ককাটিয়েল
ককাটিয়েল হলো কাকাতুয়া পরিবারের একটি পাখি। ককাটিয়েলকে ক্যারিওন এবং উইরো নামেও ডাকা হয়। বাংলাদেশে এটি 'ককাটেল' বা 'ককাটেল পাখি' নামেই বেশি পরিচিত। ককাটিয়েল মূলত অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের এন্ডেমিক প্রাণী; এর বৈজ্ঞানিক নাম Nymphicus hollandicus। বন্য প্রজাতি হিসেবে একে অস্ট্রেলিয়া ছাড়া কোথাও পাওয়া না গেলেও বিশ্বব্যাপি এটি খাঁচায় পোষা গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালিত হয়। সহজে বাচ্চা উৎপাদন, সৌন্দর্যের জন্য এটি বাজিরিগারের পরে খাঁচায় পোষা দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রজাতি।
ককাটিয়েল | |
---|---|
পুরুষ / নর | |
স্ত্রী / মাদি | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | Animalia |
পর্ব: | কর্ডাটা |
শ্রেণী: | পক্ষী |
বর্গ: | Psittaciformes |
মহাপরিবার: | Cacatuoidea |
পরিবার: | Cacatuidae |
উপপরিবার: | Nymphicinae |
গণ: | Nymphicus ভাগলার, 1832 |
প্রজাতি: | N. hollandicus |
দ্বিপদী নাম | |
Nymphicus hollandicus (কের, 1792) | |
ককাটিয়েলের বিস্তৃতি (লাল করা অংশ; সারাবছর পাওয়া যায়) | |
প্রতিশব্দ | |
Psittacus hollandicus |
ককাটিয়েল Nymphicus গণের একমাত্র প্রজাতি। পূর্বে এটিকে ঝুঁটিওয়ালা তোতা বা ছোট কাকাতুয়া হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সাম্প্রতিককালের মলিকিউলার গবেষণা ককাটিয়েলকে এটির নিজস্ব উপগোত্র Nymphicinae-তে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটি এখন কাকাতুয়ার পরিবার Cacatuidae গোত্রের ক্ষুদ্রতম উপগোত্র হিসেবে পরিচিত। ককাটিয়েলের উৎপত্তি ও বিচরণ অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলীয় জলাভূমি, বুনো ঝোপঝাড় ও গুল্মভুমিগুলোতে এরা বসবাস করে।
শ্রেণিবিন্যাস ও উৎপত্তি
১৭৯৩ সালে সর্বপ্রথম স্কটিশ লেখক ও প্রকৃতিবিদ রবার্ট কের ককাটিয়েলের দ্বিপদ নামকরণ করেন । মূলত তিনি ককাটিয়েল বা ককাটিলকে Psittacus hollandicus নামে বর্ণিত করেন । পরবর্তীতে ভাগলার ১৮৩২ সালে ককাটিয়েলকে এটির নিজস্ব গণ Nymphicus এ লিপিবদ্ধ করেন । ককাটিয়েল এর বৈজ্ঞানিক নাম Nymphicus hollandicus হবার পেছনে একটি সুন্দর গল্প আছে । ইউরোপের পাখি দেখার দলগুলোর মধ্যে প্রথমদিককার একটি দল, যারা পাখিদের, তাদের নিজেদের বাসস্থানে পর্যবেক্ষণ করতে বেড়িয়েছিল; তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে ককাটিয়েলের গণ নামটি এসেছে । প্রথমবার পাখিটিকে দেখার পর তারা এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েন যে, পৌরাণিক জলপরী নিম্ফের নামে এটির নামকরণ করে ফেলেন । অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহাসিক নাম New Holland থেকে ককাটিয়েল প্রজাতির Specific name hollandicus নেয়া হয়েছে ।
জীববিজ্ঞান, বিশেষ করে শ্রেণিবিন্যাসের দৃষ্টিকোণ থেকে কাছাকাছি অন্যন্য প্রজাতির সাথে ককাটিয়েলের জৈবিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন বিতর্কিত একটি বিষয় ছিল । এখন এটিকে এটির মনোটাইপিক উপগোত্র Nymphicinae এ শ্রেণীবদ্ধ করা হলেও আগে এটিকে লম্বা লেজের তোতাদের গোত্র Platycercinae এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল । পরে এই সমস্যাটি আণবিক গবেষণার মাধ্যমে সমাধান করা হয় । প্রোটিন অ্যালোজাইমের উপর ১৯৮৪ সালের একটি গবেষণা থেকে জানা যায় প্রজাতি হিসেবে ককাটিয়েল তোতাদের চাইতে কাকাতুয়ার খুব কাছাকাছি সম্পর্কের । এর মাইটোকন্ড্রিয়াল 12S rRNA সিকুয়েন্স তথ্য একে শ্যামা কাকাতুয়ার উপগোত্র Calyptorhynchinae এর অন্তর্ভুক্ত করে । বাসস্থানের পরিবেশগত পরিবর্তন ও আকারে ছোট হতে থাকার প্রভাব পড়ে লম্বা লেজবিশিষ্ট তোতা বা প্যারাকিট এর অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যে ।
ককাটিয়েল Calyptorhynchinae উপগোত্রের গণগুলোর ভেতর অন্তর্ভুক্ত হবার চাইতে যে Nymphicinae উপগোত্রে বেশি উপযোগী তা প্রমাণ করে এর কোষীও নিউক্লিয়াসের ফাইব্রিনোজেন জিনের ইনট্রন ৭ নিউক্লিওটাইডের সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করা আরেকটি গবেষণা ।
ককাটিয়েল এখন Cacatuidae পরিবারের জৈববৈজ্ঞানিকভাবে শ্রেণিবিন্যাসকৃত সদস্য । কাকাতুয়া পরিবারের জৈবিক বৈশিষ্ট্য যেমন, খাঁড়া ঝুঁটি, পিত্তাশয়, নিচের দিকের পাউডার পালক, পালকে সাজানো নীল ও সবুজ রঙয়ের মাঝে চাপা মেঘের মত স্তর এবং ঠোঁটের চারপাশে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মুখের পালক যেগুলো Cacatuidae গোত্রের বাইরে খুব কম দেখা যায়, সেই বৈশিষ্ট্যগুলো ককাটিয়েলের মধ্যে পাওয়া যায় ।
জীবনকাল
খাঁচাবন্দি ককাটিয়েল সাধারণত ১৬ থেকে ২৫ বছর বাঁচে । রেকর্ড অনুযায়ী কিছু কিছু ক্ষেত্রে ককাটিয়েল ১০ থেকে ১৫ বাঁচে; ককাটিয়েলের ৩২ বছর বেঁচে থাকারও রেকর্ড আছে । একটি ককাটিয়েল পাখি অবশ্য ৩৬ বছর বেঁচে ছিল । এগুলো সাধারণত নির্ভর করে খাবার, পরিবেশ আর ওড়ার জায়গার উপর ।
বাসস্থান ও বিস্তরণ
ককাটিয়েল অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় পাখি । যেসব অঞ্চলে মরু, বিস্তৃত অনুর্বর ভূমি বা কিছুটা শুস্ক বিস্তীর্ণ ভূমি আছে, সেসব অঞ্চলে এদের বেশি দেখা গেলেও সবসময় পানির কাছাকাছি থাকে । এরা যাযাবর শ্রেণীর পাখি । যেখানে খাবার আর পানির প্রাচুর্য, সেখানে এরা উড়ে যেতে সময় নেয় না । প্রকৃতিতে ককাটিয়েলকে সাধারণত জোড়া বা ছোট ঝাঁক হিসেবে পাওয়া যায় । অনেক সময় অনেকগুলো ককাটিয়েলকে একসাথে ঝাঁক বেঁধে পানি খেতে দেখা যায় । অনেক কৃষকের কাছে এরা মূর্তিমান আতঙ্ক । এরা প্রায়ই ক্ষেতে হামলা করে চাষ করা ফসল খেয়ে আসে । অস্ট্রেলিয়ার অতি উর্বর দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, সুবিশাল ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান মরুভূমিতে এবং কেপ ইয়র্ক পেনিনসুলা উপদ্বীপে এরা অনুপস্থিত । ককাটিয়েল একমাত্র কাকাতুয়া প্রজাতি যারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মের প্রথম বছরের শেষের দিকেই বাচ্চা দেয়া শুরু করে দেয় ।
যৌন দ্বিরুপতা
প্রকৃতিতে বাচ্চা ককাটিয়েলকে নর / মাদিতে আলাদা করা খুব কঠিন । ডিম ফোটার পর থেকে প্রথম পালক বদলানোর আগ পর্যন্ত সব বাচ্চা ও অল্পবয়স্ক ককাটিয়েলকে দেখতে মাদির মত লাগে । এদের লেজের পালকের অঙ্কিয় তলে আনুভূমিক হলুদ রঙ্গের সরু রেখা বা চিকন দাগ দেখা যায় । পাখায় ওড়ার প্রাথমিক পালকের অঙ্কিয় বা নিচের দিকে বিন্দু বিন্দু হলুদ রঙ্গের ফোঁটা থাকে । মাথা ও ঝুঁটি ধূসর রঙ্গের হয় এবং প্রত্যেক বাচ্চার গলায় হাল্কা কমলা রঙ্গের দাগ থাকে ।
বেশিরভাগ পাখিপ্রজাতির মধ্যেই যৌন দ্বিরুপতা বিদ্যমান । প্রাপ্তবয়স্ক ককাটিয়েল যৌন দ্বিরুপী হয় । ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার ছয় থেকে নয় মাসের মাথায় ককাটিয়েল প্রথমবার পালক বদলায় । এসময় এদের যৌন দ্বিরুপতা অর্থাৎ নর ও মাদির আলাদা বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । পুরুষ পাখির ক্ষেত্রে এদের পাখা ও লেজের পালকের নিচের দিকের হলুদ বা হলুদাভ অথবা সাদা বা সাদাভ রেখা, ফোঁটা ও দাগগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় । ঝুঁটি ও গলার ধূসর পালকগুলো পরিবর্তিত হয়ে গাঢ় হলুদ রঙ্গের পালকে পরিণত হয় । এসময় গলার কমলা দাগটি আরো উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে । স্ত্রী পাখির ক্ষেত্রে মুখ ও ঝুঁটির পালক সাধারণত ধূসরই থাকে । তবে এদের গলায়ও কমলা দাগ থেকে যায় । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্ত্রী পাখির লেজের পালকের নিচের দিকের আনুভূমিক দাগ ও রঙগুলো আগের মত থেকে যায় ।
ককাটিয়েলের পালক ও অন্যান্য রঙ আসে মূলত দুটি রঞ্জক থেকেঃ মেলানিন ও লাইপোক্রোম । ককাটিয়েলের পালক, চোখ, ঠোঁট ও পায়ের রঙ ধূসর হয় মেলানিনের কারণে । আর মুখ ও লেজের হলুদ রঙ এবং গলার কমলা রঙ আসে লাইপোক্রোম থেকে । যদি কোন রঙের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ক্ষেত্রে, যেমন পালকের রঙ ধূসর নাকি হলুদ অথবা কমলা হবে এক্ষেত্রে মেলানিন ও লাইপোক্রোম দুটি রঞ্জকই উপস্থিত থাকলে মেলানিন সবসময় লাইপোক্রোম এর বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাঁধা দিয়ে ধূসর রঙের পালক সৃষ্টি করে ।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষ পাখির মুখের দিকে মেলানিনের পরিমাণ কমে লাইপোক্রোমকে জায়গা ছেড়ে দেয় । তাই লাইপোক্রোম এর প্রভাবে পুরুষ পাখির মাথা, গলা ও মুখমণ্ডল অঞ্চলে হলুদ ও কমলা রঙ স্পষ্ট হয়ে প্রভাব বিস্তার করে । এসময় দেহের নিচের দিকে মেলানিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় লেজের পালকের হলুদ রঙগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় ।
আরেকটি পরিবর্তন আসে গলার স্বরে । প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পাখির ডাক স্ত্রী পাখির তুলনায় আরো তীব্র ও গাঢ় হয় ।
ছবির গ্যালারী
- বুনো ককাটিয়েল
- একটি বুনো ককাটিয়েল এর খাঁড়া ঝুঁটির দ্বারা তার আগ্রহ বা উত্তেজনা বুঝাচ্ছে ।
- পালকের হাতে একটি পোষা হলদে ককাটিয়েল ।
- একটি পোষা প্রচ্ছন্ন বিচিত্রবর্ণ ককাটিয়েল ।
- প্রচ্ছন্ন বিচিত্রবর্ণ ককাটিয়েলের আসল বর্ণরূপ । এর পাখার প্রান্তের পালকগুলোতে কিছু ধূসর পালক দেখা যাচ্ছে ।
- তিন সপ্তাহ বয়সের সাদামুখ হলদে ককাটিয়েলের বাচ্চা ।
- এক দিন বয়সের বাচ্চা ককাটিয়েল ।
- অতিবেগুনী রশ্মির নিচে ককাটিয়েলের পালকগুলো জ্বলছে ।
- সামাজিক পাখি ককাটিয়েল ।
- পুরুষ ধূসর ককাটিয়েল ।
- স্ত্রী ধূসর ককাটিয়েল ।
- ফুলভর্তি ফুলদানীর সামনে উজ্জ্বল মাদি হলদে ককাটিয়েল ।
আরও দেখুন
- ককাটিয়েল (পোষাপাখি)
- রঙের পরিব্যক্তিঃ ককাটিয়েল
- হাতপোষা তোতা
- বিচিত্রবর্ণ ককাটিয়েল
- হলদে ককাটিয়েল
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
- কার্লিতে Cockatiels (ইংরেজি)
- Inte Onsman's MUTAVI Research & Advice Group
- Cockatiels – National Cockatiel Society
- Cockatiel Information Forum and Bulletin Board – Talk Cockatiels
- Videos, images and sounds ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ মার্চ ২০১৬ তারিখে – Internet Bird Collection
টেমপ্লেট:Cockatoos