ত্রিত্ব
খ্রিস্টানদের ত্রিত্ব (আক্ষ. 'ত্রিমূর্তি';[১] লাতিন: Trinitas, যা লাতিন: trinus হতে আগত)[২] হলো অধিকাংশ খ্রিস্টীয় মণ্ডলি কর্তৃক স্বীকৃত ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় তত্ত্ব, যেখানে এক ঈশ্বরকে তিনজন সহ-সমান, সহ-অনন্ত, স্থায়ীভাবে বিদ্যমান ঈশ্বরত্বের মিলন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে:[৩][৪][৫][৬][৭] পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর (যিশু খ্রিস্ট) ও পবিত্র আত্মা ঈশ্বর, অর্থাৎ এক সারবত্ত্বা/সত্ত্বা/প্রকৃতি (সমজাতীয়তা) তিনটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে (অস্তিত্ব) বিভক্ত।[৮]
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/0/07/Shield-Trinity-Scutum-Fidei-Bengali.jpg/220px-Shield-Trinity-Scutum-Fidei-Bengali.jpg)
চতুর্থ লেটারীয় পরিষদে ঘোষণা করা হয়েছিল, পিতা জন্ম দেন, পুত্র জন্ম নেন এবং পবিত্র আত্মা এগিয়ে আসেন।[৯][১০][১১] এই প্রেক্ষাপটে, একটি সত্ত্বা/প্রকৃতি দ্বারা ঈশ্বর কী তা সংজ্ঞায়িত করা হয়, যেখানে তিনটি ব্যক্তিত্ব দ্বারা ঈশ্বর কে তা সংজ্ঞায়িত করা হয়।[১২][১৩] এর মাধ্যমে অবিলম্বেই তাঁদের পার্থক্য ও তাঁদের অবিচ্ছেদ্য ঐক্য প্রকাশিত হয়। এভাবে সৃষ্টি ও অনুগ্রহের সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে তিনজন ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্বের একক বিভক্ত ক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ত্রিত্বে প্রত্যেক ব্যক্তিত্বের নিজেদের জন্য অনন্য বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশ পায়, যার ফলে প্রমাণিত হয় যে সবকিছু "পিতার কাছ থেকে," "পুত্রের মাধ্যমে" এবং "পবিত্র আত্মার মাঝে" আবির্ভূত হয়।[১৪]
এই মতবাদটিকে বলা হয় ত্রিত্ববাদ এবং এর অনুসারীদের বলা হয় ত্রিত্ববাদী, অন্যদিকে এর বিরোধীদের বলা হয় ত্রিত্ববাদ-বিরোধী বা অত্রিত্ববাদী। খ্রিস্টান অত্রিত্ববাদীদের মধ্যে রয়েছে একত্ববাদ, দ্বিত্ববাদ ও মডালিজম।
যদিও আধুনিক ত্রিত্ববাদের বিকশিত মতবাদটি নূতন নিয়মের বইগুলোতে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয় নি, তথাপি নূতন নিয়মে ঈশ্বরের একটি ত্রয়ী ধারণা রয়েছে[১৫] এবং এতে বেশ কয়েকটি ত্রিত্ববাদী সূত্র রয়েছে।[১৬][১৭] ত্রিত্বের মতবাদটি প্রথম প্রণীত হয়েছিল প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টান ও গির্জার ফাদারদের মধ্যে যখন তাঁরা তাঁদের শাস্ত্রীয় নথিপত্র ও পূর্ববর্তী ঐতিহ্যে যিশু ও ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করেছিলেন।[১৮] খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ত্রিত্ব সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা রয়েছে: ফিলিওকুই, শাশ্বত কার্যকরী অধীনতাবাদ, অধীনতাবাদ ও সামাজিক ত্রিত্ববাদ।[১৯][২০][২১][২২]
যদিও ত্রিত্ব মূলত একটি খ্রিস্টান ধারণা, তথাপি ইহুদি ধর্মেও এর একটি সমান্তরাল দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, বিশেষ করে কাব্বালা ঐতিহ্যের রচনাসমূহে।[২৩]
দৃষ্টিপাত
“[খ্রিস্টান ত্রিত্ব অনুযায়ী,] একজন ঈশ্বর বিদ্যমান, সম্পূর্ণ পৃথক তিনজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিদ্যমান: পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা। তিনজনের প্রত্যেক ব্যক্তিই ঈশ্বর: পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর, পবিত্রআত্মা ঈশ্বর। পিতা পুত্র নন, পুত্র পবিত্র আত্মা নন, পিতা পবিত্র আত্মা নন।”[৭]
বাইবেল
নূতন নিয়ম
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/1/17/Andrej_Rubl%C3%ABv_001.jpg/220px-Andrej_Rubl%C3%ABv_001.jpg)
যদিও নূতন নিয়মের বইগুলোতে ত্রিত্বের বিকশিত মতবাদটি স্পষ্ট নয়, তথাপি নূতন নিয়মের মথি ২৮:১৯, ২ করিন্থীয় ১৩:১৪, এফেসীয় ৪:৪-৬, ১ পিতর ১:২ ও প্রত্যাদেশ ১:৪–৬ সহ বেশ কিছু স্থানে ত্রিত্ববাদী সূত্র রয়েছে।[১৬][২৪] প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টানদের ভাবনায় যিশু প্রদত্ত মহান দায়িত্ব ("অতএব যান এবং সকল জাতিকে শিষ্যত্ব প্রদান করুন, তাঁদের পিতা ও পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে অপ্সুদীক্ষা দিন") ও প্রেরিত পৌলের আশীর্বাদের ("প্রভু যিশু খ্রিস্টের অনুগ্রহ এবং ঈশ্বরের ভালোবাসা এবং পবিত্র আত্মার সাহচর্য আপনাদের সকলের সাথে থাকুক) মতো লিখনিগুলো ধর্মতত্ত্ববিদদের পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার মধ্যে সম্পর্ককে স্পষ্ট করার প্রয়াসে ইতিহাস জুড়ে তাড়িত করেছে৷
পরিশেষে, পুরাতন নিয়মে পাওয়া ঈশ্বর, যিশু ও আত্মার বিভিন্ন উল্লেখগুলোকে একত্রিত করে গঠন করা হয়েছিল ত্রিত্বের ধারণা, যা হলো তিন ব্যক্তি ও এক সত্ত্বার মধ্যে এক ঈশ্বরের অস্তিত্ব। তৎকালীন সময়ে ত্রিত্বের ধারণাটি খ্রিস্টীয় মণ্ডলি ব্যবহার করেছিল ত্রিত্বের বিকল্প মতামত যে তিনজন কীভাবে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে তার বিরুদ্ধচারণ করতে এবং তাঁদের নিজেদের বিরুদ্ধে আনা দুই বা তিনটি ঈশ্বরের উপাসনার অভিযোগ প্রতিহত করতে।[২৫]
১ যোহন ৫:৭–৮
আধুনিক বাইবেলের পণ্ডিতরা অনেকাংশে একমত যে ১ যোহন ৫:৭–৮, যা ৪র্থ শতাব্দীর পর থেকে লাতিন ও গ্রিক গ্রন্থে দেখা যায় এবং কিং জেমস সংস্করণের মতো পরবর্তী অনুবাদগুলোতে পাওয়া যায়, যা প্রাচীনতম গ্রিক ও লাতিন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। জোহানাইন কমা নামে পরিচিত এই শ্লোক দুটিকে বেশিরভাগ পণ্ডিতরাই পরবর্তীকালের কোনো অনুলিপিকার দ্বারা অতিরিক্ত সংযোজন বলে সম্মত হয়েছেন বা যাকে একটি পাঠ্যটীকা বলা হয়[২৬] এবং এটি মূল পাঠের অংশ নয়। কিং জেমস সংস্করণে (১৬১১) থাকা শ্লোক দুটি (সংযোজিত অংশটি ইটালিক অক্ষরে লিখিত এবং তৃতীয় বন্ধনী দ্বারা আবদ্ধ) হলো:
৭তাঁর জন্য তিনজন সাক্ষ্য দিচ্ছেন [স্বর্গে, পিতা, বাক্য ও পবিত্র আত্মা এবং এই তিনজনই এক। ৮এবং তিনজন সাক্ষ্য দিচ্ছেন পৃথিবীতে], আত্মা, জল ও রক্ত এবং এই তিনজনই একমত৷
শ্লোক দুটি গ্রিক পুরাতন নিয়মের ইথিওপীয়, আরামাইক, সিরীয়, স্লাভীয়, প্রাথমিক আর্মেনীয়, জর্জীয় ও আরবি অনুবাদে অনুপস্থিত। আধুনিক বাংলা অনুবাদেও এই অংশটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। এটি প্রাথমিকভাবে লাতিন পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়, যদিও কিছু গ্রিক, স্লাভোনীয় ও পরবর্তী আর্মেনীয় পাণ্ডুলিপিতে এটি রয়েছে।[২৭][২৮][২৯]