চাচাপোয়া

দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী

চাচাপোয়ারা হল আন্দিজ পার্বত্যাঞ্চলের একটি প্রাচীন জাতি। আন্দিজ পর্বতের পূর্ব ঢালে, অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরের বিপরীত দিকে, বর্তমান পেরুর আমাজন নদী সংলগ্ন আমাজোনাস অঞ্চলে তাদের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ইনকাদের সাথে তাদের দীর্ঘদিন ধরে শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। বহু চেষ্টার পর অবশেষে স্পেনীয় আক্রমণের মাত্র বছর ষাটেক আগে ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ইনকারা তাদের নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হয়। চাচাপোয়া নামটিও তাদেরই দেওয়া, কেচুয়া ভাষায় যার মানে 'মেঘ-যোদ্ধা'। এই অঞ্চলে অতিবৃষ্টি অরণ্য (রেন ফরেস্ট) ও সবসময় আর্দ্র পরিবেশের জন্যই বোধহয় ইনকারা তাদের এমন নামে ডাকত।

পেরুর মানচিত্রে চাচাপোয়া সংস্কৃতির অবস্থান। ৭৫০ - ৮০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই অঞ্চলে চাচাপোয়া সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে ও ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে ইনকাদের হাতে তাদের পতন ঘটলেও স্পেনীয়দের আগমনকালেও এদের অস্তিত্ব বজায় ছিল।

তবে চাচাপোয়াদের সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য হাতে পাওয়া যায় না। কারণ তাদের সম্বন্ধে স্পেনীয় ও ইনকাদের রেখে যাওয়া প্রত্যক্ষ বিবরণ নিতান্তই স্বল্প। এইকারণেই তাদের উপর তথ্যর প্রয়োজনে আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির উপরই বেশি নির্ভর করতে হয়। যাইহোক, তাদের সম্বন্ধে যেটুকু বিবরণ পাওয়া যায়, তার অন্যতম হল স্পেনীয় বিজেতা ও ঐতিহাসিক পেদ্রো সিয়েজা দে লেওনের লেখা বর্ণনা। তিনি চাচাপোয়াদের সমগ্র আমেরিন্ডীয়দের মধ্যে সবচেয়ে ফরসা ও সুন্দর বলে উল্লেখ করেছেন।[১]এর থেকে বোঝা যায় অন্য আন্দীয় জাতিগুলির থেকে এরা ছিল কিছুটা আলাদা। তবে পেরুর ইনস্তিতুতো দে আরকেওলখিয়া আমাজোনিকার প্রত্নতাত্ত্বিকরা চাচাপোয়াদের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী পরীক্ষা করে অভিমত প্রকাশ করেন যে তারা সংস্কৃতিগত দিক থেকে আমাজনীয় জাতিগুলির থেকে আন্দীয় জাতিগুলিরই বেশি কাছাকাছি ছিল।

ইতিহাস

কুয়েলাপ দুর্গর ভগ্নাবশেষ ও চারপাশের দৃশ্য

যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদি থেকে বুঝতে পারা যায়, ২০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সময় থেকেই আন্দিজ পর্বতের পূর্বঢালের এই আমাজন অরণ্যাঞ্চলে মানুষের বসতি ছিল, চাচাপোয়াদের সংস্কৃতির বিকাশের সূচনাসময় হিসেবে সাধারণত ৭৫০ - ৮০০ খ্রিষ্টাব্দকেই ধরা হয়। এদের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল একটি বিশাল দুর্গ - কুয়েলাপ ও গ্রান পাহাতেন, পাহাড়ের চূড়ার উপর তৈরি আরেকটি দেওয়াল ঘেরা প্রাচীন বসতির ধ্বংসস্তূপ। দুটি জায়গাতেই সামরিক প্রয়োজনে নির্মাণের দিকটি পরিষ্কার ফুটে ওঠে।[২] মনে হয় উয়ারিদের (চাচাপোয়াদের সমসাময়িক এই সংস্কৃতি আন্দিজের ঠিক উলটো ঢালে এইসময় বিকাশ লাভ করেছিল ও পর্বতের উচ্চভূমি থেকে একেবারে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।) হাত থেকে প্রতিরক্ষার খাতিরেই তারা এগুলি, গড়ে তুলেছিল। এর থেকে তাদের 'যোদ্ধা' পরিচয়টিরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়াও কুয়েলাপ'এর অদূরেই তাদের একটি কবরস্থান কারাহিয়াও আবিষ্কৃত হয়েছে।[৩] তবে পঞ্চদশ শতকে ইনকারা আন্দিজ পর্বত পেরিয়ে তার পূর্বঢালের দিকে অগ্রসর হলে, চাচাপোয়াদের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে। প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তারা ইনকাদের হাতে পরাজিত হয়। তাদের একরকম জোর করেই দলে দলে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। তাদের পরপর বিভিন্ন বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়। এই কারণেই হয়তো স্পেনীয়রা যখন এই অঞ্চলে প্রবেশ করে, ইনকাদের বিরুদ্ধে বহুক্ষেত্রে চাচাপোয়ারা স্পেনীয়দেরই পক্ষাবলম্বন করে। যাইহোক, ১৫৪৭'এর পর চাচাপোয়াদের স্বাধীন অস্তিত্ব স্পেনীয় ঔপনিবেশিক সৈন্যদের হাতেই খর্বিত হয় ও পরবর্তী সময়ে প্রবল অত্যাচার, দারিদ্র ও মহামারীতে তাদের জনসংখ্যা প্রবলভাবে হ্রাস পায়।[৪]

১৪৭৫ সালে যখন চাচাপোয়ারা ইনকাদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় তখন তাদের জনসংখ্যা ছিল মোটামুটি ৫ লক্ষ বলে আন্দাজ করা হয়। কিন্তু এদের মধ্যে একটা বড় অংশকে (গবেষক এস্পিনোথা[৫] ও পেটার লেরখের[৬] মতে জনসংখ্যার প্রায় ৫০%কেই) সেই সময় অন্যত্র, বিশেষত তিতিকাকা হ্রদকুসকোতে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। ইনকাদের আমলে করদাতাদের সংখ্যার যে হিসেব পাওয়া গেছে, তার উপরে নির্ভর করে আন্দাজ করা হয়, স্পেনীয় বিজেতাদের আগমণের কালে এদের সংখ্যা নেমে আসে মাত্র ১ লক্ষে।[৭]

বিতর্ক

যদিও সাধারণভাবে ৭৫০ - ৮০০ খ্রিষ্টাব্দকে চাচাপোয়া সংস্কৃতির বিকাশের সূচনাপর্ব হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু এর সঠিক সময় নিয়ে যথেষ্টই বিতর্কের অবকাশ রয়ে গেছে। ঠিক একইভাবে বর্তমানে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তাদের দৈত্যাকার দুর্গ কুয়েলাপএর নির্মাণের সময়কাল নিয়েও। এই দু'টিই কিছুদিন আগে পর্যন্তও ধরা হত ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময় বলে। কিন্তু ১৯৮৬ সালে পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ আলফ্রেদো নার্বায়েথ এই দুর্গের নির্মাণকার্যের সঠিক সময় বের করার উদ্দেশ্যে যে রেডিওকার্বন পরীক্ষা চালান, তাতে উঠে আসে এই দুর্গটির অন্তত কিছু অংশ ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমদিকে, অর্থাৎ ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে নির্মিত হয়েছিল। সেই হিসেবে ষষ্ঠ শতাব্দকে দুর্গটির নির্মাণকার্যের সূচনাপর্ব বলে ধরা যেতেই পারে। এর মানে দাঁড়ায় চাচাপোয়া সংস্কৃতির বিকাশের সূচনাপর্বকেও অন্ততপক্ষে সেই সময়ে বা তার কিছুটা আগে বলেই ধরতে হবে।[৮][৯] ১৯৮০ থেকে এই অঞ্চলে পড়ে থেকে গবেষণা চালিয়ে আসা জার্মান বংশোদ্ভূত বর্তমানে পেরুর নাগরিক গবেষক পেটার লেরখেরও মতে এ'ধরনের একটি নির্মাণকার্য করার একটি পূর্বশর্তই হল - একেবারে নতুন কোনও সংস্কৃতি, যাদের এ'ধরনের নির্মাণকার্যের কোনওরকম পূর্ব অভিজ্ঞতাই নেই, তাদের পক্ষে এইরকম দুর্গনির্মাণ সম্ভবই নয়। তার গবেষণার তাই ইঙ্গিত এই সংস্কৃতির সূচনাপর্ব বাস্তবে নিশ্চয়ই আরও প্রাচীন, হয়তো বা আজ থেকে ২০০০ বছর আগেই এর বিকাশ আরম্ভ হয়।[১০]

তথ্যসূত্র

আরও দেখুন

🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী