বঙ্গ, বাংলা, বাঙ্গালা, বঙ্গাল, বঙ্গদেশ বা বাংলা দেশ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার উত্তরপূর্বে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক অঞ্চল। এই বঙ্গ বর্তমানে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং ভারতের দুইটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার সম্পূর্ণ অংশ এবং আরেকটি রাজ্য আসামের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। বঙ্গ ভঙ্গের আগে পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ মিলে একটি আলাদা রাজ্য গঠিত হয়েছিলো। পরে ভারত বিভক্তের সময় পশ্চিম বঙ্গকে ভারতের সাথে যুক্ত করা হয় এবং তখন থেকেই পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের অংশ (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম বঙ্গ ভারতের একটি রাজ্য হিসেবে যুক্ত হয়। কিন্তু পূর্বে অবিভক্ত বাংলার বেশ কিছু অঞ্চল (ব্রিটিশ রাজের ও মুঘল আমলে) বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্য বিহার, আসাম ও ওড়িশা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই বাংলার অধিবাসীরা বাঙালি জাতি হিসেবে অভিহিত হয়ে থাকেন এবং বাংলা ভাষা এই অঞ্চলের প্রধান ভাষা।
বাংলার এই অঞ্চলটিতে বিশ্বের অন্যতম উচ্চ ঘনত্বের জনসংখ্যা বসবাস করেন এবং এই জনসংখ্যর ঘনত্ব প্রায় ৯০০ জন/বর্গকিমি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এই অঞ্চলটি অধিকাংশ গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র নদী ব-দ্বীপ বা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে অবস্থিত, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ। দক্ষিণ ব-দ্বীপের অংশটিতে সুন্দরবন অবস্থিত — যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গরান অরণ্য এবং যেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাসভূমি। এই অঞ্চলের জনজীবন মূলত গ্রাম্য হলেও কলকাতা, ঢাকা, চট্রগ্রাম,খুলনা, সিলেট, রাজশাহী এর মতো কয়েকটি মহানগর এই বাংলা অঞ্চলটিতে অবস্থিত। এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ভারতীয় সমাজের সমাজ-সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংঘটিত স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
বাংলা বা বেঙ্গল শব্দগুলির আদি উৎস অজ্ঞাত, কিন্তু বিশ্বাস করা হয় যে শব্দটি বং অথবা বাং নামক একটি দ্রাবিড়ীয়-ভাষী জাতিগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বং জাতিগোষ্ঠী ১০০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন।[৩]
অন্য তত্ত্ব বলছে যে শব্দটির উৎপত্তি ভাঙ্গা (বঙ্গ) শব্দ থেকে হয়েছে, যেটি অস্ট্রীক শব্দ "বঙ্গা" থেকে এসেছিল, অর্থাৎ অংশুমালী। শব্দটি ভাঙ্গা এবং অন্য শব্দ যে বঙ্গ কথাটি অভিহিত করতে জল্পিত (যেমন অঙ্গ) প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে পাওয়া যায়, যেমনঃ বেদ, উপনিষদ, জৈন গ্রন্থে, মহাভারত এবং পুরাণে। আনুমানিক ৭২০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সমতট অঞ্চলের দেব রাজবংশের রাজা মহারাজ আনন্দদেবের কুমিল্লার ময়নামতির তাম্রশাসনে "বাঙ্গালা" শব্দের প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। তাম্রশাসন থেকে জন্য যায় মহারাজ আনন্দদেব "শ্রী বাঙ্গালা মৃগাঙ্ক" উপাধি ব্যবহার করতেন, যার অর্থ বাংলা অঞ্চলের চন্দ্র।[৪][৫] পরবর্তীতে "বাঙ্গালা" (বঙ্গাল/বঙ্গল) শব্দের উল্লেখ রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের শাসক গোবিন্দ ৩-এর নেসারি তাম্রশাসনে (৮০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পাওয়া যায়, যেখানে বাংলারপাল সম্রাট ধর্মপালকে "বাঙ্গালার রাজা ধর্মপাল" হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর বৃত্তান্ত লেখা আছে। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও বঙ্গালদেশ এবং বাঙালি জাতির প্রাচীন উল্লেখ রয়েছে।[৬] শ্রীহট্টের মৌলভীবাজার জেলার দশম শতাব্দীর পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে উল্লেখিত আছে যে মহারাজা শ্রীচন্দ্রের আমলে, শ্রীহট্টের অধিবাসীদেরকে (স্থানীয় লোকদেরকে) "বঙ্গাল" নাম দিয়ে পরিচিতি দেওয়া হতো এবং ব্রাহ্মণ অভিবাসীদেরকে "দেশান্তরীয়" ডাকা হতো।[৭]
আদ্য-অস্ট্রালয়ডেরা একটি বঙ্গের সবচেয়ে প্রথম অধিবাসী।[৮] দ্রাবিড়ীয় জাতি দক্ষিণ ভারত থেকে বঙ্গে প্রবেশ করেছিলেন, যখন তিব্বতী-বার্মিজ জাতি হিমালয় থেকে প্রবেশ করেছিলেন, ও ইন্দো-আর্য জাতি প্রবেশ করেছিলেন উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে। যেহেতু জনগোষ্ঠীর গোড়াপত্তনের আপেক্ষিক ক্রম এখন জিন-তত্ত্ববিদগনের গবেষণাধীন, তাই এই বিষয় এখনও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুমান সাপেক্ষ। অধুনাতন বাঙালিরা এই জাতিগুলির সংমিশ্রণ। যদিও বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। পাশতুনেরা, এবং তুর্কীরাদেরও সংমিশ্রণ, যাঁরা এইখানে খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক ওর তৎপরবর্তীকালে প্রবেশ করেন। ইরানিরা ও আরবেরা মূলতঃ নৌপথে ব্যবসায়িক কারণে উপকূল-সংলগ্ন অঞ্চলে (যেমন চট্টগ্রাম) বঙ্গীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রিত হন মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে।
ইতিহাস
প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ বাংলায় পাওয়া গেছে।[৯][১০]ইন্দো-আর্যদের আসার পর অঙ্গ, বঙ্গ এবং মগধ রাজ্য গঠিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতকে। এই রাজ্যগুলি বাংলা এবং বাংলার আশেপাশে স্থাপিত হয়েছিল। অঙ্গ বঙ্গ এবং মগধ রাজ্যের বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় অথর্ববেদে প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল। মগধ ছিল একটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য রাজ্য। মগধের কথা রামায়ণ এবং মহাভারতে পাওয়া যায়। বুদ্ধের সময়ে এটি ছিল ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের মধ্যে একটি। মগধের ক্ষমতা বাড়ে বিম্বিসারের (রাজত্বকাল ৫৪৪-৪৯১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) এবং তাঁর ছেলে অজাতশত্রুর (রাজত্বকাল ৪৯১-৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) আমলে। বিহার এবং বাংলার অধিকাংশ জায়গাই মগধের ভিতরে ছিল।[৮][১১]৩২৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনী মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সীমানার দিকে অগ্রসর হয়। এই সেনাবাহিনী ক্লান্ত ছিল এবং গঙ্গা নদীর কাছাকাছি বিশাল ভারতীয় বাহিনীর মুখোমুখি হতে ভয় পেয়ে যায়। এই বাহিনী বিয়াসের কাছে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং আরও পূর্বদিকে যেতে অস্বীকার করে। আলেকজান্ডার তখন তাঁর সহকারী কইনাস (Coenus) এর সাথে দেখা করার পরে ঠিক করেন ফিরে যাওয়াই ভাল।
মৌর্য সাম্রাজ্য মগধেই গড়ে উঠেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। এই সাম্রাজ্য অশোকের রাজত্বকালে দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান অবধি বিস্তার লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে শক্তিশালী গুপ্ত সাম্রাজ্য মগধেই গড়ে ওঠে যা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাংশে এবং পারস্য এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশে বিস্তার লাভ করেছিল। বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা ছিলেন শশাঙ্ক যিনি ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রাজত্ব করেছিলেন।[১২]প্রথম বৌদ্ধ পাল রাজা প্রথম গোপাল ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। পাল বংশের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই রাজা ছিলেন ধর্মপাল (রাজত্বকাল ৭৭৫-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং দেবপাল (রাজত্বকাল ৮১০-৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ)।
ব্রিটিশ শাসনের সময়ে দুটি মারাত্মক দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর বহু মানুষের জীবনহানি ঘটিয়েছিল। প্রথম দুর্ভিক্ষটি ঘটেছিল ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে এবং দ্বিতীয়টি ঘটেছিল ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। ১৭৭০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির রাজত্বকালে বাংলার দুর্ভিক্ষটি ছিল ইতিহাসের সব থেকে বড় দুর্ভিক্ষগুলির মধ্যে একটি। বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল ১৭৭০ এবং তার পরবর্তী বছরগুলিতে। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটায় এবং বাংলা সরাসরি ভাবে ব্রিটিশ রাজবংশের শাসনাধীনে আসে।
বাংলা ছিল খুব ভালো ধান উৎপাদক অঞ্চল এবং এখানে সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র মসলিন তৈরি হত। এছাড়া এই অঞ্চল ছিল পৃথিবীর পাট চাহিদার মুখ্য যোগানকারী। ১৮৫০ সাল থেকেই বাংলায় ভারতের প্রধান শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠতে থাকে। এই শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছিল মূলত কলকাতার আশেপাশে এবং সদ্য গড়ে ওঠা শহরতলি এলাকায়। কিন্তু বাংলার বেশিরভাগ মানুষ তখনও কৃষির উপরেই বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। ভারতের রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে বাংলার মানুষেরা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করলেও বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় তখনও খুব অনুন্নত জেলা ছিল। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে রানী ভিক্টোরিয়া যখন ভারতের সম্রাজ্ঞী উপাধিতে নিজেকে ভূষিত করলেন তখন ব্রিটিশরা কলকাতাকে ব্রিটিশ রাজ্যের রাজধানী বলে ঘোষণা করে।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে গণপ্রজাতন্ত্র ভারত এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ পায়। তখন বাংলা ভাগ হয়ে পশ্চিম বাংলা ভারতের একটি অংশ এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি অংশে পরিণত হয়।[১১] পাকিস্তানি সরকারের অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ নামে অভুদ্যয় ঘটে[১৩]