বাস্তব সংখ্যা

গণিতে, বাস্তব সংখ্যা (ইংরেজি:Real number) হলো একটি অবিচ্ছিন্ন পরিমাণের মান যা একটি রেখা বরাবর দূরত্ব উপস্থাপন করে বা প্রদর্শন করে। অন্যভাবে বলা যায়, বাস্তব সংখ্যা হলো একটি পরিমাণ যাকে একটি অসীম সংখ্যক দশমিক প্রসারণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে, রেনে দেকার্ত, সর্বপ্রথম বহুপদী সমীকরণের বাস্তব এবং কাল্পনিক মূল বা বীজ এর পার্থক্য নির্দেশ করতে রিয়েল বা বাস্তব বিশেষণটি ব্যবহার করেন।[১] বাস্তব সংখ্যা বলতে সকল মূলদ সংখ্যা যেমন: পূর্ণ সংখ্যা (–৫) এবং ভগ্নাংশ বা ৪/৩ এবং সকল অমূলদ সংখ্যা যেমন- ২ এর বর্গমূল বা (১.৪১৪২১৩৫৬. . .) যা একটি বীজগাণিতিক সংখ্যা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, সকল ট্রান্সেডেন্টাল বা তুরীয় সংখ্যা যেমন- π (৩.১৪১৫৯২৬৫...)।[২] বাস্তব সংখ্যা প্রায়শ পর্যবেক্ষণযোগ্য ভৌত বিষয় যেমন- সময়, ভর, শক্তি এবং একক মাত্রা, দূরত্ব, গতিবেগ, ত্বরণ, বল, ভরবেগ প্রভৃতি পরিমাপকরণে ব্যবহৃত হয়। বাস্তব সংখ্যার সেটকে R অথবা এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।[৩] বাস্তব সংখ্যাগুলোকে একটি অসীম দৈর্ঘ্যের সরলরেখায় অবস্থিত পরস্পর সমদূরবর্তী অসংখ্য বিন্দু দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই রেখাকে বলা হয়, সংখ্যারেখা বা বাস্তব সংখ্যা রেখা। যেকোনো বাস্তব সংখ্যা একটি সম্ভাব্য অসীম দশমিক উপস্থাপনা দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে, যেমন- ৮.৬৩২ যেখানে প্রতিটি ক্রমিক অঙ্ক পূর্ববর্তী সংখ্যার এক দশমাংশের একক হিসেবে পরিমাপ করা হয়। [৪] বাস্তব সংখ্যারেখাকে একটি জটিল সমতলের অংশ ধরা হয় এবং বাস্তব সংখ্যাগুলো হলো ঐ সমতলে অবস্থিত জটিল সংখ্যার অংশ।

বাস্তব সংখ্যার সেট বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত প্রতীক
বাস্তব সংখ্যাগুলোকে অসীম দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সংখ্যারেখার অসংখ্য বিন্দু হিসেবে প্রকাশ করা হয়।

বিশুদ্ধ গণিতের আধুনিক মান অনুযায়ী, বাস্তব সংখ্যার উপরিউক্ত বিবরণ যথেষ্ট সুসংজ্ঞায়িত নয়। প্রকৃতপক্ষে, উনবিংশ শতকের গণিতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিকাশগুলোর মধ্যে একটি হলো- বাস্তব সংখ্যার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ণয় ও তা অনুধাবন। বর্তমান আদর্শ স্বতঃসিদ্ধ সংজ্ঞা হলো যে, বাস্তব সংখ্যাগুলো আইসোমরফিজম পর্যন্ত একটি অনন্য ডিডেকাইন্ড-কমপ্লিট অর্ডারড ক্ষেত্র ( ; + ; · ; <), তৈরি করে। অন্যদিকে, বাস্তব সংখ্যার জনপ্রিয় গঠনমূলক সংজ্ঞা হলো- (মূলদ সংখ্যার) কচি অনুক্রম, ডিডেকাইন্ড কাট, ও অসীম দশমিক প্রসারণ এর গাণিতিক প্রক্রিয়া এবং ক্রম সম্পর্ক সহ একত্রে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত করে। এসব সংজ্ঞা, স্বতঃসিদ্ধ সংজ্ঞার সমার্থক ও সমতুল্য। বাস্তব সংখ্যার সেট অসংখ্য সেট। এই অর্থে যে, সমস্ত স্বাভাবিক সংখ্যার সেট এবং সব বাস্তব সংখ্যার সেট উভয়ই অসীম সেট, বাস্তব সংখ্যা থেকে স্বাভাবিক সংখ্যা পর্যন্ত কোনো এক-এক অপেক্ষক হতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে, সকল বাস্তব সংখ্যার অঙ্কবাচকতা প্রকাশ করা হয় "" এই প্রতীক দিয়ে এবং একে কনটিয়ামের অঙ্কবাচকতা বলা হয়। আরো উল্লেখ্য যে, এটি অবশ্যই সকল স্বাভাবিক সংখ্যার সেট (যাকে , 'আলেফ-নট' বলা হয়) এর থেকে বৃহত্তম হবে। বাস্তব সংখ্যার অঙ্কবাচকতার এমন কোনো উপসেট নেই, যা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে থেকে বৃহত্তর এবং সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে থেকে ক্ষুদ্রতর।— এমন বিবৃতিকে কনটিনিয়াম হাইপোথিসিস বলা হয়। আধুনিক গণিতশাস্ত্রের আদর্শ সংস্থা এর মতে— জারমেলো-ফ্রেংকেল সেট তত্ত্ব এবং নির্বাচন স্বতঃসিদ্ধ বা (জেএফসি) অনুযায়ী উপরিউক্ত বিবৃতিটি প্রমাণযোগ্যও নয়, আবার, খণ্ডনযোগ্যও নয়। বস্তুত, জেএফসি-এর কিছু মডেল কনটিনিয়াম হাইপোথিসিস এর শর্ত পূরণ করলেও, অন্যগুলো তা লঙ্ঘন করে।[৫]

ইতিহাস

বাস্তব সংখ্যা যার মধ্য সকল মূলদ সংখ্যা , আবার, যাতে সকল পূর্ণ সংখ্যা , ও সকল স্বাভাবিক সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ নাগাদ প্রাচীন মিশরীয়গণ সাধারণ ভগ্নাংশের ব্যবহার জানত; আবার, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ নাগাদ প্রাচীন বৈদিক যুগে শূল্ব সূত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে অমূলদ সংখ্যার বর্ণনা উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০-৬৯০ অব্দের দিকে ভারতীয় গণিতবিদ যেমন- মানব সংখ্যার অমূলদত্ব সম্পর্কে জানতেন। তিনি কিছু সংখ্যার বর্গমূল নির্ণয় করেন, যেমন- ২ ও ৬২ এর বর্গমূল। তবে তিনি এই সংখ্যাগুলোর বর্গমূল পুরোপুরি নিঁখুতভাবে নির্ণয় করতে পারেন নি।[৬] প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাস অমূলদ সংখ্যার গুরুত্ব অনুধাবন করেন ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অমূলদ সংখ্যা ব্যবহার করেন। তিনি ২ এর বর্গমূলের অমূলদত্ব ব্যাখ্যা করেন।

মধ্যযুগে, ভারতীয় ও চীনা গণিতবিদগণ শূন্য, ঋণাত্মক সংখ্যা, পূর্ণসংখ্যা এবং ভগ্নাংশ সংখ্যা সম্পর্কে অবগত হয় এবং বিভিন্নক্ষেত্রে এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। পরবর্তীতে, এসব গণিতবিদদের হাত ধরে আরবীয় গণিতবিদগণ উপরিউক্ত সংখ্যা ও অমূলদ সংখ্যা ধারণার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে। আরবীয় গণিতবিদগণ অমূলদ সংখ্যাকে বীজগাণিতিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং এর ফলে তাদের দ্বারা অ্যালজেব্রা বা বীজগণিতের উদ্ভব ও বিস্তৃত বিকাশ সাধিত হয়। [৭] আরবীয় গণিতবিদগণ সংখ্যা এবং ব্যাপকতাকে একীভূত করে বাস্তব সংখ্যা ধারণা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। [৮] মিশরীয় গণিতবিদ আবু কামিল শুজা ইবনে আসলাম (৮৫০-৯৩০ খ্রিস্টাব্দ) সর্বপ্রথম অমূলদ সংখ্যার সাহায্যে দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধান নির্ণয় করেন। এছাড়া, তিনি সমীকরণের সহগ, যা প্রায়শ বর্গমূল, ঘনমূল এবং চতুর্থক মূল পর্যন্ত হয়, তা নির্ণয় করেন অমূলদ সংখ্যা বা বাস্তব সংখ্যার সাহায্যে। [৯]ষোড়শ শতকে, সাইমন স্টিভিন আধুনিক দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির ভিত্তি ব্যাখ্যা করেন দিয়ে এবং জোর দিয়ে বলেন যে, দশ ভিত্তিতে মূলদ এবং অমূলদ সংখ্যার কার্যপদ্ধতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সপ্তদশ শতাব্দীতে, ডেকার্ত প্রথম বহুপদী সমীকরণের বীজ নির্ণয়ে "রিয়েল" বা "বাস্তব" শব্দ প্রয়োগ করেন। তিনি দেখান যে, বাস্তব সংখ্যা, "কাল্পনিক" বা "অবাস্তব" সংখ্যা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।১৮দশ এবং ১৯শ শতকে, বাস্তব সংখ্যার অংশ অমূলদ সংখ্যা ও তুরীয় সংখ্যা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে৷ জন হেনরিচ ল্যাম্বার্ট (১৭৬১) প্রথম প্রমাণ করেন যে, পাই মূলদ সংখ্যা হতে পারে না; যদিও প্রমাণটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। পরবর্তীতে, অ্যাড্রিয়েন ম্যারি ল্যাগেনড্রি (১৭৯৪) প্রমাণটি সম্পূর্ণ করেন,[১০] এবং আরো প্রমাণ করেন যে, পাই কোনো মূলদ সংখ্যার বর্গমূল নয়। [১১] পাওলো রুফিনি (১৭৯৯) এবং নিলস্ হেনরিক আবেল (১৮৪২) উভয়েই আবেল-রুফিনি উপপাদ্য আবিষ্কার করেন এবং প্রমাণ করেন, পাটিগণিতীয় গাণিতিক প্রক্রিয়া ও সমীকরণের বীজ যুক্ত সাধারণ সূত্র দিয়ে, কুইন্টিক বা উচ্চতর সমীকরণগুলো সমাধান করা যাবে না। ফরাসি গণিতবিদ এভরিস্টে গ্যালোস (১৮৩২), একটি প্রদত্ত সমীকরণ সমাধানে র্যাডিকেল বা সমীকরণ বীজ ব্যবহার করার কৌশল আবিষ্কার করেন ও প্রদর্শন করেন। যাকে গ্যালোস তত্ত্ব বলা হয় ও যা সমীকরণ সমাধানে নতুন দিগন্ত তৈরি করে। ফরাসি গণিতবিদ জোসেফ লিউভল (১৮৪০) প্রমাণ করেন যে, e অথবা e, পূর্ণসংখ্যা ভিত্তিক দ্বিঘাত সমীকরণের বীজ বা মূল হতে পারবে না। তিনি আরো প্রমাণ করেন, তুরীয় সংখ্যার অস্তিত্ব রয়েছে। জর্জ ক্যান্টর (১৮৭৩) এই প্রমাণটি সম্প্রসারণ করেন এবং খুব সংক্ষিপ্তভাবে পুনরায় এটি প্রমাণ করেন। [১২]

চার্লস হারমাইট (১৮৭৩) সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন, '''e''' একটি ট্রানসেডেনটাল বা তুরীয় সংখ্যা। জার্মান গণিতবিদ ফার্ডিনান্দ ভন লিন্ডম্যান (১৮৮২) প্রমাণ করেন, π একটি ট্রানসেডেনটাল বা তুরীয় সংখ্যা। পরবর্তীতে, ওয়েরসট্রাস (১৮৮৫), লিন্ডম্যানের প্রমাণকে সরলীকরণ করেন, আরো পরে ডেভিড হিলবার্ট (১৮৯৩) এবং সর্বশেষ অ্যাডলফ হারউইটজ ও পল গর্ডন আধুনিকভাবে ঐ প্রমাণটি সম্পাদন করেন। [১৩] [১৪] ১৮ শতকে ক্যালকুলাসের বিকাশে বাস্তব সংখ্যার সম্পূর্ণ সেটকে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত না করেই ব্যবহার করা হতো। ১৮৭১ সালে জর্জ ক্যান্টর সুস্পষ্টভাবে ক্যালকুলাসে বাস্তব সংখ্যা সফল প্রয়োগ করেন। প্রথম সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ১৮৭১ সালে জর্জ ক্যানটর দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৭৪ সালে, তিনি দেখিয়েছেন, সমস্ত বাস্তব সংখ্যার সেট অগণিতভাবে অসীম, কিন্তু সমস্ত বীজগাণিতিক সংখ্যার সেট গণনাযোগ্যভাবে অসীম। ব্যাপকভাবে প্রচলিত বিশ্বাসের পরিবর্তে বিশ্বাস করা হয়, তাঁর প্রথম পদ্ধতিটি, ১৮৭১ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত ডায়গোনাল আর্গিউমেন্ট নয়।

শ্রেণিবিভাগ

বাস্তব সংখ্যাকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:

  1. মূলদ সংখ্যা এবং
  2. অমূলদ সংখ্যা

বাস্তব সংখ্যার স্বীকার্যসমূহ

যে সকল স্বীকার্যসমূহের উপরে বাস্তব সংখ্যা ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত সেগুলি হচ্ছেঃ

  1. আবদ্ধতা (Closure)
  2. অনন্যতা (Uniqueness)
  3. বিনিময়যোগ্যতা (Commutativity)
  4. সংযোজনযোগ্যতা (Associativity)
  5. বণ্টনযোগ্যতা (Distributivity)
  6. অভেদকের অস্তিত্ব (Existence of identity)
  7. বিপরীতকের অস্তিত্ব (Existence of inverse)
  8. ব্যাবহার যোগ্যতা।

ইত্যাদি

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী