক্তিগত নাম | শাসনকাল | |
---|---|---|---|
মালিকা ইসমাতুদ্দিন উম্মে খলিল الملکہ عصمہ الدین أم خلیل | শাজারাতুদ দুর شجرة الدر | ১২৫০–১২৫০ | |
মালিকুল মুইয ইযযুদ্দিন আইবাক তুর্কমানি জাশনাকির সালিহি الملک المعز عز الدین أیبک الترکمانی الجاشنکیر الصالحی | ইযযুদ্দিন আইবাক عز الدین أیبک | ১২৫০–১২৫৭ | |
সুলতানুল আশরাফ سلطان الاشرف | মুযাফফরুদ্দিন মুসা مظفر الدین موسی | ১২৫০–১২৫২[ঢ] | |
সুলতানুল মানসুর سلطان المنصور | নুরুদ্দিন আলী نور الدین علی | ১২৫৭–১২৫৯ | |
সুলতানুল মুযাফফর سلطان المظفر | সাইফুদ্দিন কুতুয سیف الدین قطز | ১২৫৯–১২৬০ | |
সুলতান আবুল ফুতুহ – سلطان ابو الفتوح যাহির - বুন্দুকদারি - | রুকনুদ্দিন বাইবার্স
| ১২৬০–১২৭৭ | |
সুলতানুস সাইদ নাসরুদ্দিন
| মুহাম্মাদ বারাকাহ খান محمد برکہ خان | ১২৭৭–১২৭৯ | |
সুলতানুল আদিল سلطان العادل | বদরুদ্দিন সোলামিশ
| ১২৭৯ | |
মানসুর – المنصور আলফি - الالفی সালেহি - | সাইফুদ্দিন কালাউন سیف الدین قلاوون | ১২৭৯–১২৯০ | |
সুলতানুল আশরাফ سلطان الاشرف | সালাহুদ্দিন খলিল صلاح الدین خلیل | ১২৯০–১২৯৩ | |
নাসির الناصر | নাসিরুদ্দিন মুহাম্মাদ ناصر الدین محمد | ১২৯৩–১২৯৪ (প্রথম শাসন) | |
আদিল তুরকি মুগলি العادل الترکی المغلی | যাইনুদ্দিন কিতবুগা زین الدین کتبغا | ১২৯৪–১২৯৭ | |
মানসুর المنصور | হুসামুদ্দিন লাজিন حسام الدین لاچین | ১২৯৭–১২৯৯ | |
নাসির الناصر | নাসিরুদ্দিন মুহাম্মাদ ناصر الدین محمد | ১২৯৯–১৩০৯ (দ্বিতীয় শাসন) | |
সুলতানুল মুযাফফর জাশনাকির سلطان المظفرالجاشنکیر | রুকনুদ্দিন বাইবার্স رکن الدین بیبرس | ১৩০৯ | |
নাসির الناصر | নাসিরুদ্দিন মুহাম্মাদ ناصر الدین محمد | ১৩০৯–১৩৪০ (তৃতীয়শাসন) | |
মানসুর المنصور | Sayf-ad-Din Abu-Bakr سیف الدین أبو بکر | ১৩৪০–১৩৪১ | |
আশরাফ الأشرف | Ala-ad-Din Kujuk علاء الدین کجک | ১৩৪১–১৩৪২ | |
সুলতানুন নাসির سلطان الناصر | Shihab-ad-Din Ahmad شھاب الدین أحمد | ১৩৪২ | |
সুলতানুস সালিহ سلطان الصالح | Imad-ad-Din Ismail عماد الدین إسماعیل | ১৩৪২–১৩৪৫ | |
সুলতানুল কামিল سلطان الکامل | Sayf-ad-Din Shaban I سیف الدین شعبان اول | ১৩৪৫–১৩৪৬ | |
সুলতানুল মুযাফফার سلطان المظفر | Sayf-ad-Din Hajji I سیف الدین حاجی اول | ১৩৪৬–১৩৪৭ | |
Al-Nasir Abu Al-Ma'ali الناصر أبو المعالی | Badr-ad-Din Al-Hasan بدر الدین الحسن | ১৩৪৭–১৩৫১ (প্রথম শাসন) | |
Sultan As-Saleh سلطان الصالح | Salah-ad-Din bin Muhammad
| ১৩৫১–১৩৫৪ | |
Al-Nasir Abu Al-Ma'ali Nasir-ad-Din الناصر أبو المعالی ناصر الدین | Badr-ad-Din Al-Hasan بدر الدین الحسن | ১৩৫৪–১৩৬১ (দ্বিতীয় শাসন) | |
Al-Mansur المنصور | Salah-ad-Din Muhammad صلاح الدین محمد | ১৩৬১–১৩৬৩ | |
Al-Ashraf Abu Al-Ma'ali
| Zayn-ad-Din Shaban II زین الدین شعبان ثانی | ১৩৬৩–১৩৭৬ | |
Al-Mansur المنصور | Ala-ad-Din Ali علاء الدین علی | ১৩৭৬–১৩৮২ | |
Sultan As-Saleh سلطان الصالح | Salah-ad-Din Hajji II صلاح الدین حاجی ثانی | ১৩৮২ (প্রথম শাসন) | |
যাহির الظاہر | সাইফুদ্দিন বারকুক سیف الدین برقوق | ১৩৮২–১৩৮৯[ণ] | |
Sultan As-Saleh سلطان الصالح المظفر المنصور | Salah-ad-Din Hajji II صلاح الدین حاجی ثانی | ১৩৮৯ (দ্বিতীয় শাসন) | |
১৩৮৯–৯০ খ্রিস্টাব্দে বুরজি রাজবংশের সাইফুদ্দিন বারকুক মামলুক সালতানাত (কায়রো) দখল করে নেন। যার ফলে বাহরি রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে। |
আরও দেখুন
মন্তব্য
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
বহিঃসংযোগ
উইকিমিডিয়া কমন্সে বাহরি রাজবংশ সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।