কারোয়া

উদ্ভিদের প্রজাতি

কারোয়া বা কেওড়া (বৈজ্ঞানিক নাম: Carum carvi; “ভূমধ্যসাগরীয় ফেনেল”[১] বা “পারস্য জিরা” নামেও পরিচিত[১]) হলো অ্যাপিয়াসি গোত্রের[২] একটি দ্বিবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এরা পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার স্থানীয় প্রজাতি।[৩][৪][৫]

কারোয়া
কেওড়া
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস সম্পাদনা করুন
জগৎ/রাজ্য:প্লান্টি (Plante)
গোষ্ঠী:ট্র্যাকিওফাইট (Tracheophytes)
ক্লেড:সপুষ্পক উদ্ভিদ (অ্যাঞ্জিওস্পার্মস)
ক্লেড:ইউডিকটস
গোষ্ঠী:অ্যাস্টেরিডস (Asterids)
বর্গ:Apiales
পরিবার:Apiaceae
গণ:Carum
L.
প্রজাতি:C. carvi
দ্বিপদী নাম
Carum carvi
L.

গাজর পরিবারের অন্য সদস্যদের মতোই কারোয়া উদ্ভিদের পাতা পালকসদৃশ ও সুদৃশ্যভাবে পৃথক এবং সুতার মতো। কাণ্ডের ২০–৩০ সেমি (৮–১২ ইঞ্চি) উঁচুতে পাতা গজায়। ফুলের শাখা ৪০–৬০ সেমি (১৬–২৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়। আম্বেল নামক ধাত্রে ছোট ছোট সাদা বা গোলাপি ফুল ফোটে। কারোয়ার ফল (অনেক সময় বীজ বলে ভুল করা হয়) অর্ধচন্দ্রাকৃতির একিন। পাঁচটি সূক্ষ্ম খাঁজযুক্ত ফলগুলো প্রায় ২ মিমি (১৬ ইঞ্চি) লম্বা হয়ে থাকে।

কারোয়া
প্রতি ১০০ গ্রাম (৩.৫ আউন্স)-এ পুষ্টিমান
শক্তি১,৩৯০ কিজু (৩৩০ kcal)
৪৯.৯০ গ্রাম
চিনি০.৬৪ গ্রাম
খাদ্য আঁশ৩৮.০ গ্রাম
১৪.৫৯ গ্রাম
সুসিক্ত স্নেহ পদার্থ০.৬২০ গ্রাম
এককঅসুসিক্ত৭.১২৫ গ্রাম
বহুঅসুসিক্ত৩.২৭২ গ্রাম
১৯.৭৭ গ্রাম
ভিটামিনপরিমাণ দৈপ%
ভিটামিন এ সমতুল্য
২%
১৮ μg
থায়ামিন (বি)
৩৩%
০.৩৮৩ মিগ্রা
রিবোফ্লাভিন (বি)
৩২%
০.৩৭৯ মিগ্রা
নায়াসিন (বি)
২৪%
৩.৬০৬ মিগ্রা
ভিটামিন বি
২৮%
০.৩৬০ মিগ্রা
ফোলেট (বি)
৩%
১০ μg
ভিটামিন সি
২৫%
২১.০ মিগ্রা
ভিটামিন ই
১৭%
২.৫ মিগ্রা
ভিটামিন কে
০%
০ μg
খনিজপরিমাণ দৈপ%
ক্যালসিয়াম
৬৯%
৬৮৯ মিগ্রা
লৌহ
১২৫%
১৬.২৩ মিগ্রা
ম্যাগনেসিয়াম
৭৩%
২৫৮ মিগ্রা
ফসফরাস
৮১%
৫৬৮ মিগ্রা
পটাশিয়াম
২৯%
১৩৫১ মিগ্রা
সোডিয়াম
১%
১৭ মিগ্রা
জিংক
৫৮%
৫.৫ মিগ্রা
অন্যান্য উপাদানপরিমাণ
পানি৯.৮৭ গ্রাম
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মার্কিন সুপারিশ ব্যবহার করে শতাংশ অনুমান করা হয়েছে।
উৎস: ইউএসডিএ ফুডডাটা সেন্ট্রাল

ব্যুৎপত্তি

“কারোয়া” শব্দের উৎপত্তি অনেক জটিল এবং অল্পই বোধগম্য। কারোয়া শব্দটি ইংরেজি “ক্যারাওয়ে” (Caraway) শব্দের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে একে ডাকা হতো। নামগুলো প্রধাণত লাতিন “কিউমিনাম” (cuminum; জিরা), গ্রিক “কারন” (জিরা; যা আবার লাতিনে “ক্যারাম”; carum হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়, যার অর্থ আবার “কারোয়া”) এবং সংস্কৃত “করবী” (কখনো “কারোয়া” আবার কখনো “মৌরী” বোঝায়) থেকে এসেছে।[৬]

ইংরেজি প্রতিশব্দ caraway ব্যবহারের সর্বপ্রথম নজির পাওয়া যায় অন্তত ১৪৪০ খ্রিষ্টাব্দে।[৭] ভাষাতাত্ত্বিক ওয়াল্টার উইলিয়াম স্কিটের মতে, এই শব্দের উৎস হলো আরবি ভাষা। অন্যদিকে, গার্নো ক্যাজারের মতে আরবি “আল-কারাউইয়্যা” (كراوية; তুলনা. স্প্যানীয় “আলকারাভিয়া” alcaravea) শব্দটিই লাতিন ক্যারাম থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে।[৬]

রাসায়নিক উপাদান

গুঁড়ো অবস্থায় কারোয়ায় প্রায় ৭.৫% উদ্বায়ী তেল (প্রধানত ডি-কার্ভোন) এবং ১৫% স্থির তেল, যার মধ্যে প্রধান ফ্যাটি অ্যাসিড হলো অলিক অ্যাসিড, লিনোলিক অ্যাসিড, পেট্রোসেলিনিক অ্যাসিড ও পামিটিক অ্যাসিড।[৮]

কারোয়ায় শনাক্তকৃত উদ্ভিজ্জ রাসায়নিকের মধ্যে রয়েছে থাইমল, অর্থো-সাইমিন, গামা-টারপিনিন, ট্রাইমিথিলিন ডাইক্লোরাইড, বিটা-পাইনিন, ২-(১-সাইক্লোহেক্সিনাইল), সাইক্লোহেক্সানোন, বিটা-ফেলানড্রিন, ৩-কারিন, আলফা-থুজিন ও লিনালুল।[৮]

ইতিহাস

প্রাচীন গ্রিসের উদ্ভিদবিজ্ঞানী পেদানিউস দিয়োসকোরিদেস ভেষজ ঔষধ ও টনিক হিসেবে কারোয়ার উল্লেখ করেন। এরপর রোমক অ্যাপিকিউয়াস-এ রান্নার উপকরণ হিসেবে কারোয়ার উল্লেখ করা হয়।[৯] আরব বিশ্বে এটি “কারাউইয়্যা” হিসেবে পরিচিত এবং মূলত মরক্কোয় এর চাষ করা হয়।[৯]

ব্যবহার

কারোয়ার ফল

কারোয়ার ফল মূলত গোটা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মৌরির মতো তীব্র গন্ধ ও ঝাঁজ রয়েছে, যা মূলত কার্ভোন, লিমোনিন,[১০] ও অ্যানিথল[১১] প্রভৃতি উদ্বায়ী তেল থেকে আসে। কারোয়া মসলা হিসেবে বিভিন্ন রুটি, বিশেষ করে রাই রুটিতে ব্যবহৃত হয়।[১২] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারোয়ার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় রাই রুটিতে অতিরিক্ত উপাদান হিসেবে, যা “সিডেড রাই” বা “জিউইশ রাই” নামে পরিচিত। এই রন্ধনপ্রণালী পূর্ব স্লাভীয় রাই রুটি থেকে উদ্ভূত, যাতে ধনে ও কারোয়া ব্যবহৃত হয় (বরোডিনস্কি রুটি দ্রষ্টব্য)। কারোয়ার ফল আইরিশ সোডা রুটিতে কিশমিশ ও শুকনো ফলের সাথে প্রায়শই ব্যবহৃত হয়।

কারোয়া মিষ্টান্ন, পানীয় ও ক্যাসেরোল প্রভৃতি অন্যান্য খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর পাতা পার্সলের মতো সালাদ, স্ট্যু বা স্যুপে ব্যবহার করা যায় এবং কাঁচা, শুকনো বা রান্না করা অবস্থায় ভেষজ ঔষধ হিসেবে সেবন করা হয়।[১৩] কোনো কোনো অঞ্চলে এর মূল পার্সনিপের মতো শীতকালীন মূলজ সবজি হিসেবে খাওয়া হয়।[১৩][১২]

কারোয়ার ফল হরেক রকমের ইউরোপীয় রান্নায় ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ সাওয়ারক্রাউট ও কারোয়া বীজের কেকের নাম উল্লেখ করা যায়। অস্ট্রীয় রন্ধনপ্রণালীতে গরুর মাংস এবং জার্মান রন্ধনপ্রণালীতে শূকরের মাংসের সিজনিংয়ে কারোয়া ব্যবহৃত হয়। হাঙ্গেরিতে গুল্যাশ তৈরিতে এবং নরওয়েজীয় ও সুয়েডীয় রীতিতে কারোয়ার কালো কেক তৈরিতে কারোয়ার ব্যবহার রয়েছে।[১২]

হাঙ্গেরিসার্বিয়ায় ঘরে তৈরি নোনতা স্কোনের ওপর প্রায়শই কারোয়া ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া বন্ড-ওস্ট, পুলটোস্ট, হ্যাভাতশি, তিলসিত প্রভৃতি পনিরে কারোয়া অতিরিক্ত সুগন্ধ আনয়ন করে।

সুইজারল্যান্ডআলজাসে মসলা হিসেবে কারোয়া অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়। এই অঞ্চলে ভুলবশত একে জিরা নামে ডাকা হয়। প্রকৃত জিরার স্বাদ-গন্ধ অনেক আলাদা হওয়ায় এটি একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করে।

জার্মানি ও রাশিয়ায় কিমেল, স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় আকোয়াভিত ও আইসল্যান্ডে প্রেন্নিভিন তৈরিতে কারোয়া ব্যবহৃত হয়।[১২]

মধ্যপ্রাচ্যে মাগলি নামে কারোয়ার একধরনের পুডিং তৈরি করা হয়। এটি বিশেষত রমজান মাসের একটি জনপ্রিয় খাদ্য। এটি সাধারণত লেভান্ত অঞ্চলে ও নবজাতকের জন্মোৎসবে তৈরি ও পরিবেশন করা হয়। এছাড়া উত্তর আফ্রিকায় মরিচের সস হারিসসায় কারোয়া বিশেষ ফ্ল্যাভার যোগ করে। আলেপ্পীউ সিরীয় রীতিতে কেলিয়াচা নামের মিষ্টি স্কোন তৈরিতেও কারোয়ার ব্যবহৃত হয়।

কারোয়া ফলের তেল সাবান, লোশন, প্রসাধনী প্রভৃতিতে সুগন্ধীকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুখের দুর্গন্ধ দূরীকরণেও এর ব্যবহার আছে। এছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে লোক ঔষধি তৈরিতে কারোয়ার ব্যবহার তো রয়েছেই।

চাষাবাদ

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র ইউরোপজুড়ে কারোয়ার চাষ হয়। রান্নার জন্য কারোয়ার ফল এবং ঔষধ ও বিশেষ পানীয় বা লিকার প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত উদ্বায়ী তেলের জন্য এখানে কেবলমাত্র ক্যারাম কারভি প্রজাতির চাষ হয়।[১৪] ক্যারাম গণের অন্যান্য ইউরোপীয় প্রজাতির ফল তুলনামূলক ছোট; এদের কিছু কিছু প্রজাতি পাথুরে পর্বতে (বিশেষ করে বলকান, ইটালীয় আল্পস ও অ্যাপেনাইন অঞ্চলে) জন্মায়।

কারোয়া উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য উষ্ম ও রৌদ্যোজ্জ্বল এলাকা এবং জৈব উপাদানে সমৃদ্ধে ও সেচের সুব্যবস্থাযুক্ত মাটির প্রয়োজন। অপেক্ষাকৃত উষ্ম অঞ্চলে প্রতি বছর শীতকালে এটি রোপণ করা হয়। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন একবর্ষজীবী বা দ্বিবর্ষজীবী ফসল হিসেবে এটি লাগানো হয়। তবে, এর বহুবর্ষজীবী পলিপ্লয়েড (চার সেট ক্রোমোজোমযুক্ত) প্রকারণও পাওয়া যায়।

কারোয়া চাষের ফসল হিসেবেই অধিক বিবেচিত। কারোয়ার শীর্ষ উৎপাদক দেশ হলো যথাক্রমে নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড ও জার্মানি।[১৫] ২০১১-এর হিসাবমতে ফিনল্যান্ডের ১৫০০ মতো ফার্মে সারা দুনিয়ার ২৮% কারোয়ার চাষ হয়। কারোয়ার জন্য উপযোগী জলবায়ু এবং উচ্চ অক্ষাংশের ফলে গ্রীষ্মকালে যথেষ্ট সূর্যালোক প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণে ফিনল্যান্ডে কারোয়ার যথেষ্ট উৎপাদন হয়।[১৬]

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

  • চিসাম, হিউ, সম্পাদক (১৯১১)। "Caraway"। ব্রিটিশ বিশ্বকোষ5 (১১তম সংস্করণ)। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা 303। 
🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী