আল-আহসা (আরবি: الْأَحْسَاء, আল-আহসা), এটি আল-হাসা (আরবি: الْحَسَاء) বা হাজার (আরবি: هَجَر) নামেও পরিচিত, এটি পূর্ব সৌদি আরবের একটি ঐতিহ্যবাহী মরুদ্যান ঐতিহাসিক অঞ্চল যার নামানুসারে আল-আহসা গভর্নরেটের নামকরণ করা হয়েছে, যা দেশের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে গঠিত। মরূদ্যানটিপারস্য উপসাগরের উপকূল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার (৩৭ মাইল) অভ্যন্তরে অবস্থিত।
আল-আহসা এই অঞ্চলের একটি অংশ যা ঐতিহাসিকভাবে সূচিকর্মের দক্ষতার জন্য, বিশেষ করে বিশত (পুরুষদের একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক) তৈরি করার জন্য বিখ্যাত।[১] আল-বাহরাইনের ভৌগোলিক প্রদেশটি পূর্ব আরবে অবস্থিত, যার মধ্যে আরব উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমানের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এর মধ্যে আউয়াল দ্বীপও (আধুনিক বাহরাইন) অন্তর্ভুক্ত। ঐতিহাসিকভাবে আল-আহসা আল-বাহরাইন প্রদেশের প্রধান শহর, এর জনসংখ্যার বেশিরভাগই আল-আহসার এবং কৃষির বেশিরভাগ এখান থেকে সরবরাহ হয়।
স্থানটি ২০১৮ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানে পরিণত হয়েছে।[২] ডিসেম্বর ২০১৫ সাল থেকে এটি ইউনেস্কো সৃজনশীল শহরের নেটওয়ার্কেরও একটি অংশ।[৩] একজন লেখকের মতে, আল-হাসা এবং আল আইন (ওমান সীমান্ত সংলগ্ন সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থিত) এর মরুদ্যানসমূহ আরব উপদ্বীপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।[৪]
ব্যুৎপত্তি
আল-আহসা "আল-হিসা" (আরবি: ْلْحِسَى) এর বহুবচন, যার দ্বারা শক্ত তলদেশেসহ জমা হওয়া বালি বোঝায়। ফলে যদি বৃষ্টিপাত হয়, বালি সূর্যের তাপে পানি শুকিয়ে যাওয়া থেকে বাধা দান করে এবং শক্ত ভিত নিমজ্জন থেকে ঠেকিয়ে রাখে। তাই চাষ করলে জায়গাটি মিষ্টি ঠান্ডা বসন্তের মতো হয়ে উঠে।[৫]
শুষ্ক অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকার কারণে আল-আহসাতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বসতি স্থাপন হয়েছে।[৬] প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রাকৃতিক মিষ্টি পানির ঝর্ণা হাজার বছরের জন্য এই অঞ্চলকে মরুদ্যানে পরিনত করেছে, যা মানুষের বাসস্থান এবং কৃষিকাজকে (বিশেষ করে খেজুর চাষকে) উৎসাহিত করেছে। সম্প্রতি, আল-আহসা মরুদ্যানকে বিশ্বের সাতটি বিস্ময়ের মধ্যে একটি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।
এর প্রাথমিক ইতিহাস পূর্ব আরবের মতো। ৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে এ অঞ্চলটি কারমাতিয়ান নেতা আবু তাহির আল-জান্নবির নিয়ন্ত্রণে আসে [৭] এবং বাগদাদেরআব্বাসীয় খিলাফত থেকে স্বাধীন ঘোষণা করে। এর রাজধানী ছিল আধুনিক হফুফের কাছে আল-মু'মিনিয়ায়। ১,০০০ সিরকার দ্বারা আল-হাসা ১,০০,০০০ জন অধিবাসী নিয়ে বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম শহরে পরিণত হয়ে উঠে। ১০৭৭ সালে কারমাতিয়ান রাষ্ট্র আল-আহসাকে উয়ুনিদরা উৎখাত করে। আল-আহসা পরবর্তীকালে উসফুরিদের বাহরানী বংশের শাসনের অধীনে আসে এবং এরপরে তাদের আত্মীয় জাবরিদরা হরমুজের রাজকুমারদের কাছ থেকে বাহরাইন দ্বীপপুঞ্জকে পুনরধিকার করে এ অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী শক্তি হয়ে উঠে। বাহরাইনের সর্বশেষ জাবরিদ শাসক ছিলেন মুকরিন ইবনে জামিল।
১৫২১ সালে পর্তুগিজ সাম্রাজ্য জাবরিদের শাসক মুকরিন ইবনে জামিলের কাছ থেকে আউয়াল দ্বীপপুঞ্জ (বর্তমান বাহরাইন দ্বীপপুঞ্জ) দখল করে নেয়।[৮] জাবরিদরা মূল ভূখণ্ডে উসমানীয় এবং তাদের উপজাতি মিত্র মুনতাফিকের মুখোমুখি হয়ে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে লড়াই করে। ১৫৫০ সালে আল-আহসা এবং এর নিকটবর্তী কাতিফ উসমানীয় সাম্রাজ্যেরসুলতানপ্রথম সুলাইমান তার অধীনে আনেন।[৯] আল-আহসা উসমানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নামেমাত্র লাহসা এলায়েত হিসাবে থাকে এবং সাধারণত পোর্তের সামন্ত রাজ্য ছিল। পরবর্তীতে কাতিফ পর্তুগিজদের কাছে হেরে যায়।
১৬৭০ সালে উসমানীয়দের আল-আহসা থেকে বিতাড়িত করা হয়[৯] এবং অঞ্চলটি বনু খালিদ উপজাতি প্রধানদের অধীনে আসে।
কাতিফের সাথে আল-আহসাকে ১৭৯৫ সালে ওয়াহাবীদিরিয়া আমিরাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে মিশরের মুহাম্মদ আলীর আক্রমণের ফলে ১৮১৮ সালে উসমানীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসে। বনু খালিদকে আবারও এই অঞ্চলের শাসক হিসাবে অধিষ্ঠিত করা হয়, কিন্তু ১৮৩০ সালে নজদের আমিরাত অঞ্চলটি পুনরায় দখলে নিয়ে নেয়।
১৮৭১ সালে পুনরায় সরাসরি উসমানীয় শাসনের অধিনে আসে[৯] এবং আল-আহসাকে প্রথমে বাগদাদ বিলায়েতের অধীনে এবং ১৮৭৫ সালে বাগদাদের মহকুমা বসরা বিলায়েতের সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯১৩ সালে আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌদ আল-আহসা এবং কাতিফকে তাঁর রাজ্য নাজদের সাথে যুক্ত করেন।[১০]
১৯২২ সালের ২ ডিসেম্বর পার্সি কক্স কুয়েতের আমির শেখ আহমদ আল সাবাহাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয় যে কুয়েতের সীমানা সংশোধন করা হয়েছে।[১১] এই বছরের শুরুতে কুয়েতে ব্রিটিশ প্রতিনিধি মেজর জন মোর সৌদি আরবের ইবনে সৌদের সাথে কুয়েত ও নজদ সীমান্তের সমস্যা সমাধানের জন্য বৈঠক করেছিলেন। সভার ফলাফল ছিল ১৯২২ সালের উকায়ের প্রোটোকল, যেখানে ব্রিটেন কুয়েতের আমিরের দাবি করা অঞ্চলসমূহের উপর ইবনে সৌদের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়। আল-আহসা আল সৌদ তৃতীয় দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়, দেশটি ১৯১৩ সালে উসমানীয়দের কাছ থেকে দখল নেওয়া হয়েছিল, ফলে তিনি পারস্য উপসাগরীয় উপকূলের নিয়ন্ত্রণ পান এবং সৌদি আরবের বিশাল তেলের মজুদাগার হয়।
অর্থনীতি
খেজুর গাছের মরূদ্যান
ঐতিহাসিকভাবেই আল-হাসা আরব উপদ্বীপের ধান উৎপাদনকারী কয়েকটি অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম ছিল।[১২] ১৯৩৮ সালে দাম্মামের নিকটে খনিজ তেল আবিষ্কৃত হয়,[১৩][১৪] ফলে এই অঞ্চলের দ্রুত আধুনিকায়ন ঘটে। ১৯৬০ এর দশকের গোড়ার দিকে, উৎপাদনের পরিমাণ প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ব্যারেলে (১,৬০,০০০ ঘন মিটার) পৌঁছেছিল। আজ ঘাওয়ার ক্ষেত্রকে ঘিরে আল-হাসা বিশ্বের বৃহত্তম প্রচলিত তেল ক্ষেত্র।
আল-হাসা তার খেজুর গাছ এবং খেজুরের জন্য বিখ্যাত। আল-হাসায় ২ মিলিয়নেরও বেশি খেজুর গাছ আছে যা থেকে প্রতি বছর ১০০ হাজার টনেরও বেশি খেজুর উৎপাদিত হয়।
পর্যটন কেন্দ্র
ঝর্ণা
আল-হাসা মরুদ্যানে উম্মেসাবা’হ, আল-হাররাহ এবং আল-খোদোদ-এর মতো ৬০ থেকে ৭০টি ঝর্ণা এবং মিঠা পানির উৎস আছে।
পুরাকীর্তি
আল-হাসা মরুদ্যানে বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আছে, যার ফলে এই অঞ্চলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।