গুয়ানিডিন
গুয়ানিডিন একটি জৈব যৌগ যার রাসায়নিক সংকেত HNC(NH 2)2। এটি একটি বর্ণহীন কঠিন পদার্থ এবং মেরু দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়। গুয়ানিডিন একটি শক্তিশালী জৈব ক্ষার যা প্লাস্টিক এবং বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মানব শরীরে মূলত রেচনজনিত ব্যর্থতার ফলে এটি রোগীদের মূত্রে পাওয়া যায়।[৩] গুয়ানিডিন অণুর অংশ হিসাবে একে বৃহত্তর জৈব অণুতেও দেখা যায়। যার মধ্যে রয়েছে আরজিনিন জৈব যৌগের পার্শ্ব শৃঙ্খলের অংশ।
| |||
| |||
নামসমূহ | |||
---|---|---|---|
পছন্দসই ইউপ্যাক নাম গুয়ানিডিন[১] | |||
অন্যান্য নাম ইমিনোমিথেনডাইঅ্যামিন | |||
শনাক্তকারী | |||
ত্রিমাত্রিক মডেল (জেমল) | |||
বেইলস্টেইন রেফারেন্স | ৫০৬০৪৪ | ||
সিএইচইবিআই | |||
সিএইচইএমবিএল | |||
কেমস্পাইডার | |||
ড্রাগব্যাংক | |||
ইসিএইচএ ইনফোকার্ড | ১০০.০০৩.৬৫৬ | ||
ইসি-নম্বর |
| ||
মেলিন রেফারেন্স | ১০০৬৭৯ | ||
আইইউপিএইচএআর/বিপিএস | |||
এমইএসএইচ | গুয়ানিডিন | ||
পাবকেম CID | |||
ইউএনআইআই | |||
কম্পটক্স ড্যাশবোর্ড (EPA) | |||
| |||
এসএমআইএলইএস
| |||
বৈশিষ্ট্য | |||
CH5N3 | |||
আণবিক ভর | ৫৯.০৭ g·mol−১ | ||
গলনাঙ্ক | ৫০ °সে (১২২ °ফা; ৩২৩ K) | ||
লগ পি | −১.২৫১ | ||
অনুবন্ধী অম্ল | গুয়ানিডিনিয়াম | ||
তাপ রসায়নবিদ্যা | |||
গঠনে প্রমান এনথ্যাল্পির পরিবর্তন ΔfH | −৫৭ – −৫৫ কিলোজুল মোল−১ | ||
দহনে প্রমান এনথ্যাল্পির পরিবর্তন ΔcH | −১.০৫১১ – −১.০৫৩১ মোলজুল মোল−১ | ||
ঔষধসংক্রান্ত | |||
ঔষধসঞ্চরণবিজ্ঞান : | |||
জৈবিক অর্ধায়ু | ৭–৮ ঘন্টা | ||
ঝুঁকি প্রবণতা | |||
প্রাণঘাতী ডোজ বা একাগ্রতা (LD, LC): | |||
LD৫০ (মধ্যমা ডোজ) | ৪৭৫ মিলিগ্রাম/কেজি (মুখ দিয়ে গ্রহণ করলে, ইঁদুরের ক্ষেত্রে)[২] | ||
সম্পর্কিত যৌগ | |||
সম্পর্কিত যৌগ |
| ||
সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা ছাড়া, পদার্থসমূহের সকল তথ্য-উপাত্তসমূহ তাদের প্রমাণ অবস্থা (২৫ °সে (৭৭ °ফা), ১০০ kPa) অনুসারে দেওয়া হয়েছে। | |||
![]() ![]() ![]() | |||
তথ্যছক তথ্যসূত্র | |||
গঠন
গুয়ানিডিনকে কার্বনিক অ্যাসিডের নাইট্রোজেনযুক্ত জৈব যৌগ হিসাবে ভাবা যেতে পারে। অর্থাৎ কার্বনিক অ্যাসিডের C=O মূলককে একটি C=NH মূলক দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হলে এবং প্রতিটি OH মূলককে একটি NH2 মূলক দ্বারা প্রতিস্থাপিত করলে গুয়ানিডিনের গঠন পাওয়া যায়।[৪] আইসোবিউটিনকে অনেকটা একইভাবে কার্বন সমগোত্রীয় হিসেবে দেখা যায়। গুয়ানিডিনের অণুর সরলতা থাকা সত্ত্বেও এর প্রথম সংশ্লেষণের প্রায় ১৪৮ বছর পর এই যৌগটির একটি বিশদ ক্রিস্টালোগ্রাফিক অর্থাৎ স্ফটিক বিশ্লেষণের ব্যাখ্যা প্রকাশ করা হয়।[৫] ক্রিস্টালোগ্রাফি হলো কঠিন স্ফটিক পদার্থে পরমাণুর বিন্যাস নির্ধারণের পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান। ২০১৩ সালে একক-ক্রিস্টাল নিউট্রন ডিফ্র্যাকশন পদ্ধতি ব্যবহার করে গুয়ানিডিন যৌগের হাইড্রোজেন পরমাণুর অবস্থান এবং তাদের স্থানচ্যুতির পরামিতিগুলি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়।[৬]
প্রস্তুতি
গুয়ানিডিন প্রাকৃতিক উৎস থেকেও পাওয়া যায়। ১৮৬১ সালে জার্মান রসায়নবিদ অ্যাডলফ স্ট্রেকার পেরুর সমুদ্র উপকূল থেকে পাওয়া সামুদ্রিক পাখির বিষ্ঠা গুয়ানো থেকে অ্যারোমেটিক যৌগ গুয়ানিনকে প্রথমে আলাদা করেন। পরে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে গুয়ানিন থেকে গুয়ানিডিন তৈরি করেন।[৭][৮]
পরীক্ষাগারে অ্যামোনিয়াম থায়োসায়ানেট লবণ থেকে গুয়ানিডিন প্রস্তুত করা হয়। শুষ্ক অ্যামোনিয়াম থায়োসায়ানেটকে অনার্দ্র অবস্থায় ১৮০ ডিগ্রি থেকে ১৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ধীরে ধীরে উত্তপ্ত করলে এটি ভেঙ্গে গিয়ে গুয়ানিডিন তৈরি করে। সেই সঙ্গে হাইড্রোজেন সালফাইড ও কার্বন ডাই সালফাইড গ্যাসও উৎপন্ন হয়। বিক্রিয়াটি এই রকম :
- 3 NH4SCN -> 2 CH5N3 + H2S + CS2
অ্যামোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতিতে ৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড এবং অ্যালুমিনিয়াম সালফেট লবণকে একসাথে গরম করেলে গুয়ানিডিন তৈরি হয়।[৯]
অ্যামোনিয়াম আয়োডাইডের সাথে ক্যালসিয়াম সায়ানামাইড উত্তপ্ত করেও গুয়ানিডিন প্রস্তুত করা যায়।[১০]
বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়াম লবণের সাথে ডাইসায়ানডাইঅ্যামাইডের বিক্রিয়া করে গুয়ানিডিন তৈরি করা হয়। বিক্রিয়াটি দুই ধাপে ঘটে। প্রথম ধাপে মধ্যবর্তী অস্থায়ী যৌগ বাইগুয়ানিডিন তৈরি হওয়ার পর গুয়ানিডিনিয়াম আয়নের লবণ তৈরি হয়। দ্বিতীয় ধাপে গুয়ানিডিনিয়াম আয়নের লবণকে ক্ষারের সঙ্গে বিক্রিয়া করানো হলে গুয়ানিডিন তৈরি হয়। ক্ষার হিসাবে সাধারনত সোডিয়াম মেথোক্সাইড ব্যবহার করা হয়ে থাকে।[১১]
রসায়ন
গুয়ানিডিনিয়াম আয়ন
একটি হাইড্রোজেন আয়ন (বা প্রোটন) লাভ করার পর একটি ক্ষার যে রূপ নেয় তা হল কনজুগেট অ্যাসিড বা অনুবন্ধী অম্ল। গুয়ানিডিন একটি জৈব ক্ষার, তবে এটি যখন একটি হাইড্রোজেন আয়ন (বা প্রোটন) লাভ করে তখন একটি অনুবন্ধী অম্ল তৈরি হয়। গুয়ানিডিনের অনুবন্ধী অম্ল বা কনজুগেট অ্যাসিডকে গুয়ানিডিনিয়াম ক্যাটায়ন (C(NH
2)+
3) বলা হয়। গুয়ানিডিনিয়াম ক্যাটায়নের এই গঠনটি দ্বিমাত্রিক এবং সুষম। এতে কেন্দ্রীয় কার্বন পরমাণুর সাথে তিনটি অ্যামিনো গ্রুপ সমযোজী বন্ধনের সাথে সংযুক্ত থাকে। জলীয় দ্রবণে গুয়ানিডিনিয়াম আয়নের অনুরণন স্থিতিশীলতার জন্য এটি অত্যন্ত স্থিতিশীল +১ ক্যাটায়ন। ফলস্বরূপ, এর অ্যাসিড বিয়োজন ধ্রুবক pKaH হলো ১৩.৬[১২] (pKb এর মান ০.৪) যার অর্থ হলো গুয়ানিডিন জলীয় দ্রবণে খুব শক্তিশালী ক্ষার। প্রশমিত জলীয় দ্রবণে এটি প্রায় সবসময় গুয়ানিডিনিয়াম আয়ন হিসাবে বিদ্যমান থাকে। এই কারণে, বেশিরভাগ গুয়ানিডিন উদ্ভূত যৌগগুলি কনজুগেট অ্যাসিডযুক্ত লবণ হয়।
- বল ও স্টিক মডেল
- অনুরণন হাইব্রিড
- স্বাভাবিক বা আদর্শ রূপ
গুয়ানিডিনের পরীক্ষা
সোডিয়াম ১,২-ন্যাপথোকুইনোন-৪-সালফোনিক অ্যাসিড (ফোলিন বিকারক) এবং অম্লযুক্ত ইউরিয়া ব্যবহার করে গুয়ানিডিনকে আলাদাভাবে সনাক্ত করা যেতে পারে।[১৩]
ব্যবহার
রাসায়নিক শিল্পে
রাসায়নিক শিল্পে গুয়ানিডিনের সবচেয়ে বেশি যে লবণ ব্যবহার হয় তা হলো গুয়ানিডিন নাইট্রেট [C(NH
2) 3] NO
3। এটি একটি প্রোপেল্যান্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন, গাড়ীর দুর্ঘটনায় মুখোমুখি ধক্কার সময় চলক ও যাত্রীর সুরক্ষায় যে এয়ার ব্যাগ থাকে তাতে গুয়ানিডিন ব্যবহার করা হয়।
ওষুধ শিল্পে
ইউরোপে মধ্যযুগ থেকে ফরাসি লিলাক উদ্ভিদের সক্রিয় উপাদানে থাকা গুয়ানিডিন ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় অ্যান্টিহাইপারগ্লাইসেমিক উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের ফলে এর থেকে যকৃতের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিন আবিষ্কারের পরে গুয়ানিডিনেরর সরাসরি প্রয়োগের গবেষণা স্থগিত রাখা হয়। এছাড়া অ-বিষাক্ত ও নিরাপদ বাইগুয়ানাইড যৌগের বিকাশের ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ হিসাবে মেটফরমিনের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ১৯৫০ সালে ইউরোপে এবং ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেটফরমিনের ব্যবহার চালু হয়েছিল। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ১৭০ লক্ষেরও বেশি রোগীর রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য মেটফরমিন ওষুধটি ব্যবহার হয়।[১৪] [১৫]
গুয়ানিডিনিয়াম ক্লোরাইড[১৪] আগে বটুলিজমের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো। একটি এখন-বিতর্কিত ওষুধ। বটুলিজম হলো ক্লোস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনাম নামক ব্যাকটেরিয়াম থেকে উৎপাদিত একধরনের অধিবিষের ফলে সৃষ্ট একটি রোগ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে গুয়ানিডিনিয়াম ক্লোরাইড ওষুধ ব্যবহারে রোগীদের উল্লেখযোগ্য কোন উন্নতি দেখা যয়নি।[১৬]
প্রাণরসায়নে
গুয়ানিডিন একটি হাইড্রোজেন আয়ন (বা প্রোটন) লাভ করে গুয়ানিডিনের অনুবন্ধী অম্ল বা কনজুগেট অ্যাসিড তৈরি করে। শারীরবৃত্তীয় pH-এ মানব শরীরের তরলে গুয়ানিডিনিয়াম আয়ন হিসাবে পাওয়া যায়।
গুয়ানিডিনিয়াম ক্লোরাইড (গুয়ানিডিন হাইড্রোক্লোরাইড নামেও পরিচিত) যৌগটির ক্যাওট্রপিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে অর্থাৎ এটি প্রোটিনগুলিকে বিকৃত করতে পারে। তাই প্রোটিন বিকৃত করতে গুয়ানিডিনিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহৃত হয়। গুয়ানিডিনিয়াম ক্লোরাইড ঘনত্বের মাত্রার সঙ্গে প্রোটিন বিকৃতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। গুয়ানিডিনিয়াম ক্লোরাইডের ৬ মোলীয় ঘনমাত্রার জলীয় দ্রবণে প্রায় সমস্ত প্রোটিন তাদের সম্পূর্ণ গৌণ গঠনগুলি হারায় এবং এলোমেলো গঠনের কুণ্ডলীকৃত পেপটাইড শৃঙ্খলে পরিণত হয়। গুয়ানিডিনিয়াম থায়োসায়ানেটও বিভিন্ন জৈবিক নমুনাগুলিতে প্রোটিন বিকৃত কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, গুয়ানিডিনিয়াম একটি বিষাক্ত উপজাত হিসাবে ব্যাকটেরিয়া থেকে উৎপন্ন হয়। গুয়ানিডিনিয়ামের বিষাক্ততা দূর করার জন্য ব্যাকটেরিয়াগুলি তাদের দেহে এক ধরনের গুয়ানিডিনিয়াম রপ্তানিকারক প্রোটিন (জিডিএক্স প্রোটিন) তৈরি করতে পারে। এই রপ্তানিকারক প্রোটিনগুলি এক শ্রেণীর পরিবহণকারী প্রোটিন। এগুলি অতিরিক্ত পরিমাণে তৈরি হওয়া গুয়ানিডিনিয়াম আয়নকে কোষের বাইরে বের করে দেয়।[১৭] জিডিএক্স প্রোটিনগুলি গুয়ানিডিনিয়াম এবং মনো-প্রতিস্থাপিত গুয়ানিডিনাইল যৌগগুলির জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট প্রোটিন।[১৮]
অন্যান্য
কিছু ক্ষেত্রে চুলের প্রসাধনের জন্য ব্যবহৃত ক্রিম বা লোশনে গুয়ানিডিনিয়াম হাইড্রক্সাইড সক্রিয় উপাদান হিসাবে থাকে।
গুয়ানিডিন থেকে তৈরি যৌগসমূহ
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/3/33/Guanidine-group-2D-skeletal.png/220px-Guanidine-group-2D-skeletal.png)
গুয়ানিডাইনস হলো জৈব যৌগের একটি শ্রেণী যার কার্যকরী মূলকের সাধারণ কাঠামো হলো (R
1R
2N)(R
3R
4N)C=N−R
5। এই শ্রেণীর যৌগের কেন্দ্রীয় বন্ধন হলো একটি ইমাইন। এই শ্রেণীটি গঠনগতভাবে অ্যামিডাইন এবং ইউরিয়ার সাথে সম্পর্কিত। গুয়ানিডাইন যৌগের উদাহরণ হলো আর্জিনাইন, ট্রাইঅ্যজাবাইসাইক্লোডিসিন, স্যাক্সিটক্সিন এবং ক্রিয়েটাইন।
গ্যালেজিন একটি আইসোঅ্যামাইলিন গুয়ানিডিন।[১৯]