উচ্চশিক্ষায়তনিক পাঠ্য বিষয়

উচ্চশিক্ষায়তনিক পাঠ্য বিষয় বলতে উচ্চশিক্ষা স্তরে অর্থাৎ মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জ্ঞানের যে ক্ষেত্র বা শাখাগুলির ওপরে অধ্যয়ন করা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান করা হয় ও গবেষণাকর্ম সম্পাদন করা হয়, সেগুলিকে বোঝানো হয়। এগুলিকে উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্র, উচ্চশিক্ষায়তনিক জ্ঞানের শাখা বা উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণার ক্ষেত্র নামেও ডাকা হয়। মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষায়তনিক বিভাগ বা অনুষদ, বিদ্বৎসমাজ এবং গবেষণাকর্মের ফলাফল প্রকাশকারী উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা সাময়িকীগুলি এই পাঠ্য বিষয়গুলিকে সংজ্ঞায়িত করে ও এগুলিকে স্বীকৃতি প্রদান করে। চিরাচরিতভাবে উচ্চশিক্ষায়তনিক পাঠ্য বিষয়গুলিকে মানববিদ্যা, রৌপ বিধিসম্মত বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ফলিত বিজ্ঞান — এই কয়েকটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যেসব ব্যক্তি নির্দিষ্ট উচ্চশিক্ষায়তনিক পাঠ্য বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকেন, তাঁদেরকে ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ অভিহিত করা হয়।

ব্যবহারিক গবেষণা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ক উচ্চশিক্ষায়তনিক পাঠ্য বিষয়সমূহের একটি অপরিহার্য উপাদান।

উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের প্রকৃতি

শিক্ষাবিদ মার্টিন লন ও এডভিন কাইনার একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু আধুনিক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, যা অনুসারে "একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্র হল একটি বহুমাত্রিক সামাজিক যোগাযোগমূলক জালিকাব্যবস্থা যার উদ্দেশ্য জ্ঞান উৎপাদন।"[১] অর্থাৎ কোনও উচ্চশিক্ষায়তনিক ক্ষেত্রের মূল উদ্দেশ্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া নয়, বরং নতুন জ্ঞান উৎপাদন করা এবং এটির পরিচালনার মূল পদ্ধতি হল যোগাযোগ। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ফার্লংয়ের মতে একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের জ্ঞানতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক মাত্রা বিদ্যমান। এটিকে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে সুদৃঢ় ও সুসমঞ্জস হতে হয়, অর্থাৎ এটিতে যে বিষয়ের উপরে গবেষণা বা অধ্যয়ন করা হয়, সেই বিষয় সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা হয়েছে এবং এগুলিকে একটি তাত্ত্বিক পরিকাঠামোতে স্থাপন করা হয়েছে। আবার এটিকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও শক্তিশালী হতে হয়, অর্থাৎ এটি বৃহৎ-পরিধিবিশিষ্ট, জটিল প্রকৃতিবিশিষ্ট, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় তুলনামূলকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি বিষয়। এটির একটি রাজনৈতিক জীবনও আছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের সম্পর্কে যুক্তিপ্রদান, সমর্থন, দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের অবতারণা হয়।[২]

ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ জেফরি স্কোয়াইয়ার্সের মতে একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রকে তিনটি মাত্রার প্রেক্ষিতে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব। প্রথম মাত্রাটি হল শাস্ত্রটিতে গবেষণার বিষয়বস্তু কী এবং কোন্‌ সমস্যাগুলির প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় মাত্রাটি হল অধীত বিষয়বস্তুর সাপেক্ষে বিষয়টির দৃষ্টিভঙ্গি কী, অর্থাৎ কী পদ্ধতি, কৌশল ও কার্যপ্রণালী অনুসরণ করে বিষয়টিকে জানা হচ্ছে ও এর উপরে গবেষণাকর্ম সম্পাদন করা হচ্ছে)। তৃতীয় মাত্রাটি হল শাস্ত্রটি কী মাত্রায় নিজের প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন ও দার্শনিকভাবে আত্ম-বিশ্লেষণ সম্পাদন করে।[৩]

মার্কিন শিক্ষাবিদ ড্রেসেল ও মেহিউ, অস্ট্রেলীয় শিক্ষাবিদ গেবল ও তার সহযোগীগণ,[৪] ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ পল ট্রাওলার[৫] ও আর্মিন কৃষ্ণন[৬] আরও গভীরভাবে একটি পরিপক্ব উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের সাধারণ ধর্মগুলিকে নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। এগুলি নিম্নরূপ:

  1. গবেষণার বিষয়বস্তু: কোনও উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রে নির্দিষ্ট একটি বিষয়বস্তুর উপরে মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয়। তবে এই গবেষণার বিষয়বস্তুটি অন্যান্য উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের সাথে ভাগাভাগি করা হতে পারে। এছাড়া কোন্‌ ধরনের সমস্যার উপরে গবেষণা করা হবে, সে-সংক্রান্ত পরিধিও এটিতে সুসংজ্ঞায়িত থাকে। শাস্ত্রটির সত্তাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রশ্নগুলির ব্যাপারে কিছু পূর্বধারণা থাকে, যেগুলি শাস্ত্রটির উপরে আধিপত্য বিস্তার করে।
  2. পুঞ্জীভূত জ্ঞানের সঞ্চয়: কোনও উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের সেটির বিষয়বস্তুর উপরে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার সুবাদে ক্রমাগতভাবে সঞ্চিত ও পুঞ্জীভূত বিশেষায়িত জ্ঞানের একটি ভাণ্ডার বিদ্যমান, যা একান্তই সেটির নিজস্ব এবং যে ভাণ্ডারটি অন্য আরেকটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। শাস্ত্রটির বিষয়বস্তুর উপরে বিশেষায়িত গবেষণা সাময়িকীতে এবং অন্যান্য প্রকাশনা যেমন গ্রন্থ, প্রতিবেদন, সম্মেলন প্রকাশনা, ইত্যাদিতে একচেটিয়াভাবে শুধুমাত্র ঐ বিষয়টির উপরে মনোযোগ নিবদ্ধ করে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক গবেষণাপত্র ও অন্যান্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলে শাস্ত্রটির একটি সর্বজন-গৃহীত ভিত্তিসদৃশ গ্রন্থ ও রচনাসমগ্র বিদ্যমান। তবে বাস্তব বিশ্বে অঞ্চলভেদে গবেষণার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন হয়ে থাকে এবং শাস্ত্রটির উপরে বহু বিভিন্ন স্থানীয় বা আঞ্চলিক জ্ঞানের ভাণ্ডার গড়ে ওঠে।
  3. তাত্ত্বিক পরিকাঠামো: কোনও উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের এমন সব তত্ত্ব ও ধারণা রয়েছে, যেগুলির সাহায্যে এটিতে পুঞ্জীভূত ও সঞ্চিত বিশেষায়িত জ্ঞানভাণ্ডারকে কার্যকরীভাবে সুবিন্যস্ত করা সম্ভব। শাস্ত্রটির গবেষণাকর্মগুলিতে এই সব তত্ত্ব বা তাত্ত্বিক সমস্যার প্রতি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দেশ করা হয়। অর্থাৎ শাস্ত্রে একটি সাধারণভাবে গৃহীত তত্ত্বসমষ্টি বিদ্যমান এবং তত্ত্ব পরীক্ষণ ও সংশোধনের জন্য সাধারণভাবে বোধগম্য কৌশল বিদ্যমান।
  4. স্বতন্ত্র কারিগরি পরিভাষা ও যোগাযোগের পন্থা: একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রে সেটির গবেষণার বিষয়বস্তুর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিশেষ পরিভাষা বা বিশেষ কারিগরি ভাষা ব্যবহার করা হয়। অন্য অর্থে, একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের গবেষক বা বিশেষজ্ঞরা বিশেষ পন্থায় চিন্তাভাবনা করেন, নিজেদের মধ্যে বিশেষ ভাষা, বিন্যাস ও পন্থায় আলোচনা ও যোগাযোগ স্থাপন করে থাকেন। তারা অন্য কোনও ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের কাছে তাদের কাজ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষাগত ও যোগাযোগমূলক সমস্যায় পড়তে পারেন।
  5. স্বতন্ত্র ও নিজস্ব গবেষণা পদ্ধতি: কোনও উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্র গবেষণার জন্য বিশেষ প্রয়োজন অনু্যায়ী বিশেষ বিশেষ গবেষণা পদ্ধতি গড়ে তুলে থাকে। একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের গবেষণার বিবরণগুলিতে সুস্পষ্টভাবে পদ্ধতিগত ব্যাপারগুলির দিকে নির্দেশ করা থাকে। পদ্ধতিগত উন্নয়ন সাধিত হয় এবং বিশ্লেষণে এক ধরনের পরিশীলতা দৃশ্যমান হয়। একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণার ক্ষেত্র যদিও কোনও মাতৃ-ক্ষেত্রের সাধারণ ও মান পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করতে পারে, তা সত্ত্বেও এটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে একান্ত নিজস্ব বিশেষায়িত পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করে থাকে। তত্ত্বের পরীক্ষণ ও সংশোধনের কাজে সাধারণভাবে স্বীকৃত কিছু বিশ্লেষণী কৌশল আছে যেগুলিকে রীতিমাফিক প্রয়োগ করা হয়।
  6. পুনরাবৃত্তি ও পুনর্বৈধকরণমূলক গবেষণা: একটি শাস্ত্রে যেকোনও গবেষণাকর্ম অন্য কোনও গবেষক দলের দ্বারা পুনরাবৃত্তি ও পুনরায় বৈধকরণের জন্য স্বীকৃত কৌশল বিদ্যমান। মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল সেগানের মতে একটি শাস্ত্রকে কেবল নতুন নতুন ধারণার প্রতি উন্মুক্ত থাকলেই চলবে না, বরং পুরাতন ও নতুন সমস্ত ধারণাকে নিষ্ঠুর সন্দেহের চোখে পুনরায় খতিয়ে দেখতে হয়, যাতে আপাতদৃষ্টিতে গভীর কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আগডুম-বাগডুম অবোধগম্য কথাবার্তা থেকে গভীর সত্য বের করে আনা যায়।[৭] পুনরাবৃত্তিমূলক গবেষণাগুলি একটি শাস্ত্রের জ্ঞানভাণ্ডারকে নির্ভরযোগ্যতা অর্জনে সাহায্য করে।[৮]
  7. প্রাতিষ্ঠানিকতা: একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা থাকতে হয়। যেমন শাস্ত্রটির উপরে মহাবিদ্যালয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করা হয়। ঐসব প্রতিষ্ঠানে বিষয়টির উপরে আলাদা ও পূর্ণাঙ্গ বিভাগ থাকে, অধ্যাপক থাকে এবং এটিতে উচ্চশিক্ষায়তনিক উপাধি (স্নাতক, স্নাতকোত্তর, ডক্টর) প্রদান করা হয়। এটির উপরে একগুচ্ছ সুপ্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত গবেষণা সাময়িকী প্রকাশিত হয়। এটির উপরে গবেষণা কেন্দ্র বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান তথা ইন্সটিটিউট থাকতে পারে। এটির সাথে পেশাদারী সংগঠন ও বিদ্বৎসমাজ জড়িত থাকে। বিদ্বৎসমাজগুলির মধ্যে বিশেষ স্বার্থভিত্তিক দল থাকতে পারে। বিষয়টির উপরে সারা বিশ্বব্যাপী, একাধিক মহাদেশে, বহুসংখ্যক দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পূর্ণকালীন, পেশাদার গবেষক কর্মরত থাকেন এবং তাঁরা নিয়মিত স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সম্মেলনে মিলিত হয়ে নিজেদের গবেষণা কর্ম তুলনা ও মূল্যায়ন করেন ও শাস্ত্রটির পরবর্তী কর্মসূচী নির্ধারণ করেন। সর্বোপরি শাস্ত্রটি অন্যান্য শাস্ত্রের উপরে প্রভাব বিস্তার করে।
  8. স্বীকৃত পাঠ্যক্রম এবং গবেষক কর্মজীবনের প্রস্তুতি ও বিকাশ: কোনও শাস্ত্রে পণ্ডিত ও গবেষক হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য একটি স্বীকৃত পাঠ্যক্রম রয়েছে, যেটি কোনও ছাত্র ধাপে ধাপে অনুসরণ করে গবেষণামূলক কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে ও ভবিষ্যতে একজন গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারে। গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে উচ্চশিক্ষায়তনিক কর্মজীবনের পথ কী রকম হবে এবং এই পথের বিভিন্ন পর্যায়ে কী ধরনের উচ্চ বা নিম্ন উচ্চশিক্ষায়তনিক মর্যাদা লাভ করা সম্ভব, সেগুলিও একটি পরিপক্ব শাস্ত্রে মোটামুটি পরিস্কারভাবে সংজ্ঞায়িত থাকে।
  9. ভাগ করে নেওয়া কাহিনী-পরম্পরা ও ইতিহাস: কোনও শাস্ত্রের একটি নিজস্ব কাহিনী-পরম্পরা ও ইতিহাস থাকে, যাতে শাস্ত্রগুলির উল্লেখযোগ্য ও বিখ্যাত পণ্ডিত বা ব্যক্তিত্বদের জীবনী, তাঁদের অর্জন ও সাফল্য, তাঁদের মধ্যকার সংঘাত, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত এবং যেগুলি সম্পর্কে শাস্ত্রের চর্চাকারীরা বিশেষ জ্ঞান রাখেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও যোগাযোগের সময় বিশেষ ধরনের আচরণগত ও আবেগিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন ও বিশেষ ধরনের প্রেষণার বশবর্তী হয়ে কাজ করেন।
  10. ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা: কোনও শাস্ত্রের বিশেজ্ঞদের এক ধরনের সামগ্রিক কর্মসূচীর অনুভূতি থাকে, যা তাদেরকে ভবিষ্যতে শাস্ত্রের উন্নয়নের জন্য কোন্‌ দিকে মনোযোগ দিতে হবে, তার পূর্বাভাস প্রদান করে।

উল্লেখ্য যে সব উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্র উপরের সবগুলি ধর্ম প্রদর্শন করে না। তবে কৃষ্ণনের মতে কোনও উচ্চশিক্ষায়তনিক জ্ঞানানুসন্ধানের ক্ষেত্র যত বেশীসংখ্যক উপরের ধর্মগুলি প্রদর্শন করবে, সেটির একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভের সম্ভাবনা ততোই জোরদার হবে।[৬]

উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের শাখায়ন ও নতুন শাস্ত্রের উদ্ভব

প্রতিটি উচ্চশিক্ষায়তনিক পাঠ্য বিষয় বা শাস্ত্র আবার বহুসংখ্যক উপশাখা বা গবেষণার উপক্ষেত্র নিয়ে গঠিত। বেশিরভাগ গবেষক খুব সহজেই একটি নির্দিষ্ট উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করলেও (যেমন-পদার্থবিজ্ঞান) একজন গবেষকের প্রকৃত আনুগত্য আসলে থাকে কোনও সুনির্দিষ্ট উপক্ষেত্রের প্রতি (যেমন কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান), যার ভেতরে অবস্থান করে তিনি তাঁর সিংহভাগ গবেষণা সম্পাদন করেন ও সেই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিক্ষাদান করেন। কোনও কোনও উপক্ষেত্র উন্নতি লাভ করে পূর্ণাঙ্গ উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রে পরিণত হতে পারে (যেমন গণিতশাস্ত্র থেকে পরিসংখ্যানবিদ্যার উদ্ভব)।[৯]

একটি পরিপক্ব শাস্ত্রের শেষ উদ্দেশ্য হল একটি অভিসম্বন্ধ শাস্ত্রে (Reference discipline) পরিণত হওয়া। একটি অভিসম্বন্ধ শাস্ত্র নতুন নতুন উদীয়মান শাস্ত্রগুলিকে (Emergent discipline) তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত নির্দেশনা ও আদর্শ প্রদান করতে পারে যার নিরিখে নতুন শাস্ত্রটির উচ্চশিক্ষায়তনিক সাফল্য, অর্জন বা কৃতিত্ব মূল্যায়ন করা হয়। অভিসম্বন্ধ শাস্ত্র ও উদীয়মান শাস্ত্রগুলির মধ্যকার এই আন্তঃক্রিয়া শেষোক্তগুলির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের শ্রেণীকরণ

উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রগুলিকে কোনও কোনও পণ্ডিত কোমল বনাম কঠিন এবং শুদ্ধ বনাম ফলিত এইভাবে বিভাজন করেছেন।[৯]

  • কঠিন শাস্ত্র হল সেইসব শাস্ত্র যেগুলির একটি স্থিতিশীল সর্বসম্মত তাত্ত্বিক পরিকাঠামো রয়েছে এবং যেগুলিতে জ্ঞান ক্রমবর্ধমান।
  • কোমল শাস্ত্র হল সেইসব শাস্ত্র যেগুলিতে এখনও স্থিতিশীল তাত্ত্বিক পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি বরং এ ব্যাপারে বিতর্ক চলমান এবং জ্ঞানের ক্রমপুঞ্জীভবনের পরিমাণ কম।
  • শুদ্ধ শাস্ত্র হল সেইসব শাস্ত্র যেগুলিতে গবেষক তার আগ্রহের বিষয় সম্পর্কে আরও বেশি বোঝায় জন্য গবেষণাকর্ম পরিচালিত করেন।
  • ফলিত শাস্ত্র হল সেইসব শাস্ত্র যেগুলিতে কোনও ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গবেষণাকর্ম পরিচালিত করা হয়।

উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রগুলির মধ্যকার আন্তঃক্রিয়া

উচ্চশিক্ষায়তনিক পাঠ্য বিষয় বা শাস্ত্রগুলি জ্ঞানের একেকটি শাখা-প্রশাখার উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে থাকে। বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্বের আলোকে এগুলি জ্ঞান অর্জন ও উৎপাদনের একেকটি পন্থা বা "মোড" (Mode)। এগুলি পরস্পর থেকে পৃথক এবং বাস্তব বিশ্বের সমস্যা সমাধানে এগুলিতে প্রাপ্ত গবেষণালব্ধ ফলাফল কীভাবে কাজে আসতে পারে, সে ব্যাপারে এই পন্থাটি উদাসীন। কিন্তু বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাস্তব জীবনের যেকোনও জটিল সমস্যা একটিমাত্র উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের আলোকে সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং একাধিক শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের মধ্যকার সহযোগিতা, আন্তঃক্রিয়া ও সংশ্লেষণাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এগুলির বিহিত করা সম্ভব। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষাস্তরে পাঠ্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করে স্বতন্ত্র গবেষণা তহবিল গঠনের বদলে বাস্তবের কোনও নির্দিষ্ট সমস্যার প্রেক্ষিতে প্রয়োগযোগ্যতা, আন্তঃশাস্ত্রিকতা, অসমসত্ত্বতা ও সাংগঠনিক বৈচিত্র্য, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আত্ম-অবলোকন এবং মান নিয়ন্ত্রণ — এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় আরেকটি পন্থায় জ্ঞান উৎপাদন করা হতে পারে।[১০][১১] একে জ্ঞান উৎপাদনের "২ নং পন্থা" (Mode-2) বা "উত্তর-উচ্চশিক্ষায়তনিক বিজ্ঞান" (Post-academic science) নাম দেওয়া হয়েছে, যাতে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষায়তনিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাস্তবমুখী আন্তঃশাস্ত্রীয় জ্ঞান অর্জন ও উৎপাদন করেন।[১২][১৩]

এ সংক্রান্ত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল অন্তঃশাস্ত্রিকতা (intradisciplinarity), বহুশাস্ত্রিকতা (multidisciplinarity), প্রতিশাস্ত্রিকতা (cross-disciplinarity), আন্তঃশাস্ত্রিকতা (interdisciplinarity) এবং শাস্ত্রাতিক্রম বা অতিশাস্ত্রিকতা (transdisciplinarity)। এগুলি শাস্ত্রীয় সংশ্লেষণ ও আন্তঃক্রিয়ার ক্রমবর্ধমান মাত্রা নির্দেশ করে। এগুলি গবেষণার বিশেষায়িত ক্ষেত্রের সংকীর্ণ মনোযোগ থেকে যে সমস্যাগুলির উদ্ভব হতে পারে, সেগুলির সমাধান করতে পারে। নিচে এগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল।

  • অন্তঃশাস্ত্রিকতা তথা অন্তঃশাস্ত্রীয় গবেষণা বলতে সম্পূর্ণরূপে কেবলমাত্র একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্র বা গবেষণা ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থান করে গবেষণাকর্ম সম্পাদন করাকে বোঝানো হয়।
  • বহুশাস্ত্রিকতা তথা বহুশাস্ত্রীয় গবেষণাতে বিভিন্ন শাস্ত্র বা উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণার ক্ষেত্র থেকে আগত গবেষকেরা একত্রে কাজ করেন এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ শাস্ত্রীয় জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা প্রক্রিয়ায় অবদান রাখেন। বহুশাস্ত্রিকতায় বিভিন্ন শাস্ত্রের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গিগুলি একে অপরের থেকে বিসদৃশ হিসেবে পাশাপাশি বিরাজ করে এবং এদের মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়াহীন সংযোজন ঘটে। এগুলিকে একে অপরের সাথে সন্নিবিষ্ট বা সমন্বিত করার কোনও প্রচেষ্টা নেওয়া হয় না।
  • প্রতিশাস্ত্রিকতা তথা প্রতিশাস্ত্রীয় গবেষণা সাধারণত দুইটি পরস্পর সম্পর্কহীন উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের মধ্যে ঘটে থাকে, যেখানে একটি শাস্ত্রকে অন্য একটি শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকন করা হয়। এক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় সীমানা অতিক্রম করা হয়, শাস্ত্র দুইটির মধ্যে কোনও সমন্বয় সাধন করা হয় না। বরং প্রতিটি শাস্ত্র নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, পদ্ধতি ও মূলনীতিগুলি বজায় রেখে অপর শাস্ত্রটির কোনও নির্দিষ্ট দিক পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে।
  • আন্তঃশাস্ত্রিকতা তথা আন্তঃশাস্ত্রীয় গবেষণাতে দুই বা ততোধিক স্বতন্ত্র উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্রের গবেষকেরা তাঁদের শাস্ত্রের বিশেষায়িত জ্ঞান, পদ্ধতি ও তাত্ত্বিক কাঠামোগুলিকে সংযুক্ত ও সন্নিবিষ্ট করে একটি নতুন ধারণাগত প্রতিমান বা মডেল নির্মাণ করার চেষ্টা করেন এবং এমন সব গবেষণা নকশা ও পদ্ধতি ব্যবহার করেন যেগুলি যেকোনও একটি শাস্ত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং আন্তঃশাস্ত্রীয় গবেষণা প্রক্রিয়াটির বহুসংখ্যক দশাতে সংশ্লিষ্ট সবগুলি শাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতা ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে একাধিক শাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গিগুলির মধ্যকার সীমানাগুলি ভাঙতে শুরু করে, প্রতিটি শাস্ত্র অপর শাস্ত্রের গবেষণার উপরে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে এবং ফলে শাস্ত্রগুলির মধ্যে এক ধরনের আন্তঃক্রিয়াভিত্তিক প্রকৃত সংশ্লেষণ ঘটে।[১৪]
  • অতিশাস্ত্রিকতা বা শাস্ত্রাতিক্রমী গবেষণাতে বিভিন্ন স্বতন্ত্র উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্র থেকে আগত গবেষকরা একত্রে কাজ করে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সম্মিলন ও সংশ্লেষণ ঘটিয়ে সম্পূর্ণ নতুন তাত্ত্বিক, পদ্ধতিগত ও রূপান্তরিত কিছু ধারণা সৃষ্টি করেন যেগুলি সংযুক্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রগুলির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে ছাড়িয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ও সামগ্রিক একটি তাত্ত্বিক পরিকাঠামো সৃষ্টি করে, যার সাহায্যে কোনও অভিন্ন সমস্যার বিহিত করা যায়। শাস্ত্রাতিক্রমী গবেষণার ফলাফল সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রগুলির স্বতন্ত্র গবেষণার ফলাফলের কোনও সংযোজন বা পারস্পরিক প্রভাবান্বিত কোনও মিশ্রণ নয়, বরং সম্পূর্ণ নতুন কোনও কিছু। এ ব্যাপারটিকে "ভিন্‌জনন"-ও (Xenogenesis) বলা হয়।[১৪]

সংক্ষেপে বলতে গেলে, উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা ক্ষেত্র বা শাস্ত্রগুলিকে আপাতদৃষ্টিতে সুপ্রতিষ্ঠিত ও অখণ্ড কিছু মনে হতে পারে, কিন্তু এগুলি আসলে বেশ ভঙ্গুর, সদা-পরিবর্তনশীল ও সাময়িক কিছু সত্তা, যেগুলি কোনও ঘটনা, আবিষ্কার, বা নতুন ধরনের ব্যাখ্যার ফলে আমূল রূপান্তরিত হতে পারে। এই রূপান্তর খুব ধীরে ধীরে ঘটতে পারে, কিংবা রাতারাতিও ঘটতে পারে। উচ্চশিক্ষায়তনিক জ্ঞানের শাখাগুলির মানচিত্র তাই প্রতিনিয়ত পুনরঙ্কিত হয়ে চলেছে।[১৫][১৬]

তথ্যসূত্র

🔥 Top keywords: প্রধান পাতা২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)বিশেষ:অনুসন্ধানঈদুল আযহাঈদের নামাজকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঈদ মোবারকক্লিওপেট্রাকোকা-কোলারাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)এক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলাদেশমিয়া খলিফাআসসালামু আলাইকুমআবহাওয়া২০২৪ কোপা আমেরিকাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনউয়েফা ইউরো ২০২৪ওয়ালাইকুমুস-সালামসন্দীপ লামিছানেতানজিম হাসান সাকিববাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকানির্জলা একাদশীকাজী নজরুল ইসলামচন্দ্রবোড়াশাকিব খানঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী বিবেকানন্দভারতমহাত্মা গান্ধীঐশ্বর্যা রাইবাংলা ভাষাআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহমুহাম্মাদএকাদশী