উদ্ভিদকুল
উদ্ভিদকুল বলতে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সময়ে প্রাকৃতিকভাবে জীবিত উদ্ভিদ এবং তাদের জীবনকে বোঝায়। এর সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দটি হল প্রাণীজীবনের ক্ষেত্রে, প্রাণিকুল। উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগৎ বা জীবনের অন্যান্য রূপগুলি, যেমনঃ ছত্রাককে সম্মিলিতভাবে জীবন (উদ্ভিদ বা প্রাণী কোনটিই নয়) হিসাবে উল্লেখ করা হয়। কখনো বা ব্যাকটিরিয়া এবং ছত্রাককে উদ্ভিদ হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। যেমন অন্ত্রে উদ্ভিদ বা ত্বকের উদ্ভিদ। [১][২][৩]
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/9/90/Flora.png)
ব্যাকরণ
"উদ্ভিদকুল" শব্দটি রোমান পৌরাণিক কাহিনীতে উদ্ভিদের ফুল এবং উর্বরতার দেবী ফ্লোরার লাতিন নাম থেকে এসেছে। [৪] প্রযুক্তিগত শব্দ "উদ্ভিদকুল" এরপরে ষোড়শ শতাব্দীর শেষে এই দেবীর লক্ষণা থেকে উদ্ভূত হয়। এটি প্রথম ব্যবহার হয় কবিতায় কোন এক অঞ্চলের প্রাকৃতিক উদ্ভিদ বোঝাতে। তবে শীঘ্রই এই জাতীয় উদ্ভিদকে তালিকাভুক্ত কোন কাজের অর্থ ধরে নেওয়া হয়েছিল। তদুপরি, "উদ্ভিদকুল" সপ্তদশ শতাব্দীতে একটি কৃত্রিম উদ্যানের ফুলগুলিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হত। [৫]
উদ্ভিদকুল এবং উদ্ভিদের মধ্যে একটি পার্থক্য প্রথম জুলুস থুরম্যান (১৮৪৯) তৈরি করেছিলেন। এর আগে দুটি শব্দটি নির্বিচারে বা কোন বাচ-বিচার না করেই ব্যবহার করা হত। [৬][৭]
শ্রেণিবিভাগ
ফুলকীয় অঞ্চলে বিশেষ পরিবেশ বা জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদগুলিকে উদ্ভিদকুলে বিভক্ত করা হতো। অঞ্চলগুলি পর্বত অথবা ফ্ল্যাটল্যান্ডের মতো স্বতন্ত্র আবাস হতে পারে। উদ্ভিদকুল বলতে জীবাশ্মের উদ্ভিদের মতো ঐতিহাসিক যুগের উদ্ভিদজীবনকে বোঝাতে পারে। অবশেষে উদ্ভিদগুলি বিশেষ পরিবেশ অনুযায়ী বিভক্ত হতে পারে:
- দেশীয় উদ্ভিদ একটি অঞ্চলের দেশীয় এবং দেশীয় উদ্ভিদ।
- কৃষি ও উদ্যানতালিক উদ্ভিদ (উদ্যান উদ্ভিদ) বলতে বোঝায় যে উদ্ভিদগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ জন্মায়।
- আগাছা উদ্ভিদ : ঐতিহ্যগতভাবে এই শ্রেণিবিন্যাসটি অবাঞ্ছিত হিসাবে বিবেচিত গাছগুলিতে প্রয়োগ করা হয়েছিল এবং সেগুলি নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করার প্রচেষ্টাতে অধ্যয়ন করা হয়েছিল। আজ উপাধি কম বেশি প্রায়ই উদ্ভিদ জীবনের একটি শ্রেণিবিন্যাস হিসাবে ব্যবহার করা হয় যেহেতু এটি গাছপালা বা উদ্ভিদকুল। তিনটি ভিন্ন ধরনের আগাছা উদ্ভিদ রয়েছে: আগাছাপূর্ণ প্রজাতি, আক্রমণকারী প্রজাতি (যে বা রোগা হতে পারে), এবং দেশীয় এবং চালু অ- আগাছাপূর্ণ প্রজাতির কৃষিতে অবাঞ্ছিত হয় । পূর্বে আগাছা হিসাবে বিবেচিত অনেকগুলি দেশীয় উদ্ভিদ বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের জন্য উপকারী বা এমনকি প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে।
উদ্ভিদকুলের নথি
নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সময়ে উদ্ভিদ " উদ্ভিদকুল " হিসাবে পরিচিত এমন একটি প্রকাশনায় নথিভুক্ত করা যেতে পারে। উদ্ভিদকুলকে কার্যকারিতা করার জন্য বিশেষজ্ঞদের থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞান জ্ঞানের প্রয়োজন হতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে এগুলি বই, তবে কিছু এখন সিডি-রম বা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
সাইমন পল্লির ১৬৪৮ সালের ফ্লোরা ড্যানিকা সম্ভবত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের উদ্ভিদ জগতের কথা উল্লেখ করার জন্য "উদ্ভিদকুল" শিরোনামের প্রথম বই। এটি মূলত ডেনমার্কে ক্রমবর্ধমান ঔষধি গাছের বর্ণনা দেয়। পোলিশ জেসুইট মাইচা বয়েমের লেখা ফ্লোরা সিনেনসিস হল "উদ্ভিদকুল" নামে একটি বইয়ের প্রথম দিককার উদাহরণ। [৮] তবে, এর শিরোনাম উদ্ভিদকুল হলেও এটি কেবল উদ্ভিদই নয়, এই ভারত এবং চীন অঞ্চলের কিছু প্রাণীকেও আচ্ছাদন করে। [৫]
গবেষণা
জন ডালটন হুকার (১৮১৭-১৯১১) নামে এক ব্যক্তি এবং তার সহকারী টমাস টমসেন (১৮১৭-১৮৭৮) পূর্ব ভারত, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং সুন্দরবনে ব্যাপকভাবে উদ্ভিদ সন্ধান চালান। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত "হিমালিয়া জরনাল" হুকার ধারাবাহিকভাবে ভ্রমণকথা ও সেখানকার উদ্ভিদজগতের বিভিন্ন বর্ণনা লিখেন। ১৮৫০ সালের মে মাসে প্রথম দিনে কলকাতা থেকে এক দীর্ঘ নৌযাত্রায় তিনি পাবনা, ঢাকা ও মেঘনা নদী পেরিয়ে ছাতক ও সিলেট পৌঁছেন। তিনি যখন ১৮৫১ সালে কলকাতা ফিরবেন তখন তিনি ফেরার পথে কিছুটা হাঁটা-হাটি করে আবার কিছুটা নৌকায় করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, হাতিয়া অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন। হুকার ছিলেন ভারতী উপমহাদেশের উদ্ভিদ নিয়ে ভূগল চর্চার একজন অগ্রদূত।
চার্লস ব্যারন ক্লার্ক পরবর্তীতে ১৮৬৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের অধ্যাপক হন। পূর্ববঙ্গের স্কুল পরিদর্শক হিসাবে কর্মরত থাকাকালে তিনি আড়াই বছর নৌকায় ভ্রমণ করেন। এসময় তিনি প্রায় ৭০০০ উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করেন।
কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্যর জন্য আঠারো শতকের শেষের দিকে বার্মা থেকে আনা সেগুন জাহাজ তৈরি করা হয়েছিল। এই জাহাজ দিয়ে মাল পরিবহন করা হত। ১৮৮৭ সালে পরীক্ষামূলক সেগুনচাষ শুরু হয় রবার্ট কিডের সুপারিশে কলকাতার সন্নিকটে হুগলি নদীর তীরে কলকাতা উদ্যানের একাংশে। বার্মা থেকে আনা হয়েছিল বীজগুলো। এই বীজ দিয়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা এবং কান্তাইয়ে সেগুন গাছ রোপণ শুরু করা হয়। যার কারণে বনাঞ্চলে প্রথম বিদেশি প্রজাতির সূচনা ঘটে।[৯]
অর্থকরী
এখন সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫০০০ প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী উদ্ভিদ প্রজাতি আছে। বাংলাদেশে আছে পর্যাপ্ত অর্থকরী উদ্ভিদ। এখানে সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে ৩২০টি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ । এখানে ১৫০ প্রজাতির ফসল মুখ্য। বাকিগুলি বিপণন হয়ে থাকে নির্দিষ্ট এলাকা বা স্থানীয় লোকদের মধ্যে যা সীমিত। বাংলাদেশে অর্থকরী উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে ধান, গম । ধানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী উদ্ভিদ পাট, চা এবং আখ।
অবদান
১৮ শতকের শেষার্ধে কলকাতায় ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের বাসভবন প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ এবং পূর্ব-ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্ভিদ সমীক্ষা শুরু হয়েছিল । তখনকার উইলিয়াম রক্সবার্গ ছিলেন অগ্রণী উদ্ভিদ পর্যবেক্ষক। তৎকালীন তার অবদানের জন্য তাকে ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১৮ শতকের শেষ নাগাদ উইলিয়ম কেরী কলকাতা আসেন। কেরি ১৮৩২ সালে রক্সবার্গের ৩ খন্ডের একটি বই সম্পাদনা করেন বইটির নাম ছিল ফ্লোরা ইন্ডিকা। কেরিই ভারতে অ্যাগ্রো-হর্টিকালচারাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা।
১৮৮৩ সালে এবার্ডিন ও এডিনবরা থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি লাভের পর মেঘনার পূর্বতীরের লক্ষ্মীপুরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারখানায় কর্মরত হন ডেভিড প্রেইন (১৮৫৭-১৯৪৪)। তিনি কলকাতা বোটানিক গার্ডেন ও বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন।[৯]
জীববৈচিত্র্য
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/8/87/Floristic_regions_in_Europe_%28english%29.png/220px-Floristic_regions_in_Europe_%28english%29.png)
প্রায় ৬০০০ প্রজাতির গাছপালা বা উদ্ভিদকুল বাংলাদেশে রয়েছে। এর মধ্যে আবার প্রায় ৩০০ প্রজাতি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্থানীয় প্রজাতি আটটি যা একান্তভাবেই বাংলাদেশের । বাংলাদেশে ৫০০০টি প্রজাতি প্রায় আবৃতবীজ বা সপুষ্পক উদ্ভিদ এবং চারটি প্রজাতি আছে যেগুলো অনাবৃতবীজ উদ্ভিদ। বাংলাদেশে বিপন্ন ৯৫টি প্রজাতি বিবেচিত হয়। এর মধ্যে ৯২টি আবৃতবীজ এবং তিনটি অনাবৃতবীজ উদ্ভিদ। বাংলাদেশে ৩০০ প্রজাতির শৈবালের নাম কেবলমাত্র স্বাদুপানির পরিবেশ থেকেই নাম লিপিবদ্ধ করা। এদের অনেক প্রজাতি সামুদ্রিক, এবং লবণ পানিতে রয়েছে। ছত্রাক সম্বন্ধে তথ্য বাংলাদেশে সম্পূর্ণ হয়নি। বাংলাদেশে ব্রায়োফাইট রয়েছে প্রায় ২৫০ প্রজাতির এবং প্রায় ২৫০টি টেরিডোফাইট বাংলাদেশে প্রাপ্ত যার মধ্যে এই প্রজাতির ২৩০টি ফার্নজাতীয়।[৯] বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনের উপকূলীয় অরণ্য বাংলাদেশের সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৫০০০টি। বাংলাদেশের উপকূল অনেক ক্ষেত্রে সুন্দরবন নামে পরিচিত। সামুদ্রিক উদ্ভিদবৈচিত্র্য বঙ্গোপসাগরে আছে শৈবাল, মোহনা ও সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ এবং পৃথিবীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ফসলে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। ধান, চা, গম, আলু, ডাঁটাশাক, লিচু, কচু, গাছআলু, বেত, বাঁশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।[৯]
উদ্ভিদবিজ্ঞান সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষা ও গবেষণার ইতিহাস বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট প্রাচীন। আনুমানিক ২০০ সংখ্যক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক। বাংলাদেশে প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে প্রায় ২৫০ জন শিক্ষার্থী উদ্ভিদবিজ্ঞানের ডিগ্রি লাভ করে আসছে।[৯]
ভেষজ
উত্তরবঙ্গের ১০টি গ্রাম থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে যে এখানকার রোগীদের ৩০ শতাংশ সনাতন চিকিৎসা গ্রহণ করে। এ ধরনের পদ্ধতিতে নানারকম উদ্ভিদসামগ্রী ব্যবহার করা হয়। উত্তরবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় ১৫০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৫৭ জন এখানে কবিরাজ। হাড় চিকিৎসকরা সনাতন লোকপ্রজ্ঞার সাহায্যে ভাঙা হাড় জোড়া লাগায়।[৯]