খিচুড়ি

চাল-ডালের সমন্বয়ে তৈরি করা খাদ্য

খিচুড়ি একটি ভাত জাতীয় খাবার যা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। প্রধানত চাল এবং মসুর ডাল দিয়ে সাধারণ খিচুড়ি ভাত রান্না করা হলে বজরা, মুগডাল সহ অন্যান্য ডালের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। অঞ্চলভেদে খিচুড়ির বিভিন্ন আঞ্চলিকরূপ পরিলক্ষিত হয়। যেমন নরম খিচুড়ি, ভুনা খিচুড়ি, মাংস খিচুড়ি, নিরামিষ খিচুড়ি ইত্যাদি। খিচুড়ি একটি সহজপাচ্য খাবার তাই শিশুকে প্রথম কঠিন খাবার হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় খিচুড়ি খাওয়ানো হয়।[১] হিন্দুদের মধ্যে যারা উপবাসকালে কোনপ্রকার শস্যাদি গ্রহণ করতে চান না তারা এসময়ে সাবুদানা খিচুড়ি খেয়ে থাকেন।[২][৩]

খিচুড়ি
খিচুরি ও ইলিশ মাছ ভাঁজা
উৎপত্তিস্থল ভারত,  বাংলাদেশ,  পাকিস্তান
অঞ্চল বা রাজ্যপশ্চিমবঙ্গ, গুজরাত, পাঞ্জাব
প্রস্তুতকারীদক্ষিণ এশিয়া
প্রধান উপকরণচাল, বিভিন্ন রকম ডাল, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, ধনিয়া গুঁড়া, আলু, সবজি, মাংস(খাসি, মুরগির মাংস), পিঁয়াজ
ভিন্নতাভুনা খিচুড়ি, নরম খিচুড়ি, সবজি খিচুড়ি, নিরামিষ খিচুড়ি

নামকরণ

বেঙ্গালুরুতে ঐতিহ্যবাহী আরেকা পাতায় খিচুড়ি প্রসাদ
হিন্দু উপবাসকালীন সময়ে ব্যবহৃত হয় সাবুদানা খিচুড়ি।

ধারণা করা হয় বাংলা খিচুড়ি শব্দটি সংস্কৃত খিচ্চা থেকে এসেছে।[৪][৫] অঞ্চলভেদে শব্দটির তৃতীয় ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ ও ব্যবহারে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বাঙালি পরিমন্ডলে খিচুড়ি উচ্চারণ করা হলেও কোথাও কোথাও খিচুরি বলতে শোনা যায়। হিন্দীভাষীরা ড় এবং উর্দুভাষীরা র ব্যবহার করে থাকেন খিচুড়ি উচ্চারণে।

ইতিহাস

কড়াই খিচুরি

গ্রীক দূত সেলুকাস উল্লেখ করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশে চালের সাথে ডাল মেশানো খাবার খুবই জনপ্রিয় ছিলো।[৬] মরোক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা কিশরির কথা উল্লেখ করেছেন যা চাল এবং মুগ ডাল দিয়ে প্রস্তুত করা হতো।[৭] ১৫ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘুরতে আসা রাশিয়ান পর্যটক আফনাসিই নিকতিন খিচুড়ির কথা তার লেখায় বর্ণনা করেছেন। চাণক্যের লেখায় মৌর্যযুগের চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে চাল, ডালের মিশ্রণে তৈরি খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের লেখাতেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজসভার রান্নাঘরে খিচুড়ির কথা পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতকে ফরাসি পরিব্রাজক তাভেরনিয়ের লিখেছেন, সে সময় ভারতের প্রায় সব বাড়িতেই খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আকবরের মন্ত্রী ও ঐতিহাসিক আবুল ফজল রাজকীয় রান্নাঘরে বিভিন্ন ধরনের খিচু়ড়ি রান্নার কথা লিখেছেন। আইন-ই-আকবরিতে বিভিন্ন প্রকার খিচুড়ির প্রস্তুতপ্রণালী পাওয়া যায়।[৮] সেখানে আকবর এবং বীরবলের খিচুরি রান্নার একটি গল্প উল্লেখ করা হয়েছে।[৯] মুঘল রান্নাঘরে জাহাঙ্গীরের প্রিয় বিশেষ ধরনের খিচু়ড়ি তৈরি করা হতো পেস্তা, কিসমিস দিয়ে। সেই খিচুড়িকে জাহাঙ্গীর নাম দিয়েছিলেন ‘লাজিজান’। সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রিয় ‘আলমগিরি খিচড়ি’র কথাও জানা যায়। এই খিচড়িতে চাল, ডালের সঙ্গে মেশানো হত বিভিন্ন প্রকার মাছ ও ডিম।

রাজকীয় খাবার হিসেবে হায়দরাবাদের নিজামের রান্নাঘরেও খিচুড়ি জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই খিচুড়ির ভাঁজে ভাজে থাকতো সুস্বাদু মাংসের কিমা। ১৯ শতকের ভিক্টোরিয়ান যুগে দেশে ফেরত ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের হাত ধরে তা ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। এই খিচুড়ি জনপ্রিয় ইংলিশ ব্রেকফাস্ট ‘কেদেগিরি' হয়ে ওঠে।

ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে নিম্নবিত্ত মিশরীয়দের মধ্যে কুশারি নামে যে রান্নাটি জনপ্রিয় হয় তা খিচুরীরই ভিন্নরূপ বলা যেতে পারে । এটি তৈরী হতো তুলশীমালা চাল , ডাল , চানা , ভিনিগার , টমেটো সস , পিঁয়াজ , আদা , রসুন ইত্যাদি উপকরন দিয়ে। পরে এই রান্নাটি তাদের সৈন্যশিবিরেও স্থান পায়।

ভুনা খিচুড়ি

প্রকারভেদ

বর্ষাকালের খিচুড়ি ও সাথে থাকা অন্যান্য ভাজাভুজি, পশ্চিমবঙ্গ।

বর্ষা, বাঙালি এবং খিচুড়ির মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বৃষ্টিদিনে বাঙালি খিচুড়ি খেতে খুবই পছন্দ করে[১০]। এর সংগে যদি ভুনা মাংস কিংবা ইলিশ ভাজা হয় তবে তা ভোজনরসিক বাঙালির কাছে নির্ঘাত অমৃত সমান। বাঙালির ঘরে খিচুড়ি নিয়ে নিরীক্ষা হয় প্রচুর৷ কখনও মাংস দিয়ে, কখনও মাছ দিয়ে বা কখনও সবজি সহযোগে৷ বাঙালির তালিকায় রয়েছে, মুগ ডালের খিচুড়ি, সবজি খিচুড়ি, মুসুর ডালের খিচুড়ি, গমের খিচুড়ি, সাবুর খিচুড়ি, মাংসের খিচুড়ি, ডিমের খিচুড়ি, মাছের খিচুড়ি, ভুনা খিচুড়ি।

সাহিত্যে খিচুড়ি

মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য মনসামঙ্গলে শিব পার্বতীকে ডাবের পানি দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি রান্নার ফরমায়েশ দিচ্ছেন। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আদা কাসন্দা দিয়া করিবা খিচুড়ি’। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে ডালের ব্যবহার মত প্রাচীন নয়। নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্রাচীন বাঙালীর খাদ্য তালিকায় ডালের উল্লেখ কোথাও দেখিতেছি না।’ ডাল না থাকলে ডালেচালে মেশানো খিচুড়ি হবে কী করে?[১১] কোনো কিছু তালগোল পাকিয়ে গেলে বাংলায় তাকে ‘জগাখিচুড়ি’ দশা বলে। বাস্তবে জগাখিচুড়ি বলে এক রকমের খিচুড়ি আছে। পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের নিত্যদিন খিচুড়ি বিতরণ করা হয়। ‘জগন্নাথ দেবের খিচুড়ি’ লোকমুখে সংক্ষেপে হয়েছে ‘জগাখিচুড়ি’[১২]। আর বাঙালীর কথ্যরীতিতে তা তালগোল পাকানোর প্রতিশব্দ হিসেবে পরিণত হয়েছে।

উপকারিতা

এক থালা খিচুড়িতে প্রায় ১৭৭ ক্যালরি শক্তি, ৩২.৩ গ্রাম শর্করা, ৮.৪ গ্রাম প্রোটিন, ১.৫ গ্রাম চর্বি থাকে। এছাড়াও ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, আয়রন এবং ফাইবার বা আঁশ রয়েছে।[১৩] যেহেতু একেক ধরনের খিচুড়ি তৈরিতে একেক ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয় তাই ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের উপস্থিতির কারণে বিভিন্ন ধরনের উপকারী ভূমিকা পালন করে। ওটস খিচুড়িতে উপস্থিত ফাইবার, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট দেহে উপস্থিত টক্সিক উপাদানদের বের করে দেয়।[১৪] সবজি খিচুড়িতে প্রচুর মাত্রায় ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং বেশ কিছু খনিজ থাকে যা হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়। মুগ ডালের খিচুড়ি দীর্ঘ সময় পেট ভরিয়ে রাখায় ওজন কমাতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে। কাওনের খিচুড়ি প্রোটিন, ফাইবার, ফসফরাস এবং অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিপূর্ণ।[১৫] সাবুদানা খিচুড়িতে কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন সি এবং ক্যালসিয়ামসহ একাধিক খনিজ রয়েছে।[১৬]

বেশ সহজপাচ্য এবং শক্তিদায়ক বলে অসুস্থ এবং দুর্বল মানুষকে খিচুড়ি খেতে দেওয়া হয়। বাচ্চাদের পেটে সহজে শক্ত খাবার হজম হয় না বলে তাদেরকে খুব নরম খিচুড়ি খেতে দেওয়া হয়।[১৩][১৭]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী