তড়িৎ প্রবাহ

কোনো পরিবাহীতে ইলেক্ট্রন এর প্রবাহ

তড়িৎ প্রবাহ, বা সাধারণ ভাষায় বিদ্যুৎ প্রবাহ, হচ্ছে আহিত কণা যেমন- ইলেকট্রন অথবা আয়নের প্রবাহ যা কোনো তড়িৎ পরিবাহী বা শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া। কোনো ক্ষেত্র বা কন্ট্রোল ভলিউমের মধ্য দিয়ে তড়িৎ আধানের প্রবাহের নিট হারের মাধ্যমে এটি পরিমাপ করা হয়।[১]:[২]:৬২২ চলাচলকারী কণাগুলোকে আধান বাহক বলা হয়, যেগুলো পরিবাহীর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রকমের হতে পারে। প্রায়শই বৈদ্যুতিক সার্কিটগুলিতে আধান বাহক হলো চলমান বা মুক্ত ইলেকট্রন। সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে ইলেকট্রন বা হোল উভয়ই আধান বাহক হতে পারে। তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থে আধান বাহক হলো আয়ন। আবার আয়নিত গ্যাস বা প্লাজমাতে আধান বাহক হলো আয়ন ও ইলেকট্রন।[৩]

তড়িৎ প্রবাহ
একটি সরল বৈদ্যুতিক বর্তনী যাতে তড়িৎ প্রবাহকে i দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। বিভব (V), তড়িৎ প্রবাহ (I) ও রোধের মধ্যকার সম্পর্ক (R) হলো V=IR; এটি ও‍’মের সূত্র বলেও পরিচিত।
সাধারণ প্রতীক
I
এসআই এককঅ্যাম্পিয়ার
অন্যান্য রাশি হতে উৎপত্তি
মাত্রা

তড়িৎ প্রবাহের এসআই একক হলো অ্যাম্পিয়ার। প্রতি সেকেন্ডে এক কুলম্ব পরিমাণ আধান কোনো প্রস্থচ্ছেদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলে তাকে এক অ্যাম্পিয়ার বলে। এটি এসআই পদ্ধতির একটি মৌলিক একক (প্রতীক: A)।[৪]:১৫ তড়িৎ প্রবাহ পরিমাপ করা হয় অ্যামিটারের মাধ্যমে।[২]:৭৮৮

তড়িৎ প্রবাহ যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে তা বৈদ্যুতিক মোটর, জেনারেটর, আবেশক এবং ট্রান্সফরমারে ব্যবহার করা হয়। সাধারণ পরিবাহকের ক্ষেত্রে তড়িৎ প্রবাহ জুলের তাপীয় ক্রিয়ার সৃষ্টি করে যার ফলে, উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতিতে আলো জ্বলে। সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল তড়িৎপ্রবাহ তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিঃসরণ করে, যা টেলিযোগাযোগে ব্যবহার করে তথ্য সম্প্রচার করা হয়।

প্রতীক

তড়িৎ প্রবাহের প্রচলিত প্রতীক হলো I, এটি এসেছে একটি ফরাসি বাক্যাংশ intensité du courant (ইতেঁসিঁতে দু ক্যুরাঁ ) থেকে যার অর্থ "তড়িৎ প্রবাহ তীব্রতা"।[৫][৬] তড়িৎ প্রবাহ তীব্রতাকে অনেক সময় সহজভাবে কারেন্টও বলা হয়।[৭] I প্রতীকটি ১৮২০ সালে বিজ্ঞানী অঁদ্রে-মারি অম্পেয়্যার তাঁর অ্যাম্পিয়ারের বল নীতি সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। তাঁর নামানুসারেই তড়িৎ প্রবাহের একক অ্যাম্পিয়ার রাখা হয়, যেটি ফরাসি অম্পেয়্যার নামের ইংরেজি উচ্চারণ।[৮] প্রতীকটি ফ্রান্স হয়ে গ্রেট ব্রিটেনে পৌঁছালে সেখানে সেটি একটি একক হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যদিও ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত অন্তত একটি জার্নাল তাঁদের লেখায় প্রতীকটিকে C থেকে I এ পরিবর্তন করেনি।[৯]

প্রচলিত রীতি

তড়িৎ বর্তনীতে যে দিকে তড়িৎ প্রবাহিত, ইলেকট্রনগুলো তার বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়।
একটি তড়িৎ বর্তনীতে তড়িৎ উৎসের (ব্যাটারি) প্রতীক।

একটি পরিবাহী পদার্থে যে চলমান আহিত কণাগুলি বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি করে তাদের আধান বাহক বলে। যেসব ধাতু দ্বারা বেশিরভাগ বৈদ্যুতিক বর্তনীর তার এবং অন্যান্য পরিবাহী তৈরি হয়, তাতে পরমাণুগুলোর ধনাত্মকভাবে আহিত পারমাণবিক নিউক্লিয়াস একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকে এবং ঋণাত্মকভাবে আহিত ইলেক্ট্রনগুলি আধান বাহক হিসেবে কাজ করে এবং ধাতুতে মুক্তভাবে চলাফেরা করে। অন্যান্য উপকরণগুলিতে, বিশেষত অর্ধপরিবাহীতে, ব্যবহৃত ডোপান্টের উপর নির্ভর করে আধান পরিবাহকসমূহ ধনাত্মক বা ঋণাত্মক হতে পারে। এমনকি ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক একই সাথে আধান বাহক হিসেবে থাকতে পারে, যেমনটি একটি তড়িৎ রাসায়নিক কোষের তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থে ঘটে থাকে।

ধনাত্মক চার্জের একটি প্রবাহ, বিপরীতমুখী ঋণাত্মক চার্জের একটি প্রবাহের সমান বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেয় এবং বর্তনীতে একই প্রভাব রাখে। যেহেতু তড়িৎ প্রবাহ ধনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জের প্রবাহ অথবা উভয়ই হতে পারে, তাই তড়িৎ প্রবাহের আধানবাহকের ধরন নিরপেক্ষ একটি নিয়ম থাকা প্রয়োজন। যে দিকে ধনাত্মক আধানের প্রবাহ চলে সে দিককে প্রচলিত তড়িৎপ্রবাহের দিক হিসেবে ধরা হয়। তাই ঋণাত্মক চার্জের বাহক, যেমন ইলেকট্রন—যা ধাতব তার এবং অন্যান্য অনেক বৈদ্যুতিক বর্তনীর উপাদানগুলিতে চার্জ বাহক হিসেবে কাজ করে, বৈদ্যুতিক বর্তনীর প্রচলিত প্রবাহের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়।

প্রবাহের দিক উল্লেখ

একটি তারে বা বর্তনীর উপাদানে তড়িৎপ্রবাহ দুই দিকেই প্রবাহিত হতে পারে। তড়িৎ প্রবাহ নির্দেশ করার জন্য যখন I-কে একটি চলক হিসেবে ধরা হয় তখন ধনাত্মক প্রবাহের দিকটিও বর্তনীর ডায়াগ্রামে তীর চিহ্নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে দিতে হয়।[ক]:১৩ এটিকে বলা হয় তড়িৎপ্রবাহের দিক উল্লেখ। তড়িৎ বর্তনী বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তড়িৎ প্রবাহের দিক নির্দিষ্ট করা যায় না। ফলস্বরূপ তড়িৎ প্রবাহের প্রবাহের দিক প্রায়শই ইচ্ছামাফিক নির্ধারন করা হয়। যখন বর্তনীটির সমাধান করা হয়, তখন বর্তনীর প্রবাহের মান ঋণাত্মক আসার অর্থ হচ্ছে, যেদিকে তড়িৎ প্রবাহের দিক উল্লেখ করা হয়েছে তার বিপরীত দিকটি হল তড়িৎ প্রবাহিত হওয়ার প্রকৃত দিক।[খ]:২৯

ও‍’মের সূত্র

ও‍’মের সূত্রে বলা হয়েছে যে, উষ্ণতা ও অন্যান্য ভৌত অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্যের সরাসরি সমানুপাতিক। এটির সমানুপাতিকতার ধ্রুবক―রোধ নিলে,[১১] একটি গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে এই সম্পর্কটি বর্ণনা করা যায়:[১২]

যেখানে,
I হলো পরিবাহীটিতে অ্যাম্পিয়ার এককে তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ,
V হলো পরিবাহী জুড়ে ভোল্ট এককে পরিমাপকৃত বিভব পার্থক্য বা ভোল্টেজ এবং
R হলো ওহম এককে প্রকাশিত পরিবাহীর উপাদানের রোধের পরিমাণ।

আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, ও‍’মের সূত্রে বলা হয়েছে এই সম্পর্কটিতে R হলো একটি ধ্রুবক, যা তড়িৎ প্রবাহের উপর নির্ভর করে না।[১৩]

পরিবর্তী ও একমুখী তড়িৎ প্রবাহ

পরিবর্তী তড়িৎ প্রবাহ (সংক্ষেপে AC; Alternating Current) ব্যবস্থায় বৈদ্যুতিক আধানের প্রবাহের দিক সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তী তড়িৎ প্রবাহ তড়িৎ শক্তির এমন একটি রূপ যা সাধারণত ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা হয়। একটি এসি পাওয়ার সার্কিটের স্বাভাবিক তরঙ্গরূপটি হনো একটি সাইন তরঙ্গ, যদিও নির্দিষ্ট কিছু সরঞ্জামে বিকল্প তরঙ্গরূপ ব্যবহার করা হয়, যেমন: ত্রিভুজাকার বা চতুর্ভুজাকার তরঙ্গ। অডিও ও বেতার সিগনাল ধারণকারী বৈদ্যুতিক তারের প্রবাহও এসি প্রবাহের উদাহরণ। এসি প্রবাহের ক্ষেত্রে তড়িৎ প্রবাহের দিক প্রতি সেকেন্ডে নির্দিষ্ট সংখ্যকবার পরিবর্তিত হয়। প্রতি সেকেন্ডে যত বার তড়িৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তিত হয় তাকে তড়িৎ প্রবাহের কম্পাঙ্ক বলে। বাংলাদেশে তড়িৎ প্রবাহের কম্পাঙ্ক ৫০ সাইকেল। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার প্রবাহের দিক বদলায়।[১৪] এই সরঞ্জামগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো এসি সিগনালে এনকোডেড (অথবা মডুলেটেড) তথ্য পুনরুদ্ধার করা।

বিপরীত দিকে, ডিসি (Direct Current) প্রবাহ বলতে এমন একটি ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে বৈদ্যুতিক আধান শুধুমাত্র একদিকে প্রবাহিত হয় (কখনো কখনো একমুখী প্রবাহ বলা হয়ে থাকে)। একমুখী প্রবাহ ব্যাটারি, থার্মোকাপল, সৌর কোষ এবং ডায়নামো জাতের কম্যুটেটর ভিত্তিক বৈদ্যুতিক মেশিনের মতো উৎস দ্বারা উৎপাদিত হয়। রেকটিফায়ার ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবর্তী প্রবাহকে একমুখী তড়িৎ প্রবাহে রূপান্তর করা যায়। একমুখী তড়িৎ প্রবাহ একটি পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে, যেমন- একটি তারের মধ্যে দিয়ে; তবে সেমিকন্ডাক্টর, অন্তরক এমনকি ইলেকট্রন বা আয়ন রশ্মির শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। একমুখী তড়িৎপ্রবাহকে আগে গ্যালভ্যানিক কারেন্ট বলা হতো।[১৫]

উদাহরণ

বৈদ্যুতিক প্রবাহের পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রাকৃতিক উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে বজ্রপাত, স্থির বৈদ্যুতিক নির্গমন এবং সৌর বায়ু, মেরুজ্যোতির উৎসসমূহ।

বৈদ্যুতিক প্রবাহের মনুষ্যসৃষ্ট উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে মাথার উপর দিয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহকারী পাওয়ার লাইনগুলির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দূরত্ব জুড়ে ও বৈদ্যুতিক এবং বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের মধ্য দিয়ে পরিবাহী ইলেকট্রনের প্রবাহ। ঘূর্ণি প্রবাহ হলো তড়িৎ প্রবাহ যা পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্রের সংস্পর্শে আসা পরিবাহীতে ঘটে। একইভাবে, তড়িৎচৌম্বকক্ষেত্রের সংস্পর্শে আসা পরিবাহীর পৃষ্ঠে তড়িৎ প্রবাহ ঘটে। রেডিও অ্যান্টেনাতে সঠিক ভোল্টেজে তড়িৎ প্রবাহমাত্রা ওঠা-নামা করানো হলে বেতার তরঙ্গ উৎপন্ন হয়।

ইলেক্ট্রনিক্সে তড়িৎ প্রবাহের অন্য রূপগুলির মধ্যে রয়েছে – রোধকের মধ্য দিয়ে বা ভ্যাকুয়ামের শূন্যতার মধ্য দিয়ে ইলেকট্রনের প্রবাহ, ব্যাটারি বা নিউরনের অভ্যন্তরে আয়নের প্রবাহ এবং ধাতু ও অর্ধপরিবাহীর মধ্যে হোলের প্রবাহ।

তড়িৎ প্রবাহের একটি জৈবিক উদাহরণ হলো স্নায়ুকোষ এবং স্নায়ুতে আয়ন প্রবাহ, যেটি চিন্তা ও সংবেদনশীল উপলব্ধির জন্য দায়ী।

প্রবাহের পরিমাপ

অ্যামিটার ব্যবহার করে তড়িৎপ্রবাহের পরিমাপ করা যায়।

তড়িৎপ্রবাহ গ্যালভানোমিটারের মাধ্যমে সরাসরি পরিমাপ করা যায় কিন্তু তাতে গ্যালভানোমিটারটি বর্তনীটি ভেঙে তার সাথে যুক্ত করতে হয়; যা কখনো কখনো অসুবিধারও কারণ হয়ে থাকে।

তড়িৎ বর্তনী না ভেঙেও প্রবাহের সাথে যুক্ত চৌম্বকক্ষেত্রটি শনাক্ত করে তড়িৎপ্রবাহ পরিমাপ করা যায়। বর্তনী পর্যায়ের বিভিন্ন ডিভাইস তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ নির্ণয়ে নানান কৌশল ব্যবহার করে থাকে:

রোধীয় উত্তাপন

জুলের তাপীয় ক্রিয়া (রোধীয় বা ওহমীয় উত্তাপন নামেও পরিচিত) হলো শক্তির অপচয়ের একটি প্রক্রিয়া[১৮]:৩৬― যেখানে তাপগতীয় কাজকে তাপে রূপান্তর করার মাধ্যমে।[১৯]:৮৪৬, fn. ৫ কোনো পরিবাহীতে তড়িৎ প্রবাহের চলাচল সেটির অভ্যন্তরীণ শক্তিকে বৃদ্ধি করে।[১৯]:৮৪৬ ১৮৪১ সালে বিষয়টি নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা করেন জেমস প্রেসকট জুল। বিজ্ঞানী জুল একটি দীর্ঘ তারকে নির্দিষ্ট ভরের পানিতে ৩০ মিনিট যাবত ডুবিয়ে রেখে তারটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুতের কারণে তাপমাত্রার বৃদ্ধি পরিমাপ করেন। তারের দৈর্ঘ্য ও তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ বাড়ানো কমানোর মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি অনুমান করেন যে, কোনো তড়িৎ পরিবাহী দ্বারা উৎপাদিত উত্তাপনের ক্ষমতা সেটির রোধ এবং তড়িৎ প্রবাহের বর্গের গুণফলের সমানুপাতিক:

এই সম্পর্কটি জুলের প্রথম সূত্র বলেও পরিচিত।[১৮]:৩৬

শক্তির এসআই একককে পরবর্তীতে জুল নামকরণ করা হয় এবং প্রতীক হয় J[৪]:২০ ক্ষমতার সাধারণভাবে পরিচিত এসআই একক হলো ওয়াট (প্রতীক: W), যা প্রতি সেকেন্ডে এক জুলের সমান।[৪]:২০

তড়িৎচুম্বকত্ব

বৈদ্যুতিক চুম্বক

সলিনয়েডের ভিতরে বিদ্যুৎপ্রবাহের কারণে চুম্বকক্ষেত্র উৎপন্ন হয়েছে।

তারের একটি প্যাঁচানো কুণ্ডলীতে তড়িৎপ্রবাহ চালনা করলে সেটি একটি চুম্বকের মতো আচরণ করে। এটিকে তড়িৎ চুম্বক বলে। যখন তার কুণ্ডলীটিতে তড়িৎপ্রবাহ বন্ধ করা হয় তখন সাথে সাথেই সেটি তার চুম্বকত্ব হারায়। এক্ষেত্রে তড়িৎপ্রবাহ চুম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। যতক্ষণ তড়িৎপ্রবাহ চলমান থাকে ততক্ষণ তারের চারদিকে চৌম্বক ক্ষেত্রটিকে বৃত্তাকার ক্ষেত্রের অনেকগুলো রেখার মতো করে দেখানো যায় ।

তড়িচ্চুম্বকীয় আবেশ

সলিনয়েডের ভিতর দিয়ে পরিবর্তী তড়িৎপ্রবাহ চালিত হওয়ায় পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে। এই চৌম্বকক্ষেত্রটি পাশের তারের কুণ্ডলীতে তড়িচ্চুম্বকীয় আবেশ সৃষ্টি করে।

চুম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করেও তড়িৎ প্রবাহ তৈরি করা যায়। যখন কোনো পরিবর্তনশীল চুম্বক ক্ষেত্র কোনো পরিবাহীতে প্রয়োগ করা হয়,তখন সেটি একটি তড়িচ্চালক শক্তি উৎপন্ন করে;[১৯]:১০০৪ যা একটি উপযুক্ত প্রবাহ পথ পেলে তড়িৎ প্রবাহের চলাচল শুরু করে।

বেতার তরঙ্গ

যখন রেডিও কম্পাঙ্কতে উপযুক্ত আকারের পরিবাহীতে (অ্যান্টেনা) তড়িৎ প্রবাহ প্রবাহিত হয়, তখন বেতার তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। এই তরঙ্গ আলোর গতিতে চলে এবং দূরবর্তী পরিবাহীতে বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি করতে পারে।

বিভিন্ন মাধ্যমে তড়িৎ প্রবাহ প্রক্রিয়া

কঠিন ধাতব পদার্থে,নিম্ন বিভব থেকে উচ্চ বিভবের দিকে ইলেকট্রনের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক আধান সঞ্চারিত হয়।অন্যান্য মাধ্যমে চার্জিত বস্তুর (যেমন:আয়ন) প্রবাহ তড়িৎপ্রবাহের তৈরি করে।তড়িৎপ্রবাহের আধান বাহকের ধরন নিরপেক্ষ সংজ্ঞা দিতে ধনাত্মক আধানের প্রবাহের দিককে তড়িৎপ্রবাহের প্রচলিত দিক নির্ধারণ করা হয়েছে।সুতরাং,যেসব ধাতুতে আধান বাহক (ইলেকট্রন) ঋণাত্মক হয়, তাতে ইলেকট্রন চলাচলের দিকের বিপরীত দিকটি হয় তড়িৎপ্রবাহের প্রচলিত দিক। যেসব পরিবাহীতে আধান বাহক ধনাত্মক হয়, তাতে আধান চলাচলের দিকটি হয় তড়িৎপ্রবাহের প্রচলিত দিক।

ভ্যাকুয়ামে তড়িৎ প্রবাহিত হওয়ার জন্য আয়ন বা ইলেক্ট্রনের একটি বিম তৈরি হতে পারে।অন্যান্য পরিবাহী বস্তুতে একইসাথে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক উভয়ভাবে চার্জিত কণার প্রবাহের ফলে তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি হয়।বাদ বাকি অন্যগুলোতে, বিদ্যুতের প্রবাহ― সম্পূর্ণরূপে, ধনাত্মক আধানের প্রবাহ।উদাহরণস্বরূপ, তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থে বিদ্যুতের প্রবাহ হল ধনাত্মক ও ঋণাত্মক উভয়ভাবে চার্জিত আয়নের প্রবাহ।একটি সাধারণ তড়িৎরাসায়নিক লেড-এসিড ব্যাটারিতে, একদিকে ধনাত্মক হাইড্রোনিয়াম আয়ন এবংও অন্য দিকে ঋণাত্মক সালফেট আয়নের প্রবাহের সমন্বয়ে তড়িৎপ্রবাহ গঠিত হয়।বৈদ্যুতিক স্পার্ক ও প্লাজমাতে বিদ্যুতের প্রবাহ হল একই সাথে ইলেকট্রনের প্রবাহ এবং ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জিত আয়নের প্রবাহ।বরফ এবং কিছু কঠিন তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থে, বিদ্যুতের প্রবাহ― সম্পূর্ণরূপে, প্রবহমান আয়নের প্রবাহ দ্বারা গঠিত হয়।

ধাতু

একটি ধাতুতে থাকা প্রত্যেক পরমাণুর বাহিরের ইলেকট্রনগুলো― আণবিক কঠিন পদার্থে কারণে বা অন্তরক পদার্থের মতো সম্পূর্ণ ব্যান্ডে না থাকার কারণে, কোন নির্দিষ্ট অণুর সাথে আবদ্ধ নয়, কিন্তু ধাতব কেলাসের মধ্যে তারা মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে। এই আবেশী ইলেকট্রনগুলো বিদ্যুৎ পরিবহনের মাধ্যমে আধান বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে।সাধারণত কেলাসে পরমাণু প্রতি একটি মুক্ত ইলেকট্রন থাকে; এইরকম মুক্ত ইলেকট্রন থাকার কারণে ধাতুগুলো বিশেষভাবে পরিবাহী হয়ে থাকে।বাহ্যিক কোন তড়িৎক্ষেত্র প্রয়োগ ছাড়াই এই ইলেকট্রনগুলো তাপীয় শক্তির কারণে গড় গতিতে হলেও এলোমেলোভাবে চলাচল করতে থাকে; ধাতুর নিট আধান থাকে শুন্য।কক্ষ তাপমাত্রায়, এই এলোমেলো চলাচলের গড় গতি ১০ মি./সে.।[২০] ধাতব তারগুলো যে তল দিয়ে যায় ইলেকট্রনগুলো সেই তলে উভয়দিকে সমান হারে চলাচল করে। যেমনটি জর্জ গ্যামফ বলেছেন তার জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক বই "ওয়ান, টু, থ্রি....ইনফিনিটি (১৯৪৭)"- এ, "ধাতব পদার্থ অন্যান্য পদার্থ থেকে আলাদা হওয়ার কারণ, ধাতব পদার্থের বাহিরের কক্ষপথগুলো আলগাভাবে হলেও আবদ্ধ থাকে, এবং প্রায়শই তাদের একটি ইলেকট্রনকে মুক্তভাবে চলাচল করতে দেয়। এভাবে একটি ধাতুর বহির্ভাগ বিশাল অংকের মুক্ত ইলেকট্রন দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে যেগুলো স্থানচ্যুত মানুষের ভিড়ের মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে চারদিকে চলাচল করে। যখন কোন ধাতব তারের দুই বিপরীত প্রান্তকে কোন বৈদ্যুতিক শক্তির সাথে যুক্ত করা হয় তখন এই মুক্ত ইলেকট্রনগুলো সেই শক্তির উৎসের দিকে তীব্র গতিতে ছুটে যায়; এভাবে যা সৃষ্টি হয় তাকে আমরা তড়িৎপ্রবাহ বলে থাকি।"

যখন একটি ধাতব তারকে ডিসি উৎসের (যেমন:ব্যাটারি) দুই প্রান্তে সংযুক্ত করা হয়,তখন সেই উৎসটি পরিবাহীটি জুড়ে একটি তড়িৎক্ষেত্রের সৃষ্টি করে। যে মুহূর্তে এই সংযোগটি তৈরি হয়, তখন এই তড়িৎক্ষেত্রের প্রভাবে পরিবাহীর মুক্ত ইলেকট্রনগুলো ধনাত্মক প্রান্তের দিকে ছুটতে থাকে।তাই কোন সাধারণ পরিবাহীতে আধানের বাহক হল মুক্ত ইলেকট্রন।কোন পৃষ্ঠের মধ্য দিয়ে অবিচ্ছিন্নভাবে তড়িৎপ্রবাহ চলমান থাকলে, তড়িৎপ্রবাহ, I কে (অ্যাম্পিয়ার এককে) নিচের সমীকরণটি দিয়ে গণনা করা যায়:

যেখানে নির্দিষ্ট সময়, t এ পৃষ্ঠটির মধ্য দিয়ে পরিবাহিত বৈদ্যুতিক আধানের পরিমাণ হল, Q। যদি Q এবং t কে যথাক্রমে কুলম্ব এবং সেকেন্ড এককে হিসাব করা হয়, তবে অ্যাম্পিয়ার এককে তড়িৎপ্রবাহের মান পাওয়া যাবে।
আরও সহজভাবে, কোন পৃষ্ঠের মধ্য দিয়ে আধানের প্রবাহের হারের মাধ্যমেও তড়িৎপ্রবাহকে উপস্থাপন করা যায়:

তড়িৎবিশ্লেষ্য

তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থে তড়িৎপ্রবাহ হল আহিত কণার(আয়ন) প্রবাহ।উদাহরণস্বরূপ, যদি Na+ এবং Cl এর দ্রবণে একটি তড়িৎক্ষেত্র স্থাপন করা হয় (এবং শর্তগুলো ঠিক থাকে) তাহলে সোডিয়াম আয়নগুলো ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার (ক্যাথোড) অভিমুখে অগ্রসর হয় এবং ক্লোরিন আয়নগুলো ধনাত্মক তড়িৎদ্বার (অ্যানোড) অভিমুখে অগ্রসর হয়।উভয় তড়িৎদ্বারে বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যেকটি আয়ন প্রশমিত হয় ।

বরফ (পানির কঠিন অবস্থা) এবং নির্দিষ্ট কিছু কঠিন তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থকে প্রোটনীয় পরিবাহী বলে, যাতে সঞ্চারনশীল ধনাত্মক হাইড্রোজেন আয়ন (প্রোটন) থাকে। এই সকল পদার্থে তড়িৎপ্রবাহ, সঞ্চারনশীল প্রোটনের প্রবাহের মাধ্যমে গঠিত হয় কারণ এগুলো ধাতুর মতো সঞ্চারনশীল ইলেকট্রনের মাধ্যমে তড়িৎ পরিবহন করে না।

কিছু নির্দিষ্ট তড়িৎবিশ্লেষ্য মিশ্রণে, উজ্জলভাবে রঞ্জিত আয়নগুলো হল প্রবহমান বৈদ্যুতিক আধান।রঙটির ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়ার কারণে বিদ্যুতের প্রবাহটি দৃশ্যমান হয়।[২১]

গ্যাস ও প্লাজমা

অবিচ্ছিন্ন ক্ষেত্রের নিচে বাতাস এবং অন্যান্য সাধারণ গ্যাসে, বৈদ্যুতিক পরিবহনের প্রভাবশালী প্রবাহটি তুলনামুলকভাবে তেজস্ক্রিয় গ্যাস, অতিবেগুনি আলো অথবা মহাজাগতিক রশ্মি দ্বারা উৎপন্ন সঞ্চারণশীল কিছু আয়নের প্রবাহ। যেহেতু গ্যাসের বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা কম তাই এটি হল অন্তরক।যাইহোক, একবার প্রযুক্ত তড়িৎক্ষেত্রটি অন্তরকের বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করে যায় এমন মানে পৌঁছালে,নিষ্ক্রিয় গ্যাসের অণু বা পরমাণু কে সংঘর্ষ এবং আয়নীকরণের মাধ্যমে আরও মুক্ত ইলেকট্রন তৈরি করতে,অন্য মুক্ত ইলেকট্রনগুলো তড়িৎক্ষেত্রটির মাধ্যমে যথেষ্ট সচল হয়;যাকে ধ্বস প্রভাব বলে। এই বিচ্ছিন্নতা অতিক্রমণের প্রক্রিয়াটি একটি প্লাজমা গঠন করে যাতে বৈদ্যুতিক পরিবাহী হয়ে উঠতে যথেষ্ট সঞ্চারনশীল ইলেকট্রন ও ধনাত্মক আয়ন থাকে। এই প্রক্রিয়ায়, এটি একটি আলো নিঃসরক পরিবাহী পথ (যেমন: স্পার্ক,আর্ক বা বিজলী) সৃষ্টি হয়,।

প্লাজমা হল পদার্থের এমন একটি অবস্থা যেখানে কোন গ্যাসের ইলেকট্রনগুলোর মধ্যে কিছু সংখ্যক ইলেকট্রন তাদের অণু বা পরমাণু থেকে বিচ্যুত বা "আয়নিত" থাকে। যেমনটি উপরে বলা হয়েছে, উচ্চ তাপমাত্রা অথবা উচ্চ তড়িৎক্ষেত্র বা পরিবর্তী চুম্বকক্ষেত্রের প্রয়োগের ফলে প্লাজমা তৈরি হতে পারে। ভর কম হওয়ায় প্লাজমাতে থাকা ইলেকট্রনগুলো কোন তড়িৎক্ষেত্রে সাড়া দিয়ে তলনামুলকভাবে ভারি আয়নগুলোর থেকে দ্রুত ছুটে যায় এবং এভাবে তড়িৎপ্রবাহের বেশিরভাগ অংশ পরিবহন করে।মুক্ত আয়নগুলো নতুন রাসায়নিক যৌগ গঠন করতে একত্রিত হয় (উদাহরণস্বরূপ,বায়ুমণ্ডলীয় অক্সিজেনকে ভেঙে একক অক্সিজেন পরমাণু তৈরি করে [O2 → 2O] ,যেগুলো পুনর্মিলিত হয়ে ওজোন গ্যাস [O3] তৈরি করে)[২২]

শুন্য

যেহেতু "নিখুঁত শুন্যস্থানে" কোন আহিত কণা থাকে না, তাই এটি সাধারনত নিখুঁত অন্তরকের মতো আচরণ করে।যাইহোক, ধাতব তড়িৎদ্বার পরিবাহী হয়ে ওঠার জন্য ফিল্ড ইলেকট্রন নির্গমন বা তাপীয় নির্গমনের মাধ্যমে মুক্ত ইলেকট্রন বা আয়ন প্রবেশ করানোর ফলে একটি শুন্যস্থান সৃষ্টি হতে পারে। তাপীয় শক্তি ধাতুর কার্য অপেক্ষককে ছাড়িয়ে গেলে গ্যাসে তাপীয় নির্গমন ঘটে আর ফিল্ড ইলেকট্রন নির্গমন ঘটে যখন ধাতুর পৃষ্ঠের তড়িৎক্ষেত্র টানেলিং এর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে বেশি থাকে; যার ফলে মুক্ত ইলেকট্রন ধাতু থেকে বেরিয়ে শূন্যস্থানটিতে যায়। প্রায়ই বাহ্যিকভাবে উত্তপ্ত করা তড়িৎদ্বারকে ফিলামেন্টে বা পরোক্ষভাবে উত্তপ্ত ভ্যাকুয়াম টিউবের ক্যাথোডে ইলেকট্রন মেঘ উৎপন্ন করার জন্য ব্যবহার করা হয়। শীতল তড়িৎদ্বারও তাপীয় নির্গমনের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইলেকট্রন মেঘ উৎপন্ন করতে পারে যখন ছোট ছোট উজ্জ্বল অঞ্চল (যাকে ক্যাথোড স্পট বা অ্যানোড স্পট বলা হয় ) গঠিত হয়। এইগুলো হল তড়িৎদ্বারের পৃষ্ঠের উজ্জ্বল অঞ্চল যেগুলো স্থানীয় উচ্চ তড়িৎপ্রবাহ দ্বারা তৈরি হয়। এই অঞ্চলগুলো ফিল্ড ইলেকট্রন নির্গমন এর মাধ্যমে অভিষিক্ত হতে পারে, কিন্তু ভ্যাকুয়াম আর্ক একবার গঠিত হয়ে যাওয়ার পর তা তাপীয় নির্গমনের মাধ্যমে টিকে থাকে।উচ্চ বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের সাথে সংযুক্ত ধাতব পৃষ্ঠের উপর এই ছোট ছোট ইলেকট্রন-নির্গমন অঞ্চলগুলো খুবই দ্রুত গঠিত হতে পারে; এমনকি বিস্ফোরকভাবে। ভ্যাকুয়াম টিউব এবং স্প্রিটন হল ভ্যাকুয়াম পরিবহনের ভিত্তিতে তৈরি বৈদ্যুতিক স্যুইচিং এবং পরিবর্ধক যন্ত্র।

অতিপরিবাহিতা

অতিপরিবাহিতা হল এমন একটি বিষয় যা, নির্দিষ্ট কিছু পদার্থকে স্বাভাবিক চরম তাপমাত্রার নিচে ঠাণ্ডা করার ফলে তাতে তড়িৎ পরিবহনের রোধ একেবারে শুন্য হয়ে যাওয়া এবং তড়িৎচুম্বকীয় তাড়ন সৃষ্টি হওয়ার অবস্থাকে বোঝায়। ১৯১১ সালের ৮ এপ্রিল লেইডেনে বিজ্ঞানী কামারলিং ওনেস সর্বপ্রথম এটি আবিষ্কার করেন। অয়শ্চৌম্বকত্ব এবং পারমাণবিক বর্ণালী রেখার মতো অতিপরিবাহিতাও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি বিষয়। এটি মাইসনার প্রভাব―পদার্থটি অতিপরিবাহী অবস্থায় রূপান্তরিত হলে,চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের রেখাগুলি অতিপরিবাহীর অভ্যন্তর দিয়ে না গিয়ে সম্পূর্ণ বাইরে দিয়ে যায়―দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।এক্ষেত্রে মাইসনার প্রভাবের এই ঘটনাটি এই ইঙ্গিত দেয় যে, অতিপরিবাহিতার বিষয়টি ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের নিখুঁত পরিবাহিতার আদর্শায়নের ঘটনার মতো সহজভাবে বোঝা যায় না।

অর্ধপরিবাহী

একটি অর্ধপরিবাহীতে (ইংরেজি: Semiconductor) তড়িৎপ্রবাহকে কখনও কখনও ধনাত্মক "হোলের" (সঞ্চারনশীল ধনাত্মক আধান বাহক; যা মূলত অর্ধপরিবাহী স্ফটিকে যোজনী ইলেকট্রনের অনুপস্থিত স্থান) প্রবাহ ফলাফল ভাবা যেতে পারে। p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে এটি ঘটে থাকে। একটি সেমিকন্ডাক্টরের তড়িৎ পরিবাহিতা একটি পরিবাহী ও একটি অন্তরক পদার্থের মাঝামাঝি। এর অর্থ হল এই পরিবাহিতার ব্যাপ্তি মোটামুটিভাবে ১০−২ থেকে ১০ সিমেন্স প্রতি সেন্টিমিটারের (S⋅cm−1) মধ্যে।

সর্বোত্তম স্ফটিকাকার অর্ধপরিবাহীতে, ইলেকট্রন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ব্যান্ডের মধ্যে শক্তি ধারণ করতে পারে। শক্তিগতভাবে, এই ব্যান্ডের অবস্থান পদার্থের পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মধ্যে শক্তভাবে যুক্ত ইলেকট্রন এবং মুক্ত ইলেকট্রনের শক্তির মাঝামাঝি, যা পদার্থটি থেকে একটি ইলেকট্রন চলে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিকে ব্যক্ত করে।প্রত্যেকটি শক্তি ব্যান্ড ইলেকট্রনের অনেকগুলো পৃথক কোয়ান্টাম অঞ্চলের সাথে মিলে যায় এবং বেশিরভাগ অঞ্চল কম শক্তি সম্পন্ন স্তরগুলো (নিউক্লিয়াসের কাছাকাছি অবস্থিত) দখল করে নেয়। অর্ধপরিবাহী ও অন্তরক সমূহকে ধাতু থেকে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা, কারণ কোনো ধাতুর যোজ্যতা ব্যান্ড, স্বাভাবিক কার্যকর অবস্থায় ইলেকট্রন দ্বারা প্রায় পরিপূর্ণ থাকে; যেখানে খুব কম সংখ্যক (অর্ধপরিবাহী) অথবা কার্যত নেই (অন্তরক) এরকম পদার্থ আছে যাদের পরিবহন ব্যান্ড, সরাসরি যোজ্যতা ব্যান্ডের উপরে থাকে।

কতটা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে অর্ধপরিবাহীতে ইলেকট্রনগুলোকে উত্তেজিত করে অর্ধপরিবাহীর যোজ্যতা ব্যান্ড থেকে পরিবহন ব্যান্ডে নেয়া যাবে তা মূলত ব্যান্ডের মধ্যে ব্যান্ড পার্থক্যের (ব্যান্ড গ্যাপ) উপর নির্ভর করে। অর্ধপরিবাহী ও অন্তরক পদার্থের মধ্যে এই শক্তি ব্যান্ড পার্থক্যের পরিমাণ (মোটামুটিভাবে ৪ eV এর মতো) একটি বিভাজক রেখা হিসেবে কাজ করে।

সমযোজী বন্ধনে, ইলেকট্রন লাফিয়ে লাফিয়ে পাশের বন্ধনে যাওয়ার মাধ্যমে চলাচল করে।পলির বর্জন নীতি অনুসারে, ইলেকট্রনটি ঐ বন্ধনের উচ্চ বন্ধন-বিরোধী অঞ্চলে পৌঁছাবে।মুক্ত অবস্থায়, উদাহরণস্বরূপ, এক মাত্রিক পদার্থে―একটি ন্যানো তারে, প্রত্যেক শক্তির জন্য ইলেকট্রনগুলোর একদিকে চলাচলের জন্য একটি জায়গা ও অন্যদিকে চলাচলের জন্য আরেকটি জায়গা থাকে। নিট তড়িৎপ্রবাহের জন্য, একদিকের চেয়ে অন্য দিকের প্রবাহে বেশি জায়গা দখল করতে হয়। যেহেতু অর্ধপরিবাহীতে পরবর্তী উচ্চতর অবস্থা ব্যান্ড গ্যাপের উপরে থাকে তাই এটি ঘটার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। এটাকে অনেক সময় এভাবেও বলা হয়: সবগুলো ব্যান্ড বৈদ্যুতিক পরিবহনে অংশ নেয় না। যাইহোক, অর্ধপরিবাহীর তাপমাত্রা পরম শুন্যের উপরে উঠে গেলে ,অর্ধপরিবাহীটি কেলাস কম্পন ও পরিবহন ব্যান্ডের মধ্যে ইলেকট্রন উত্তেজিত করতে ব্যয় করার জন্য আরও শক্তি অর্জন করে।পরিবহন ব্যান্ডের মধ্যে থাকা তড়িৎ পরিবহনকারী ইলেকট্রনগুলো মুক্ত ইলেকট্রন বলে পরিচিত, যদিও লেখায় বিষয়টি স্পষ্ট থাকলে তাদেরকে প্রায়শই সহজভাবে ইলেকট্রন বলা হয়।

প্রবাহ ঘনত্ব ও ও‍’মের সূত্র

একক ক্ষেত্রফলের মধ্য দিয়ে আধান প্রবাহিত হওয়ার হার কে বলা হয় প্রবাহ ঘনত্ব।[২৩]:৩১ এটিকে এমন একটি ভেক্টর হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যার মাত্রা হল কোন প্রস্থচ্ছেদের প্রতি একক ক্ষেত্রফলে প্রবাহিত তড়িৎপ্রবাহ।[২]:৭৪৯ যেমনটি প্রবাহের দিক উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বলা হয়েছিলো, প্রবাহের দিকটি ইচ্ছামতো ধরা যেতে পারে।প্রচলিতভাবে, যদি চলমান চার্জগুলি ধনাত্মক হয় তবে প্রবাহ ঘনত্বের মানের চিহ্ন ও চার্জের বেগের মানের চিহ্ন একই থাকে। ঋণাত্মক চার্জের জন্য, প্রবাহ ঘনত্বের মানের চিহ্নটি চার্জের বেগের মানের চিহ্নের বিপরীত হয়।[২]:৭৪৯ এসআই একক পদ্ধতিতে, প্রবাহ ঘনত্ব (প্রতীক: j) -কে এস. আই. পদ্ধতির মৌলিক একক― অ্যাম্পিয়ার ও মিটারের মাধ্যমে অ্যাম্পিয়ার-প্রতি বর্গমিটারে প্রকাশ করা হয়।[৪]:২২

একমাত্রিক উপকরণগুলিতে(যেমন:ধাতু) এবং কম ফ্রিকোয়েন্সির অধীনে,পরিবাহীর পৃষ্ঠতল জুড়ে প্রবাহ ঘনত্ব সমান থাকে। এরকম শর্ত থাকলে,ও‍’মের সূত্রে বলা হয়েছে যে,তড়িৎপ্রবাহ ধাতব (আদর্শ) রোধটির (বা অন্য কোন ওহমীয় যন্ত্রের) দুই প্রান্তের (পৃষ্ঠতল জুড়ে) বিভব পার্থক্যের সরাসরি সমানুপাতিক:

যেখানে, হল অ্যাম্পিয়ার এককে পরিমাপকৃত তড়িৎপ্রবাহ; হল ভোল্ট এককে পরিমাপকৃত বিভব পার্থক্য এবং হল ওহম এককে পরিমাপকৃত রোধ। পরিবর্তী প্রবাহের জন্য, বিশেষত উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির ক্ষেত্রে,স্কিন ইফেক্ট এর কারণে পরিবাহীর প্রস্থচ্ছেদ জুড়ে প্রবাহের পরিমাণ সমান হয় না;পরিবাহীর পৃষ্ঠতলের কাছে প্রবাহ ঘনত্ব বেশি হয়, ফলে আপাত রোধ বৃদ্ধি পায়।

প্রবাহের গতি

পরিবাহীতে থাকা সঞ্চারণশীল চার্জিত কণাগুলো গ্যাসের কণার মতো ক্রমাগত এদিক-সেদিক এলোমেলোভাবে চলাচল করে।(আরও ভালভাবে বললে, ফার্মি গ্যাসের মতো)।আধানের একটি নিট প্রবাহ তৈরি করতে, সব কণাগুলোকে একটি গড় প্রবাহ গতিতে চলতে হয়।বেশিরভাগ ধাতুতে ইলেকট্রন আধান পরিবহন করে এবং সেগুলো এক পরমাণু থেকে লাফিয়ে অন্য পরমাণুতে অনিশ্চিত পথে চলে, কিন্তু সাধারণত তড়িৎক্ষেত্রের দিকের বিপরীত দিকে চলে।ইলেকট্রনগুলোর চলার গতি এই সমীকরণের সাহায্যে হিসাব করা যায়:

যেখানে,

হল তড়িৎ প্রবাহ
হল প্রতি একক আয়তনে চার্জিত কণার সংখ্যা (বা আধান বাহক ঘনত্ব)
হল পরিবাহীর প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল
হল প্রবাহের গতি, এবং
হল প্রতিটি কণার চার্জের পরিমাণ।

সাধারণত, কঠিন মাধ্যমে বৈদ্যুতিক আধানগুলো ধীরে প্রবাহিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি তামার তারের প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল ০.৫ মি.মি এবং এর মধ্যে দিয়ে ৫ অ্যাম্পিয়ার তড়িৎ প্রবাহিত হলে, ইলেকট্রনগুলোর তাড়ন গতি হবে ১ মিলিমিটার/সেকেন্ড।আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায়, ক্যাথোড রে-টিউব এর ভিতরের প্রায়-শুন্য পরিবেশে, ইলেকট্রনগুলো প্রায়-সরলরেখায় আলোর গতির দশ ভাগের এক ভাগ গতিতে চলাচল করে।

কোনো ত্বরক বৈদ্যুতিক আধান,যার কারণে কোন পরিবর্তনশীল তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি হয়,তা পরিবাহীর বাইরের পৃষ্ঠে অনেক উচ্চ গতির একটি তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের জন্ম দেয়।ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো থেকে অনুমান করা যায় যে, সাধারণত এই বেগটি আলোর বেগের উল্লেখযোগ্য একটি ভগ্নাংশ এবং তা ইলেকট্রনের তাড়ন বেগের চেয়ে অনেক গুণ বেশি।উদাহরণস্বরূপ, এসি পাওয়ার লাইনগুলোতে, তারগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থানের মাধ্যমে তড়িৎচৌম্বক শক্তির তরঙ্গগুলো উৎস থেকে দূরবর্তী সরবরাহের স্থান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, যদিও তারগুলোর ভিতরের ইলেকট্রনগুলো স্বল্প দূরত্বে এদিক সেদিক চলাচল করে।

তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের গতি ও শুন্য মাধ্যমে আলোর গতির অনুপাতকে বলা হয় বেগ ফ্যাক্টর এবং এটি পরিবাহীর তড়িৎচুম্বকীয় বৈশিষ্ট্য, চারপাশের অন্তরক,আকৃতি ও আকারের উপর নির্ভর করে।

এই তিন ধরনের বেগের তাৎপর্য (প্রকৃতি নয়), গ্যাসের সাথে সম্পর্কিত এরকম তিনটি বেগের সাথে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে চিত্রায়ন করা যেতে পারে।

  • আধান বাহকগুলোর নিম্ন তাড়ন গতি বায়ুর গতির (বা বায়ুপ্রবাহের) সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
  • তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের উচ্চ গতি বাতাসে শব্দের গতির সাথে মোটামুটি সাদৃশ্যপূর্ণ (বাতাসের মধ্য দিয়ে শব্দতরঙ্গ, বৃহদায়তনের সঞ্চালনের(যেমন:পরিচলন) চেয়ে অনেক দ্রুত পরিবাহিত হয়)।
  • আধানগুলোর এলোমেলোভাবে চলাচল করা তাপ তথা গ্যাসের অণুগুলোর তাপীয় গতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

আরও দেখুন

টীকা

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী